ঢাকা: রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে লিবিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতাসহ দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের গুলশান বিভাগের একটি টিম।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতা মো. মনির হাওলাদার ওরফে মনির হোসেন (২৬) ও এবং তার সহযোগী মো. সেলিম ওরফে সেলিম শিকদার (৩৫)।
বৃহস্পতিবার (০৬ আগস্ট) রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বাংলানিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বুধবার (৫ আগস্ট) রাত সাড়ে ৮ টার দিকে যাত্রাবাড়ী ধানাধীন কাজলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
তিনি বলেন, গত ০৬ জুন রাজধানীর মতিঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও সন্ত্রাস বিরোধী আইনে ২৭ জনের নামে একটি মামলা দায়ের হয়। ওই মামলার এজাহারভুক্ত ১ নম্বর আসমি ছিলেন মো. সেলিম শিকদার এবং ২ নম্বরে মো. মনির হাওলাদারের নাম রয়েছে। গ্রেফতার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত দুইজনের ৭ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে।
গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, চক্রের মুলহোতা সেলিম ও তার সহযোগী মনির শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ফেনী, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকা সহজ-সরল মানুষদের টার্গেট করতো। এরপর বেশি বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে লিবিয়ায় যেতে উৎসাহ যোগাতো। পাসপোর্ট ও ছবিসহ আগ্রহীদের ঢাকা থাকা চক্রের অন্য সদস্য শরীফ ও কবিরের কাছে পাঠিয়ে দিত। অবৈধ পথে পাচার করা মানুষের স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে তারা দুইজন টাকা সংগ্রহ করতো। এই টাকার একটি অংশ বাংলাদেশে অবস্থানরত মনিরের স্ত্রী শ্বশুর কিংবা বাবার কাছে দিতো। আরও একটি অংশ চক্রের দালাল শরীফ ও কবিরের কাছে পাঠাতো। আর এই কাজের জন্য সেলিম সবার কাছ থেকেই কমিশন নিতো।
তিনি বলেন, গ্রেফতার আসামি মনির হাওলাদার ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও সে অনেক চতুর প্রকৃতির। অল্প সময়ের মধ্যেই সে লিবিয়ার সেনাবাহিনী ও লোকাল পুলিশের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ গড়ে তোলে। এই যোগাযোগের মাধ্যমেই মনির লিবিয়ার বেনগাজির মাঝুরী, ত্রিপোলীর সুলেমান এবং জোয়ারার গেইমিং ক্যাম্প পরিচালনা করে আসছিল।
গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মনির জানায়, সে তার এক আত্মীয় শাহজালালের মাধ্যমে ২০১০ সালে প্রথম লিবিয়া যায়। এরপর একই পন্থায় ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বার এবং ২০১৮ সালে তৃতীয়বার লিবিয়াতে যায়। তার এই যাওয়ার পেছনে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে দালাল শরীফ ও কবির।
মনির লিবিয়াতে গিয়ে একটি কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে শ্রমিকের চাকরি নেয়। এরপর ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে শতাধিক মানুষকে লিবিয়াতে নিয়ে যায়। এতে জন প্রতি ৪ লাখ টাকা নেয় সে। লিবিয়াতে মানবপাচারের জন্য সে স্বাধীন ট্রাভেলস নামে একটি এজেন্সি ব্যবহার করতো। এই ট্রাভেন্স এজেন্সিটি দালাল শরীফ ও কবির পরিচালনা করে বলে জানায়।
বাংলাদেশ থেকে দুবাই হয়ে লোকজন বেনগাজিতে পৌঁছার মনির প্রথম দফায় দালাল শরীফের বন্দিশালায় রাখতো। এরপর সেখান থেকে দ্বিতীয় দফায় তাদের মাঝুরী বন্দিশালায় নিতো। সেখান থেকে তৃতীয় দফায় ত্রিপোলিতে মনিরের সুলেমান বন্দিশালায় আটক রেখে ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন করে স্বজনের কাছে চুক্তির ৪ লাখ টাকাসহ অতিরিক্ত আরও টাকা দাবি করতো। স্বজনদের কাছে নির্যাতনের বিভিন্ন ভিডিও ও কান্নার শব্দ পাঠাতো। মোবাইল ফোনেও কান্নার শব্দ শোনাতো।
লিবিয়ায় পাচারের পর চক্রের মুলহোতা মনির লিবিয়ার জোয়ারা-তে একটি গেইমিং ক্যাম্প পরিচালনা করতো। সেখান থেকে আবার অর্ধশতাধিক লোককে লিবিয়া কোষ্টগার্ড/মিলিশিয়া/সেনাবাহিনী/পুলিশের সহযোগিতায় অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগরে প্লাস্টিক বা কাঠের বোটে করে পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পাচার করতো বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা গেছে, মনিরের তত্ত্বাবধানে লিবিয়ায় একাধিক ক্যাম্পে তার সহযোগিদের হেফাজতে আরো বেশকিছু বাংলাদেশি বন্দি অবস্থায় আছে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অন্য মামলায় গ্রেফতারকৃত বাদশাহ এর মাধ্যমে যোগাযোগ করে কমপক্ষে ১৭ জন বাংলাদেশিকে মুক্ত করা হয়েছে। ১৭ ভুক্তভোগী তাদের পাসপোর্ট ও পকেট মানি ফিরে পেয়েছে। ভুক্তভোগীদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর সরাসরি তদারকি করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতর গুলো যোগাযোগ করছে।
সম্প্রতি লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা ২৬ জন বাংলাদেশিসহ মোট ৩০ জনকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনায় আহত হয় ১১ বাংলাদেশি। মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় প্রায় ২৬টির বেশি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৭১ জন পাচারকারী গ্রেফতার হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০২১০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০২০
এসজেএ/এমএমএস