ঢাকা, সোমবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৯ জুলাই ২০২৪, ২২ মহররম ১৪৪৬

জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধের শক্তি একতাবদ্ধ হলে, মৌলবাদ পিছু হটবে: পঙ্কজ ভট্টাচার্য

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেস্পন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২০
মুক্তিযুদ্ধের শক্তি একতাবদ্ধ হলে, মৌলবাদ পিছু হটবে: পঙ্কজ ভট্টাচার্য বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য

ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শক্তিগুলো একতাবদ্ধ হলে, বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদ পিছু হটবে বলে মনে করেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছাত্রজীবন থেকেই বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।

তিনি ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত গেরিলা বাহিনীর অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত পঙ্কজ ভট্টাচার্য বর্তমানে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য সমকালীন রাজনীতির স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে না দেওয়া একজন রাজনীতিবিদ। অর্থ-প্রতিপত্তি-ক্ষমতা-লোভ তাঁকে কখনো আদর্শ থেকে একচুলও সরাতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার অভীষ্ট লক্ষ্যে আজও তিনি অবিচল।

স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে তার নিজের অভিজ্ঞতা এবং আদর্শগত স্থান থেকে থেকে রাজনীতির নানা চড়াই উতরাইয়ের কথা বাংলানিউজের সঙ্গে অকপটে বলেছেন। তার কথোপকথনের আলোচিত অংশ তুলে ধরা হল।
 
মহামারি করোনাকালীন কেমন আছেন প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা হেসে তিনি বলেন, রাজনীতি করার কারণে আমাকে বহুবার জেল খাটতে হয়েছে। আত্মগোপনেও থাকতে হয়েছে বছরের পর বছর। এই করোনাকালীন সেই জেলে থাকার, আত্মগোপনে থাকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগছে। সবকিছু মিলে ভালোই আছি।

স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনে সবথেকে গৌরবান্বিত একটা অধ্যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের একটা বিরলতম উদাহরণ। ভিয়েতনামও অনুরূপ ঘটনা ঘটাতে পেড়েছে। ইতিহাসে এমন ঘটনাও নাই যে, এক কোটি ২০ লক্ষ নর-নারী শরণার্থী হয়েছে। বিশ্বের প্রধান কিছু দেশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও বিশ্বমানবতা আমাদের পক্ষে ছিল। জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্যে নয়, ভাষা, সংস্কৃতি, নিজস্ব স্বকীয়তার স্বাধীনতার জন্যে। ৩০ লক্ষ্য মানুষ জীবন দিয়েছে, খুব কম দেশেই এমন উদাহরণ পাওয়া যায়। ধর্মের নামে নারী নির্যাতনসহ গণহত্যা, পাক সাম্প্রদায়িকতা ভূমিকা দেশের অধিকাংশ মানুষ ভুলতে পারেনা। মুক্তিযুদ্ধের মত ঘটনা কোন জাতির জীবনে সহজে আসেনা। আমাদের এসেছিল।

আমাদের নিজস্ব কিছু দুর্বলতা আছে।  মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন তাজ উদ্দিন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তখন তাজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে একাধিকবার অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে আমাদের বিভ্রান্ত কিছু বন্ধু। এই ধারা যোগেই পরবর্তীতে মোশতাক শক্তিশালী হয়েছে। স্বাধীনতার দুই বছরের মাথায় তাজ উদ্দিন মন্ত্রীসভা থেকে বিতাড়িত হয়েছে এবং মোশতাক আরও শক্তিশালী হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আস্তিনের মধ্যে থেকে বিশ্বস্ততার ভান করে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার ভূমিকা পালন করেছেন। এই ধারাটা মনে রাখলে দেখা যায় ৭৫ সাল পর্যন্ত শত্রু আমাদের ঘরের মধ্যেই ছিল। এই একই ধারাতে মোশতাক, জিয়া এবং পরবর্তীকালে এরশাদ পাকিস্তানের পথে বাঙালীকে এবং বাংলাদেশকে পরিচালিত করেছিল। তারা মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, জামাতকে আইন সঙ্গত করেছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না করতে ইনডেমনিটি আইন করেছিল, এই ধারাতেই মুক্তিযুদ্ধকে ধামাচাপা দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধকে নিশ্চিহ্ন  করতে পাকিস্তানের পথে হেঁটেছিল।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে আরও একটি ধারার সূচনা করে বাঙালী ছাত্র-যুবসমাজ এবং পেশাজীবী সমাজ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আমরা গণতন্ত্র ফেরত পেয়েছি, কিন্তু সেই গণতন্ত্র ক্রমশই ম্লান হয়ে পড়ছে। আমরা সংবিধান ফেরত পেয়েছি। কিন্তু সংবিধানে জিয়া এবং এরশাদ ধর্মের নামে যে গোঁজামিল দিয়েছিল, সেই গোঁজামিল ধারাটা এখনও বহন করে চলেছি।

বর্তমান সময়ে হেফাজতের আস্ফালন প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলেও কৌশল হিসেবে তারা সাম্প্রদায়িকতা বিশেষ করে হেফাজতের সাথে সমঝোতার নীতি গ্রহণ করেছে। সেই সমঝোতার কারণে আজকে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, হুমকি দিয়ে বলছে জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙবে। বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে হেফাজত ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে। বিএনপি এখনও জামাত নির্ভর হয়ে আছে, হেফাজতে ইসলাম তাদের সঙ্গে যুক্ত হলে তারাই সংখ্যায় মুল শক্তি হয়ে উঠবে বলে ভাবতে সাহস পাচ্ছে। এই অবস্থায় হেফাজত আর জামাত পবিত্র ধর্মের নামে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য শুধু নয়, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, সংবিধান সবকিছু বদলাতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক বিষয়, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই।

