ঢাকা, বুধবার, ৮ মাঘ ১৪৩১, ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

দক্ষিণখানে জাপানি হান্নানের অস্ত্রের ঝনঝনানি

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২১
দক্ষিণখানে জাপানি হান্নানের অস্ত্রের ঝনঝনানি

ঢাকা: রাজধানীর দক্ষিণখান থানাধীন আইনুসবাগ (চাঁদনগর) এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম হান্নান। অতীতে তিনি জাপানে গিয়েছিলেন।

এলাকায় দুই কাঠা জমির ওপর তার একটি বাড়ি, নাম ‘জাপানি কটেজ’। এছাড়াও নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে জানান দিতে বাড়ির সামনে লাগিয়েছেন ছবিসহ বিভিন্ন সাইনবোর্ড। দক্ষিণখানে সবাই তাকে জাপানি হান্নান অথবা সাইনবোর্ড হান্নান নামে বেশি চেনেন। এলাকায় তিনি দাপট দেখিয়ে চলাফেলা করেন। জাপানি হান্নানের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে অনেকটাই ভীত এলাকার বাসিন্দারা।

বুধবার (২৪ মার্চ) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দক্ষিণখানের আইনুসবাগ (চাঁদনগর) এলাকার বালি ফেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে আব্দুর রশিদ (৩৮) নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেন জাপানি হান্নান। এতে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে জাপানি হান্নানের গাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল পুলিশ সদস্যরা। এরপর জাপানি হান্নানের বাড়ি জাপানি কটেজ থেকে অস্ত্রধারী হান্নানসহ সাত জনকে গ্রেফতার করে দক্ষিণখান থানা পুলিশ।

এদিকে ঘটনাস্থল থেকে নিহত আব্দুর রশিদের মরদেহ উদ্ধার করে প্রথমে দক্ষিণখানের কেসি হাসপাতাল এবং পরে সেখান থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায় পুলিশ। পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় আসামি হান্নান ওরফে জাপানি হান্নানসহ তার ছয় সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি শর্টগান ও একটি পিস্তল জব্দ করা হয়েছে। অস্ত্র দুটিই হান্নানের লাইসেন্স করা। পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করছে।

নিহত রশিদ থাকতেন রাজধানীর আশকোনার পানির পাম্পের পাশে ৪৩৪ নম্বর নিজ বাড়িতে। তার স্ত্রী, দুই সন্তান (এক ছেলে ও এক মেয়ে) রয়েছে। আগে তিনি গার্মেন্টস এক্সেসরিজের (অ্যাম্বোডারির) কারখানা পরিচালনা করতেন। সেটি বন্ধ করে তিনি বর্তমানে তার বাড়ি ও মার্কেট দেখাশুনা করেন।
 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় বাসিন্দা মোজাম্মেল পাটোয়ারি বাংলানিউজকে বলেন, বেশ কয়েকজন লোক জাপানি হান্নানের বাড়ির সামনে পৌঁছালে ভবনের গ্যারেজ থেকে হান্নান তার শর্টগান দিয়ে প্রথমে একটি গুলি করেন। গুলিটি রশিদের মাথায় লাগে। এরপর আরও একটি গুলি ছুড়েন সেটি তার বুকে লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় রশিদ মাটিতে পড়ে যান। এলাকার সবার সামনে হান্নান গুলি করে রশিদকে হত্যা করেছেন।
 
দক্ষিণখান এলাকার স্থানীয়দের অভিযোগ, জাপানি হান্নানের অত্যাচারে দক্ষিণখান এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। তিনি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে এতদিন মানুষের ওপর অত্যাচার করে করে আসছিলেন। এবার মানুষ হত্যা করেছেন। আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাই। রাজনৈতিকভাবে কোনো পরিচয় ও পদবী না থাকলেও সবখানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে চলতেন জাপানি হান্নান। জাতির পিতা, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর‌্যায়ের নেতাদের ছবির সঙ্গে নিজের ছবিটি জুড়ে দিয়ে বাড়ির সামনে একটি সাইনবোর্ডে ঝুলিয়ে রেখেছেন। লাইসেন্স করা একটি শর্টগান ও একটি পিস্তল ও কয়েকজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে দানবের মতো ঘোরাঘুরি করতেন এলাকায়। পান থেকে চুন খসলেই সঙ্গে থাকা অস্ত্র বের করে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখানো ছিল জাপানি হান্নানের নিত্যদিনের কাজ। শুধু তাই নয়, এলাকায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদকের কারবারসহ নানা অপকর্মেই সরাসরি জড়িত জাপানি হান্নান।

