পাবনা (ঈশ্বরদী): ‘দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা। পরিবারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী।
হতাশার সুরে কথাগুলো বাংলানিউজের কাছে বলছিলেন মিশন কুমার নামে এক তরুণ। ১৯ বছর বয়সী এই তরুণ ঈশ্বরদী বাইপাস রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই নাটোরের লালপুর উপজেলার দহরশৈলা গ্রামের পাটিকাবাড়ি এলাকার অনিল পালের বড় ছেলে। দুই ভাই বোনের মধ্যে মিশন বড়। মিশনের বাবা ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়নের আরামবাড়িয়া বাজারে সেলুনে চুল-দাড়ি কাটেন।
বর্তমানে মিশনের বন্ধুরা নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অপরদিকে, মিশন তার বাবার সেলুনে চুল কাটার কাজ করে পরিবারকে সহায়তা করছেন। অথচ উচ্চ মাধ্যমিকে পাস করার পর তার কেউ খোঁজই রাখেনি। মিশনের শুধু এখন একটিই ইচ্ছে- ‘যেকোনো সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা পাশাপাশি পরিবারকে ভালো রাখা। ’
মিশন বাংলানিউজকে জানায়, মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। চুল-দাড়ি কাটার আয়ে চলে সংসার সঙ্গে পড়াশোনা। সংসারে এখন আমি আর মা-বাবা। অল্পদিন হলো ছোট বোনটার বিয়ে হয়ে গেছে। যখন ঈশ্বরদী বাইপাস রেলওয়ে স্টেশনের নাটোরের লালপুর উপজেলার দহরশৈলা পাটিকাবাড়ি বেলায়েত খাঁন উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে মানবিক বিভাগে পড়ি তখন রেল স্টেশনের পাশে মিলনের দোকানে দাঁড়িয়ে দাড়ি কাটা, চুল কাটা শিখি। পড়াশোনার খরচ যোগাতে পরে লুকিয়ে বাবার পেশাটি শেষমেশ শিখে ফেলি।
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক ভদ্রলোকের দাড়ি কামিয়ে মাত্র ২০ টাকা আয় করেছিলাম। তারপর টিফিনের ফাঁকে, স্কুল ছুটির পর এক-দুইটা চুল দাড়ি কামানোর কাজ করে নিজের টিফিন খরচ, বইখাতা কেনার যে খরচ, তা যোগাড় করতাম। ক্লাসে নিয়মিত থাকতে পারতাম না বলে বৃত্তি পাইনি। তখনও আমাকে কাজ করতে হয়েছে। তবুও পড়াশুনা ছাড়িনি। মাধ্যমিকে তেমন ভালো ফলাফল হয়নি। ২০১৮ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ৩.৬৪ পাই। এরপর ঈশ্বরদী সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়। ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক শাখায় রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের অন্তর্গত পাবনার ঈশ্বরদীর সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি।
মিশন আরও জানায়, ভার্সিটিতে পড়ানোর সামর্থ্য আমার বাবার নেই। দোকান ভাড়া পরিবারের খরচ একা বাবার পক্ষে তা জোগাড় করা সম্ভব না। কলেজে অনলাইনে আবেদন করার সময় আর কয়েকদিন বাকি। তাই প্রস্তুতি নিচ্ছি ঈশ্বরদী কলেজ কিংবা পাবনায় যদি ভর্তি হয়ে অনার্সটা যাতে কষ্ট করে শেষ করতে পারি।
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে মিশন জানান, আমি লেখাপড়াটা করবই, যেন আমার ভবিষ্যৎ সুন্দর হয়। পরিবারকে আমি সহযোগিতা করতে পারি। আর কাজ করেই পড়ালেখা করতে হবে, আমি কোনো কাজকেই ছোট করে দেখিনা।
মিশনের বাবা অরুন পাল বাংলানিউজকে জানান, আমাদের আগ্রহের চেয়ে মিশনের পড়াশোনা করার আগ্রহ বেশি। আমি যে কাজ করি তা দিয়ে প্রতিমাসে দোকানভাড়া গুনতেই হয় ১৫শ’ টাকা। রোজগার কম। তবে মিশন চাই লেখাপড়া করতে। কিন্তু আমার সামর্থ্য নেই ওকে পড়ানোর।
গ্রামের সহজ সরল ছেলে মিশন কুমার। ছেলেটির স্বপ্নই পড়াশোনা করে নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। তবে সেই স্বপ্ন কী পূরণ হওয়ার নয়? নাকি এখানেই থমকে যাবে তার পড়াশোনা?
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২১
এনটি