ঢাকা, সোমবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৯ জুলাই ২০২৪, ২২ মহররম ১৪৪৬

জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ক্ষত

উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ক্ষত

পাবনা (ঈশ্বরদী): ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিজয়ের ঠিক দু’দিন বাকি।

সারা দেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ শুরু হয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজে যুদ্ধবিমান থেকে বোমা হামলা চালিয়ে ব্রিজের একটি স্প্যান ভেঙে ফেলা হয়।  

পাকিস্তা বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ভারতীয় মিত্র বাহিনী ব্রিজে বোমা নিক্ষেপ করে। বিজয়ের শেষ লগ্নে ১৪ ডিসেম্বর বোমার আঘাতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১২ নম্বর মূল গার্ডারটি ভেঙে গিয়েছিল। এছাড়া ২, ৯ ও ১৫ নম্বর গার্ডারটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই বোমার একটি অংশ এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে।

ব্রিটিশ সরকার নিজ খরচে জাহাজ উদ্ধারকারী কোম্পানি সেলকো দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্প্যানের উদ্ধার কাজ শুরু করেন। স্বাধীনতার পর ১২ নম্বর গার্ডারের অনুরূপ আরেকটি স্প্যান পুনঃস্থাপন করে ভারত। ব্রিজের ১২ নম্বর গার্ডে আজও লেখা আছে সে তথ্য। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এ সেতু। ‘হার্ডিঞ্জ’ যেন এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। মু্ক্তিযুদ্ধের ক্ষত আর শত বছরের গৌরব নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছ মাথা উঁচু করে। বোমার অংশ যেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে।

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী রেলওয়ে সদর দপ্তর ‘পাকশীর বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপকের (ডিআরএম) কার্যালয়ের সামনে’ বোমাটি সংরক্ষণ করা আছে।  

তৎকালীন পাবনার এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সম্পাদক ও বর্তমান ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রশীদূল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ঠিক বিজয়ের দু’দিন আগেও ঈশ্বরদীজুড়ে ১০টি অপারেশন ক্যাম্প তখনো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। তখন যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালাতে শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। ওই দিন (১৪ ডিসেম্বর) পাকিস্তানি হানাদার পালিয়ে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়ে ঈশ্বরদীর দিকে আসছিল।

খবর পেয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের মোকাবিলা করার জন্য চর সাহাপুরে প্রকৌশলী আব্দুল গফুরের বাড়ির সামনের রাস্তায় অবস্থান করেন। যশোর-কুষ্টিয়া তখন মুক্ত হয়ে গেছে। দলে দলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হতে লাগলো। ব্রিজে তারা ডিনামাইট লাগিয়ে বিদ্যুৎ সংযোজন করে রেখেছিল। কারণ অবস্থার বেগতিক দেখলে ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়া হবে। তারা বেশ ক্ষুধার্ত ছিল বলে মনে হয়েছিল। কারণ পাকশী রেল টানেল ও বাঘইল রেল টানেলের মাঝা-মাঝি জায়গায় ৩০ জন পাকিস্তানি সেনাকে কাঁচা বেগুন খেতে দেখা যায়। পাকিস্তানি সেনাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সে সময় বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া সড়কের ধারে অবস্থান নিয়ে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে পাকিস্তানি সেনারা কর্ণপাত না করে গুলি ছুড়তে থাকে। বীর মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালালে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে দেন। একপর্যায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে গ্রামের চারপাশ দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলেন। বেপরোয়া হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সেনারা। তারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্যাংক, কামান ও জিপ নিয়ে পার হতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা মিত্র বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডারের কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিমান বাহিনীর সহযোগিতা চাই। ১৪ ডিসেম্বর দুপুর আনুমানিক ১২টার দিকে পাকশীর আকাশ দিয়ে ভারতীয় পাঁচটি যুদ্ধবিমান হার্ডিঞ্জ সেতুর ওপর চক্কর দিতে থাকে। শুরু হয় বিমান থেকে বোমা হামলা। চার-পাঁচটি বোমা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। বোমার প্রচণ্ড আঘাতে ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানটির এক দিকের অংশ ভেঙে পদ্মা নদীতে পড়ে যায়। আরেকটি স্প্যানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণের শব্দে চমকে ওঠেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। আর দলবদ্ধ ও অ্যাম্বুশ ভেঙে পাকিস্তানি সেনারা পাকশী থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে।

পাকশি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলাম হবিবুল বাংলানিউজকে বলেন, আমরা তখন বাঘইল গ্রামে পাকশী পেপার মিল ব্যাগাজ ইয়ার্ডের কাছে অবস্থান নিয়েছিলাম। দুপুর ১২টার দিকে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর বিমান অনেকক্ষণ আকাশে মহড়া দিচ্ছিল। প্রথমে পরপর তিনটি এবং কিছুক্ষণ পর আরেকটি বিমান থেকে বোমা বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ পাওয়া যায়। শব্দে মাটি কেঁপে ওঠে। শব্দের পর চরের প্রচণ্ড ধুলা ও ধোঁয়া এলাকায় ছড়িয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর ঈশ্বরদী মুক্ত হলে বিধ্বস্ত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখা যায়, ১২ নম্বর স্প্যানটি একদিকে কাত হয়ে পদ্মা নদীতে পড়ে ছিল। আর ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ সংযোগের তারগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনার মরদেহ ঝুলে আছে। পাকিস্তানি সেনাদের ফেলে যাওয়া একটি ট্যাংক সে সময় ব্রিজের ওপর পড়ে ছিল। ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার কারণে পাকিস্তানি সেনারা সেটি পার করতে পারেনি।  

পরে সেই দিন আরেকটি বোমা ফেলা হয়েছিল পাকশী রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে ব্রিজের পশ্চিমে বালুচরের মধ্যে। আরেকটি বোমা পড়েছিল রেললাইনের ওপর। বিমান থেকে ফেলা একটি বোমা বালুর ওপর পড়ায় সেটি বিস্ফোরিত হয়নি। পরবর্তীকালে সেনা বাহিনীর সহযোগিতায় বালুর ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সেই বোমার খোলসটি পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহীদূল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজে যুদ্ধবিমান থেকে বোমা হামলা চালিয়ে ব্রিজের একটি স্প্যান ভেঙে ফেলা হয়। সেই বোমার একটি অংশ এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে। পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের ডিআরএম চত্বরের সামনে নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে বোমার খোলসটি এখনো রাখা আছে। লোহার তৈরি খোলসটির ওজন প্রায় দুই মণ। বোমার খোলসটি রং করে সিমেন্টের বেদিতে গাঁথা রয়েছে। এর চারপাশ লোহা দিয়ে ঘেরা। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী বোমার খোলসটি দেখার জন্য অনেক দর্শনার্থী এখানে আসেন। পাকশী রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত বোমার খোলসটি পরিষ্কার, সংরক্ষণ ও রং করা হয়।

মহান স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর বোমার খোলসটি এখন এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের একটি স্মৃতি হয়ে আছে নতুন প্রজন্মের কাছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা ব্রিজ ভাঙা বোমার খোলসটি দেখতে পাকশী আসেন। বোমার খোলসটি এখন এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের একটি স্মৃতি হয়ে আছে নতুন প্রজন্মের কাছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২০
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।