অপকর্মের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এলাকায় নিজের আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করেন জাপানি হান্নান। নিজ জেলা চাঁদপুরের সঙ্গে মিল রেখে দক্ষিণখানের আইনুসবাগ এলাকার নাম পরিবর্তন করে চাঁদনগর নামকরণ করেন তিনি। কেউ এই নাম না লিখলে বা ব্যবহার না করলে হুমকি-ধামকি দিতেন তিনি। আইনুসবাগ (চাঁদনগর) এলাকায় জমি কেনা, বাড়ি, দোকান নির্মাণ ও বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ নিতে গেলে সেখানে চাঁদা দাবি করতেন জাপানি হান্নান। চাঁদা না দিলে তার সাঙ্গোপাঙ্গো দিয়ে বাধা দেওয়াসহ মারধর ও অস্ত্র দেখিয়ে হত্যার হুমকি দিতেন হান্নান।  

যা ঘটে ছিল:
ভুক্তভোগী নিহত আব্দুর রশিদের চাচাতো ভাই মাহমুদুল হাসান সুজন বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণখান আইনুসবাগ এলাকায় জাপানি হান্নানের বাড়ি থেকে তিন’শ গজ দূরে আমাদের জমিতে গত এক সপ্তাহ ধরে বাউন্ডারি ওয়ালের কাজ চলছে। সেখানে বালু ফেলা হয়। এ বালু ফেলাকে কেন্দ্র করে জাপানি হান্নান এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। আমরা দিতে রাজি হইনি। এ কারণে আমাদের জায়গা থেকে বালু চুরি করে সরিয়ে নেন জাপানি হান্নানসহ তার লোকজন। এছাড়া বুধবার (২৪ মার্চ) সকালে আমার ভাই ও শ্রমিকদের মারধর করে হান্নান বাহিনীর লোকজন।
কেন মারধর করলো? এ বিষয়ে সুজন বলেন, আমার চাচা হাজী সাত্তার, চাচাতো ভাই আব্দুর রশিদ, সোহেল ও আমিসহ হান্নানের কাছে মারধরের বিষয়টি জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিলাম। এ সময় ঘটনাস্থলে প্রশাসনের লোকজনও (পুলিশ) ছিল। আমরা যখন হান্নানের বাড়ির সামনে যাই, তখন জাপানি হান্নান তার শর্টগান বের করে বাড়ির গেটের ভেতর থেকে আমার চাচাতো ভাই সোহেল ও আব্দুর রশিদকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এতে সোহেল সরে গেলেও রশিদের মাথায় গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে রশিদ ভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমরা ভাইকে ধরতে যাবো, এমন সময় হান্নান আরও গুলি ছোড়েন। এ সময় ঘটনাস্থলেই আমার চাচাতো ভাই রশিদ মারা যান।

এরপর স্থানীয়রা ও আমরা হান্নানসহ তার বাহিনীর লোকজনকে ঘিরে ফেলি। যাতে তারা পলাতে না পারে। পরে পুলিশ তাদের আটক করে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের দক্ষিণখান জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হাফিজুর রহমান রিয়েল বাংলানিউজকে বলেন, বালু ফেলাকে কেন্দ্র করে এক লাখ টাকা নাকি চাঁদা চেয়েছিলেন হান্নান। আর সেই টাকা না দেওয়ায় বালু চুরি হয়। বুধবার বালু চুরির বিষয়ে কথা বলতে ঠিকাদার ও তার ভাই এবং চাচা হান্নানের বাড়ির সামনে এসেছিলেন। কথা বলার এক পর্যায়ে শর্টগান দিয়ে গুলি করেন হান্নান। এতে রশিদ নামে একজনের মৃত্যু হয়।

আমরা হান্নানের সম্পর্কে নানা অভিযোগ পাচ্ছি। তার বিরুদ্ধে পাওয়া সব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়াও হত্যার ঘটনায় পুলিশ তদন্ত করছে বলেও জানান এডিসি হাফিজুর।

বুধবার ঘটনাস্থলে সরেজমিনে দেখা যায়, দক্ষিণখান থানাধীন আইনুসবাগ (চাঁদনগর) এলাকায় অবস্থিত জাপানি কটেজ। ছয় তলা বিশিষ্ট ভবনের সামনে রয়েছে হান্নানের গাড়ির ধ্বংসাবশেষ। এর সামনে পরে ছিল নিহত রশিদের রক্ত। এছাড়াও ভবনের সামনে তিনটি সাইবোর্ড দেখা গেছে। এদিকে ঘটনার পর থেকে ভবনের দুই পাশে অসংখ্য লোক জড়ো হতে দেখা গেছে। এছাড়া ঘটনাস্থলে পুলিশের সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে।