বর্তমান সঙ্কট থেকে বের হবার বিষয়ে জানতে চাইলে বর্ষীয়ান এই নেতা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে তার বক্তব্যে বলেছিলেন, আমাদেরকে আত্মসমালোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসা করতে হবে এবং আত্মশুদ্ধির পথে চলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির আজকে এই তিনটা বিষয় অত্যন্ত প্রয়োজন। আত্মশুদ্ধির পথে চলার জন্য আত্মসমালোচনা এবং আত্মজিজ্ঞাসা করতে হবে। এই তিনটা বিষয়ের উপর ভিত্তি করে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের শক্তিসমূহের সমঝোতা এবং ঐক্যমতে আসতে হবে।

রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী তাদের বক্তৃতায় মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন। বর্তমান সময়ে মৌলবাদ কেন একটি প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়ে গেল, সেই বিষয়ে আমাদেরকে আত্ম অনুসন্ধান করতে হবে। তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণ, মোশতাকের শক্তি বাড়ানো, স্বাধীনতার দু'বছরের মাথায় তাজউদ্দীনের বিতাড়িত হওয়া, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা হওয়া পর্যন্ত, কারা ভিতর থেকে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে সেসব বিষয় পুনর্মূল্যায়ন হওয়া দরকার। পুনর্মূল্যায়নের পর সেখান থেকে আমাদেরকে আত্মশুদ্ধির পথে যাওয়া দরকার।

আমি আগেই বলেছি, মোশতাক, জিয়া, এরশাদ পাকিস্তানের পথে হাঁটল, সাম্প্রদায়িক শক্তি জামাত এবং যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করলো, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে আইন করলো। এরশাদ পতনের মধ্য দিয়ে পুনরায় যে অবাধ গণতন্ত্র এবং অবাধ নির্বাচনের অধিকার, সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠার পথ প্রস্তুত হয়েছিল, সেই পথ আমরা ধরে রাখতে পেরেছি কিনা সেটাও আজকে পুনর্মূল্যায়ন হওয়া দরকার। কারণ জন বিহীন নির্বাচন কেউ প্রত্যাশা করে না। এটা প্রকৃত নির্বাচনও হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই রকম একটা ব্যবস্থা বর্তমান বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনিক নির্বাচন এবং কর্তৃত্ববাদী একটি শাসনব্যবস্থা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ফলাফল হতে পারেনা। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে সাফল্য, সংসদীয় গণতন্ত্রে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠা, সেই জায়গাটা আবার প্রস্তুত করতে হবে। অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থাও করতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের মত প্রশংসনীয় কাজ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী করতে পেরেছে। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে উগ্র-সাম্প্রদায়িক হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে অনুরোধ করবো।

তিনি আরও বলেন, তারা যে আজকে হুংকার দিচ্ছে জাতির পিতার ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে, তারা যে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, সেই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোর এক হতে হবে। একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে কোন রূপ গাঁটছড়া, কোন রূপ আপোষ, কোন রকম সমঝোতা হবে আত্মঘাতী। এই আত্মঘাতী পথ আমাদেরকে পরিত্যাগ করতে হবে।

আমি নিজেও এই অপরাধে অপরাধী কারণ আমরা সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে পারিনি। এটা করতে পারলে অতীতে আমরা তাজউদ্দীনকে এভাবে হারাতাম না, মোস্তাকের ষড়যন্ত্র সফল হতে দিতাম না, বঙ্গবন্ধুকেও হারাতাম না। মোশতাক, জিয়া, এরশাদ পাকিস্তানের যে ধারাটা এনেছিল, যে ধারায় পা পিছলে পড়ার সম্ভাবনা এখন আমাদের পদে-পদে হচ্ছে, দেশ সেই অবস্থায় যেত না।

প্রধানমন্ত্রী যে আহ্বান জানিয়েছেন, সেই আহবানে আমিও সাড়া দিয়ে বলতে চাই, মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে সমঝোতা, পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য টেনে-হিঁচড়ে নামানোর যে হুংকার, সেই হুংকার চিরতরে বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শক্তিগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে আবার জাতীয় জাগরণ ঘটবে। মুক্তিযুদ্ধের শক্তি অপরাজেয়। এখনো মুক্তিযুদ্ধের সেই শক্তি এবং পরিবারগুলো রয়ে গেছে, তারা তখনই সোচ্চার হবে যখন তারা দেখবে অবাধ এবং প্রকৃত নির্বাচন হচ্ছে। সেখানে কারো বিশেষ আনুকূল্য নিয়ে রাতের বেলা নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রয়োজন হবে না। জনগণের সমর্থনে এবং জনগণকে সাথে নিয়ে যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিচল থাকা যায়, তাহলে মানুষ আবারও ঘুরে দাঁড়াবে, বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে, মুক্তিযুদ্ধের ধারা ঘুরে দাঁড়াবে। একই সঙ্গে মৌলবাদী ধারাও তখন পিছু হটবে।  

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০২০
আরকেআর/কেএআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।