ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

রায়হানকে এক ঘণ্টা নির্যাতন করেন এসআই আকবর

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০২০
রায়হানকে এক ঘণ্টা নির্যাতন করেন এসআই আকবর রায়হান ও তার আঘাতপ্রাপ্ত হাত।

সিলেট: মারপিটকে খুব ভয় পেতেন রায়হান। এ কারণে বন্ধুরাও তাকে লেডিস বলে ঠাট্টা করতেন।

সেই ভয় জীবনে কাল হয়েই দাঁড়ালো রায়হানের। প্রায় এক ঘণ্টার পুলিশি নির্যাতনে প্রাণ হারান তিনি।
 
রোববার (১১ অক্টোবর) ভোর রাতে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে আনার পর তাকে নেওয়া হয় ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর হোসেন ভুঁইয়ার কক্ষে। সেখানে লাঠি দিয়ে তাকে উপর্যুপরি আঘাত করা হয়।

আকবরের সঙ্গে অতিউৎসাহী হয়ে রায়হান উদ্দিনকে (৩০) মারধর করেন কনস্টেবল হারুন ও টিটু। ফাঁড়ির প্রত্যক্ষদর্শী এক পুলিশ সদস্য বাংলানিউজকে এমন লোমহর্ষক তথ্য নিশ্চিত করেন।
 
উপ সহকারী পরিদর্শক পদবীর ওই পুলিশ সদস্য দাবি করেন, রোববার ভোর রাতে কাষ্টঘর এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এক ভ্যান চালকের ১০ হাজার টাকা ও মোবাইল ছিনতাই হয়। ছিনতাই হওয়া ব্যক্তির বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার মকসুদপুরে। তার দেখানো মতে কাষ্টঘরের সুলাই লালের ঘর থেকে নাকি রায়হানকে ধরে পুলিশ ফাঁড়িতে আনেন তিনি। রায়হানকে ধরার বিষয়টি ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমেও অবগত করেছিলেন তিনি।
 
রায়হানকে ফাঁড়ির অভ্যন্তরে শেষ মাথায় এসআই আকবরের কক্ষে নিয়ে গেলে মারধর শুরু করা হয়। তথ্য প্রদানকারী পুলিশ সদস্য রায়হানকে মারতে বারণ করে এসআই আকবরকে বলেন, স্যার মরে যাবে তো। কিন্তু তার কথা না শুনে পেটাতে থাকলে তিনি ফাঁড়ি থেকে বেরিয়ে সিগারেট আনতে জিন্দাবাজার পয়েন্টে চলে যান। রাতের ডিউটিতে থাকা সিয়েরা-চার পার্টির পুলিশ কনস্টেবল হারুন ও টিটু মিলে মারধর করলেও তৌহিদ ফেঁসে যান মোবাইল ব্যবহার করতে দিয়ে। তার মোবাইল দিয়েই ভোর রাত ৪টা ৩৭ মিনিটের দিকে রায়হানের বাসায় ফোন করা হয়। এরপর কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) সৌমেন মিত্র তাকে ফোন করে ফাঁড়িতে আসতে বলেন এবং মৃত্যু পথযাত্রী রায়হানকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেন।
 
বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় রায়হানকে নিয়ে আসা ও নির্যাতনের পর হাসপাতালে নেওয়ার দৃশ্যটি পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সিসি ফুটেজে ধরা পড়ে। সেখানে হাসপাতালের দুই তলায় নিয়ে এক্স-রে করার পর ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে ভর্তি করেন। এরপর রায়হানের অবস্থা গুরুতর হলে আইসিইউতে নেওয়ার ২০ মিনিট পর ভোর ৬টার দিকে দায়িত্বরত চিকিৎসক রায়হানকে মৃত ঘোষণা করেন।

বিষয়টি ফোনে এসআই আকবরকে জানান রায়হানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্য। পরে এসআই আকবর সঙ্গে কনস্টেবল হারুনকে নিয়ে হাসপাতালে যান। হাসপাতাল থেকে ফাঁড়িতে ফিরে আসার পর সকাল ৮টার দিকে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ মুছে দিয়ে (ডিলিট) বেরিয়ে পড়েন। আর ফাঁড়ি থেকে বেরিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান আকবর। এর পর থেকেই তার মোবাইলও বন্ধ পাওয়া যায়।
 
প্রত্যক্ষদর্শী ওই পুলিশ সদস্য বলেন, এসআই আকবর বাঁশের লাঠি দিয়ে অমানবিক নির্যাতন করেছেন। তাদের বেপোরোয়া নির্যাতনের কারণে জলজ্যান্ত মানুষটির আঙুলের নখ উপড়ে যায়, হাত ও পায়ের হাঁড় ভেঙে যায়। রায়হানকে অমানবিক নির্যাতনের বিষয়টি ওসি সৌমেনকে জানান তিনি। একই বক্তব্য তিনি পুলিশ কমিশনারের সামনেও দিয়েছেন।
 
প্রত্যক্ষদর্শী ওই পুলিশ সদস্য বলেন, 'চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিন জনকে প্রত্যাহার করা হলেও আমরা ছয় জনই পুলিশ লাইনে আছি। কিন্তু এসআই আকবর নেই, তিনি রোববার সকাল থেকেই লাপাত্তা হয়ে যান। পুলিশ লাইনে কড়া প্রহরায় রাখা হয়েছে আমাদের।
 
রোববার (১১ অক্টোবর) রায়হান উদ্দিন নিহত হন। পুলিশের দাবি ছিনতাইয়ের অভিযোগে নগরীর কাষ্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে রায়হান মারা যান। কিন্তু নিহতের পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগ, ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে রায়হান নিহত হন। মারা যাওয়ার পর রায়হানের শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তার হাতের নখও উপড়ানো ছিল। এ ঘটনার পর পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে রায়হানকে হত্যার অভিযোগ এনে নিহতের স্ত্রী কোতোয়ালি থানার হত্যা মামলা দায়ের করেন।
 
সোমবার (১২ অক্টোবর) এ অভিযোগে পুলিশের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির সুপারিশে ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ চার জনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিন জনকে প্রত্যাহার করা হয়।  

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া অন্য পুলিশ সদস্যরা হলেন- বন্দরবাজার ফাঁড়ির কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাস। প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন- এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০২০
এনইউ/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।