হান্নান থেকে জাপানি হান্নান ও সাইনবোর্ড হান্নান:
স্থানীয়রা জানায়, দক্ষিণখান এলাকায় একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে রেষারেষির কারণে ১৯৯৫-৯৬ সালে দেশ থেকে পালিয়ে জাপানে পারি জমায় হান্নান। সেখানে থেকেও বছরে কয়েকবার দেশে এসে ঘুরে গেছেন তিনি। তবে বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৪ সালে দেশে ফেরেন তিনি। এরপর বাড়ি নির্মাণ করেন। নাম দেন জাপানি কটেজ। সেই থেকে এলাকায় সবাই তাকে জাপানি হান্নান বলে চেনেন। এছাড়া ওই এলাকায় যেসব কমিটি বা সংগঠন হোক না কেন জোরপূর্বক সেসব কমিটিতে তিনি স্ব-ঘোষিত সভাপতি হিসেবে পদ নিয়ে নেন। সেটা মসজিদ কমিটি হোক আর এলাকার কোনো সংগঠনেরই হোক। এদিকে তিনি রাজনৈতিক দলের নেতা পরিচয় দিয়েও অপকর্ম করতেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে ছবি দিয়ে বিভিন্ন পোস্টার, ব্যানার ও সাইনবোর্ড তৈরি করে এলাকার বিভিন্ন স্থানে ঝুলিয়ে দিতেন। এ থেকে তার নামকরণ হয় সাইনবোর্ড হান্নান।
 

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক রানা জানান, আমিনুল ইসলাম হান্নান নামে আমাদের সংগঠনে কোনো পোস্টধারী নেতা নেই।
 
দক্ষিণখানের আইনুসবাগের নাম কীভাবে চাঁদনগর হলো?

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জাপানি হান্নানের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চাদপুরের মতলবে। তার বাবা এখানে এসে জমি কিনেছিলেন অনেক আগে। এরপর জাপান থেকে ফিরে এসে হান্নান আরও দুই কাঠা জমি কিনেন। পরে এখানে বাড়ি নির্মাণ করেন। বাড়ির নাম দেন জাপানি কটেজ। নিজের লাইসেন্স করা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে এবং নিজেই এলাকার নাম পরিবর্তন করেন। যদিও কাগজে কলমে এখনও এখানকার নাম রয়েছে আইনুসবাগ। কিন্তু হান্নান তার নিজ জেলা চাঁদপুরের সঙ্গে মিল রেখে এলাকার নামকরণ করেন চাঁদনগর। অস্ত্রের ভয় ও তার বাহিনীর ভয় দেখিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের এ নাম ব্যবহারে বাধ্য করেন হান্নান। এবিষয়ে বিমানবন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সোহেল তার সঙ্গে কথা বলেছিলো। কিন্তু এবিষয়ে হান্নান বলেছেন আমি সরকার, আমি এ এলাকার প্রতিনিধি। চাঁদনগর নাম আমি দিয়েছি। এ নামই থাকবে। এবিষয়ে নিয়ে সোহেলের সঙ্গে জাপানি হান্নানের কিছুটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।  

জাপানি হান্নানের ক্ষমতার উৎস কোথায়?
স্থানীয় ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক কোনো পরিচয় না থাকলেও ক্ষমতাধর সব নেতাদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলতেন, পরিচয় হতেন, এরপর তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। সেই ছবিগুলো এমনভাবেই প্রচার করতেন যেন দেখে মনে হবে তাদের সঙ্গে খুব সখ্যতা রয়েছে তার। এছাড়া বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের এক নেতার সঙ্গেও অংশীদারি ব্যবসায় জড়িত রয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। প্রয়াত স্থানীয় সংসদ সদস্য সাহারা খাতুনের নাম ভাঙিয়েও নানা অপকর্ম করতেন এ জাপানি হান্নান। এছাড়াও তার ক্ষমতার প্রধান উৎস হলো জাপানি হান্নানের লাইসেন্স করা দুটি অস্ত্র সব সময় তার সঙ্গেই থাকতো। এ অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন সময় স্থানীয় লোকজনদের নাজেহাল করতেন তিনি। এছাড়াও নিজের সাঙ্গোপাঙ্গো দিয়ে এলাকায় মাদকের কারবারও করতেন তিনি।

জাপানি হান্নানের বাড়ির পূর্ব পাশের বাসিন্দা মোজাম্মেল পাটোয়ারী অভিযোগ করে বলেন,  জাপানি হান্নানের নির্যাতনের শিকার হয়েছে অনেকেই।  

তিনি বলেন, ১০ মাস আগে আমার বাড়ির সামনে দোকান করতে চেয়েছিলাম। এরজন্য হান্নান আমার কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। আমি এখন পর্যন্ত দোকান করতে পারিনি। হান্নান আমার বাড়ির ভাড়াটিয়াদেরও থাকতে দেননি। বাড়ির গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের লাইন সব কেটে দিছেন। পানি তোলার মটরও খুলে নিয়ে গেছেন। এ বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিপি) করেছি। র‌্যাব-১ এর অভিযোগ দিয়েছি। কিছুই হয়নি।

তিনি আরও বলেন, অভিযোগ দেওয়ার কারণে হান্নান এসে আমাকে মারতে মারতে রাস্তায় ফেলছে দিয়েছেন। তিনি সব সময় সঙ্গে পিস্তল নিয়ে ঘুরতেন। বিভিন্ন এমপি, মন্ত্রীর ছবি দেখিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাতেন। যে কারণে এলাকার কেউ কিছু বলতে সাহস পেতো না।

বাংলাদেশ সময়: ০২০৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২১
এসজেএ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।