প্রচলিত আইনে রয়েছে তার নিরাপদ মাতৃত্বের নিশ্চয়তা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই আইনটি না মানার ফলে অনিকা মুন্ডার গর্ভের ৭ মাসের সন্তানটির অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা-২০১৫ এর ৩৭নং ধারার (খ) তে বলা আছে, সরকার কর্তৃক ঘোষিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অথবা স্বাস্থ্যের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ হয় এমন কোনো কাজে নিয়োজিত না করা।
জানা গেছে, সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেই অনিকা দৈনিক প্রায় ছয় কিলোমিটারে রাস্তা পেরিয়ে কর্মস্থলে পৌঁছান। কড়া রোদের উত্তাপ কিংবা বর্ষা মৌসুমে টিলা থেকে পা পিছলে পড়ার মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে তার। সেখানে গিয়ে ধারালো দা দিয়ে প্রুনিং (চা বাগান ছাঁটাই করা) এর কাজ করতে হয় তাকে। বর্তমানে অনিকা মুন্ডার দশ বছরের একটি মেয়ে এবং পাঁচ বছরের একটি ছেলে রয়েছে।
তার পঞ্চম গর্ভধারণের সময় সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভপাত হয়েছে। ইতোপূর্বেও অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে তার আরো একবার গর্ভপাত ঘটেছে।
জাগছড়া চা বাগানের শ্রমিক লাইনে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র একটি ঘরেই স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন চা শ্রমিক অনিকা মুন্ডা। স্বামী সুনীল মুন্ডা দৈনিক দিনমুজুরের কাজ করেন।
পড়ুন>> হুইল চেয়ারে বসেই লক্ষ্য জয়ে তাগুচি
স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী বলেছেন, অতিরিক্ত কাজ করার ফলে অনিকার গর্ভপাত হয়েছিল। এ অবস্থা শুধু অনিকার নয়, চা বাগানে বিষয়টি নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা।
জানা যায়, একই এলাকার লক্ষ্মী মুন্ডা, সীমা মুন্ডা এবং মনি কাহারও মাতৃকালীন ছুটি থেকে বঞ্চিত। তারাও গর্ভাবস্থায় নানান স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, চা পাতা তোলার কাজে আমাদের প্রতিদিন হেঁটে যেতে এবং ফিরতে হয়। সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাতা তোলা ছাড়া কোনো উপায় নাই।
নারী চা শ্রমিক অনিকা মুন্ডা বাংলানিউজকে বলেন, আমি আমার ননদের কাজটি নিয়েছি। অনেক দূরের নম্বরে কাজ করতে যাই। আমরা গাড়িতে যাই কিন্তু আসার সময় হেঁটে আসি। বাসায় এসে রান্নার কাজ করি। আমার তিনটা সন্তান হয়েছে। কিন্তু কোনোবারই বাগান থেকে ঔষধ দেয় না। আমরা বাইরে থেকে অনেক কষ্ট করে ঔষধ কিনে এনে খাই।
তার ভাষ্য, সাত মাস পর্যন্ত কাজে গেছি। তারপর থেকে বুঝতে পারি পেটের বাচ্চাটি আর নড়াচড়া করে না। ক’দিন ধরেই পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলে একদিন রাত ৩টার সময় আমার পিশি (খালা) শাশুড়ি তারামণি মুন্ডা আমার পেটের মরা বাচ্চাটি ‘খালাস’ করান। স্থানীয় মুজিব ডাক্তারের কাছ থেকে ঔষধ কিনে খেয়েছি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং শ্রমিক নেতা রামভজন কৈরী বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের নারী চা শ্রমিকরা প্রসব-পূর্ববর্তী নিরাপদ মাতৃসেবা এবং প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা থেকে বরাবরই বঞ্চিত। তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি। কারণ পাতা তোলা শ্রমিকদের মধ্যে তারাই ৯৫ শতাংশের মতো এবং তাদের করতে হয় চা শিল্পের জন্য সবচেয়ে কষ্টের কাজ।
‘কিছু কিছু ধারায় শ্রম আইনের বাস্তব প্রয়োগ এখানে নেই। এ সংক্রান্ত আরো বিষয় নিয়ে আমরা বাগান কর্তৃপক্ষের সাথে সংখ্যবার আলোচনা করেছি। ফলাফল শূন্য। ’
মৌলভীবাজার জেলার গাইনি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. নিবাস পাল বাংলানিউজকে বলেন, নারী চা শ্রমিকদের প্রজনন সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকিতে রয়েছে। গর্ভকালীন প্রয়োজনীয় সুষম খাদ্যগ্রহণ, পরিপূর্ণ সেবা-বিশ্রাম প্রভৃতি বিষয়গুলোর প্রতি তাদের সচেতনতা নেই বললেই চলে। অশিক্ষা ও দরিদ্রতা এর অন্যতম কারণ।
‘জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, গ্রাম পর্যায়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র বা কমিউনিটি ক্লিনিক, স্যাটেলাইট ক্লিনিকগুলোতে সরকারিভাবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে গর্ভবতী নারীদের প্রয়োজনীয় সেবা ও চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। ’
কিন্তু সেক্ষেত্রে রোগীর পরিবারকে দ্রুত যোগাযোগ করে সেই রোগীকে উল্লেখিত সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ভর্তি করাতে হবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২০
বিবিবি/এমএ