গিরিশচন্দ্র সেন (জন্ম নরসিংদী ১৮৩৫-মৃত্যু কলকাতা ১৫ আগস্ট ১৯১০) ‘মাওলানা’ বলে খ্যাত। আবার কেউ কেউ শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় তাঁর নামের আগে ‘ভাই’ বসিয়ে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ডাকতেন।
দীনেশ হিন্দু হয়ে আমাকে একবার ‘ইসলামিক’ উপকার করেছিলেন। আমার প্রকাশনী থেকে ‘শয়তানের নয়নবারি’ বইটি নিয়ে মৌলবাদী দলগুলো দৈনিক ইনকিলাব, বায়তুল মোকররম, পুরানা পল্টন থেকে কাঁটাবন মসজিদ পর্যন্ত আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে দেয়। সরকার বইটি নিষিদ্ধ করলেও মোল্লারা থামলো না। তখন দৈনিক ইনকিলাবকে থামানোর জন্য বিশিষ্ট সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী, মুফতি আমিনীকে থামানোর জন্য সাপ্তাহিক পূর্ণিমার (বর্তমানে বাংলানিউজে) আহমেদ রাজু, জামাত আর খতিব ওবায়দুল হককে থামানোর জন্য মাওলানা দীনেশ দাশ বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি একদিন আজিজ মার্কেটে এসে বললেন- চরমোনাইয়ের পীর সাহেব জনসভায় ক্ষমা চাইতে বলেন আর খতিব সাহেব (মতিউর রহমানের মতো) তওবা পড়ার প্রস্তাব দেন।
দীনেশ দাশের সাথে এ রকম অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতি আছে। আমি তখন জাপান থেকে প্রকাশিত মাসিক মানচিত্র আর সুইডেন থেকে প্রকাশিত দ্বি-মাসিক পরিক্রমা বের করি। তিনি মাঝে মাঝে লিখতেন। আসতেন লেখা দিতে এবং বিল নিতে। ছাত্র ইউনিয়ন করা দীনেশ দাশ জানতেন, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কমরেড রবি নিয়োগী আর মনজুরুল আহসান খান আমার এলাকার মানুষ। তাই বলতেন, ‘দুলাল দা, আপনি পার্টিতে যোগ দেন না কেন?’ আমি তাঁকে ধাঁধা দিতাম, বলতাম- ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের জামায়েত ইসলামের সাথে কি কি মিল/অমিল আছে?’ তিনিও হাসতে হাসতে জবাব দিতেন- ‘ডানপন্থী এবং বামপন্থী ছাড়াও এক দলের শেষে আরেক দলের শুরুতে বাংলাদেশ আছে। রাশিয়ায় বৃষ্টি হলে আর সৌদিতে রোদ উঠলে এরা এখানেই ছাতা মেলে’। এভাবেই রসিকতা করতেন দীনেশ দাশ। বলতেন, কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম- টুপি পড়ে মসজিদ থেকে বেরুচ্ছি। গুণ দা(কবি নির্মলেন্দু গুণ) আর অসীম দা (কবি অসীম সাহা) আমাকে দেখে হাসছেন।
সাদামাটা, নিরহঙ্কার (জন্ম ০৩ মার্চ ১৯৬৪, নওগাঁ) এই মানুষটি সাংবাদিকতা শুরু করেন রাজশাহীর দৈনিক বার্তার মাধ্যমে। তারপর ঢাকায় এসে যুক্ত হন সাপ্তাহিক ‘একতা’র সাথে। এক সময় দৈনিক বার্তার সাহিত্য পাতায় লিখতাম। তখন থেকেই আমার লেখার সাথে তাঁর পরিচয়। তাই বারবার ‘একতা’য় লেখার জন্য বলতেন। মাঝে মাঝে চাকরির কথা বলতেন। বাসসে হারুন হাবীব কিংবা আমাদের সময়ে নাঈমুল ইসলাম খানকে বলার জন্য। কিন্তু তাঁদের আর অনুরোধ করা হয়নি। পরে নিজেই দৈনিক আমাদের সময়ে ঢুকেছিলেন। কিন্তু স্থিরতা ছিলো না। অর্থকষ্টের পরেও দীনেশ ছিলেন খুব আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন সচেতন সাংবাদিক।
যিনি অন্যের খবর লিখতেন, গত ৮ জানুয়ারি তিনি নিজেই খবরের শিরোনাম হলেন : ‘...সাংবাদিক দীনেশ দাশ দৈনিক আমাদের সময়ের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন। দেড় মাস আগে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর থেকেই অর্থকষ্টে দিন চলছিল তার। গতকালও মেয়েকে স্কুলে নিয়ে টাকার অভাবে নতুন ক্লাসে (তৃতীয় শ্রেণী) ভর্তি করতে পারেননি। সকালে স্ত্রীর মাটির ব্যাংক ভেঙে দেড়শ’ টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হন তিনি। একদিকে বাসা ভাড়া দেওয়া হয়নি, মোটরসাইকেলে তেল নেই, বাসায় বাজার নেই, মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে--এমন পরিস্থিতিতে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। চাকরির সন্ধানে ছুটে বেরিয়েছেন এক পত্রিকা থেকে অন্য পত্রিকা অফিসে। তিনি যে বেকার জীবনযাপন করছিলেন একথা জানতেন না তার স্ত্রী পলি দাশ। স্ত্রীর কাছে এ কথা বলতেও পারেননি। স্ত্রীকে সহকর্মীদের সামনে আনলেও পাশে ডেকে তাদের বলে দিতেন স্ত্রীকে যেন না জানানো হয় তার বেকারত্বের কথা। সর্বশেষ শুক্রবার রাতেও এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি এমন আর্জিই করেছিলেন’। (দৈনিক ইত্তেফাক, জানুয়ারি ০৮, ২০১২ ঢাকা)
বিধবা পলি আর এতিম অথৈয়ের আর্জি-আহাজারির শেষ কোথায়? জানি না! যে দীনেশ দাশ ‘চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদ’ গঠন করে কৃতী মফস্বল সাংবাদিকদের পুরস্কার দেওয়ার পদক্ষেপ নেন, আজ তিনিই স্মৃতি-বিস্মৃতির দীনেশ দাশ হয়ে গেলেন। তিনি বলতেন- দুলাল দা, বিদেশেই চলে যাবো। আবার হেসে বলতেন- পাসপোর্ট নাই। কলকাতায় যেতে পারিনি আর বিদেশে যাবো কিভাবে?
হ্যাঁ, অবশেষে দীনেশ দাশ পাসপোর্ট ছাড়াই চিরদিনের জন্য সুদূর বিদেশে চলে গেলেন।
saifullahdulal@gmail.com