ঢাকা: শিশু আরিয়ানের বয়স চার বছর। একটু কিছু হলেই বাবা-মাকে খোঁজে সে।
দোকানের মজা খেতে (চকলেট, রুটি, বিস্কুট) ইচ্ছে হলেই নানা-নানির কাছে আরিয়ানের আকুতি, ও নানা বাবা কই, মা কই। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বাবা-মাকে খুঁজে বেড়ায় আরিয়ান। তখন নানা-নানির মিছে আশ্বাস, বাবা-মা কাজে গেছে, কাজ শেষ হলেই আসবে তুমি ঘুমাও। অবুঝ শিশু আরিয়ান ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
শিশু আরিয়ানের নানা আশরাফ আলী বাংলানিউজকে এমনটাই জানিয়েছেন। আজহারুল-আছমা আক্তার দম্পতির একমাত্র সন্তান চার বছর বয়সী শিশু আরিয়ান। বাবা আজহারুলকে হত্যার দায়ে মা আছমা আক্তার কারাগারে। মা জীবিত থাকলেও আরিয়ান প্রায় এতিম। যখন মা-বাবার আদর সোহাগ আরিয়ানের খুব প্রয়োজন ঠিক এ সময় মায়ের একটি ভুলে নিষ্পাপ শিশু আরিয়ানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ঘোর অমানিশায় ঢেকে গেছে।
সোমবার (৩১ মে) শিশু আরিয়ানের নানা আশরাফ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ঈদের ছুটিতে আজহারুল ও আছমা সন্তানকে নিয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার রাজাবাড়ি গ্রামে (আহজারুলের বাড়িতে) চলে যায়। হত্যাকাণ্ডের পরও ওরা সেখানেই ছিলো। যখন র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে আজহারুলের হত্যার বিষয়ে জানায় তখনও সবাই টাঙ্গাইল থেকে ছুটে র্যাব সদর দফতরে চলে যাই। সেখানে স্বামী হত্যার দায়ে আছমাকে গ্রেফতার করা হলে ওই সময় আজহারুলের স্বজনরা আরিয়ানকে নিতে চায়নি। পরে আমরা আরিয়ানকে সঙ্গে করে নিয়ে আসি।
তিনি বলেন, আরিয়ান ‘খালি (শুধু) মা-বাবারে খোঁজে। কি কমু, খালি সান্ত্বনা দেই তোমার বাবা-মা কাজে গেছে। তারা কাজ শেষ হলে আসবে। তুমি খেলা করো। যখন কিছুতেই মানতে চায় না। তখন দোকান থেকে মজা কিনা দেই, খেলনা কিনা দেই। কিন্তু আরিয়ানকে এখনও কিছুই জানানো হয় নাই।
সারাদিন আমার ছোট দুই সন্তানের (ছেলে- হাসান ও মেয়ে- শারমিনের) সঙ্গে খেলা করে। কিন্তু রাতে ঘুমাইতে গেলেই ও (আরিয়ান) মা-বাবারে খুঁজে। কানতে কানতে (কান্না) এক সময় ঘুমাইয়া যায়। এভাবেই চলছে। নাতির কান্না দেখলে মনে শান্তি থাকে না। বাবা বাইচ্চা নাই, মাও জেলে, অবুঝ এই শিশুকে আমরা না দেখলে কই যাবে ও (আরিয়ান)’- যোগ করেন তিনি।
মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে প্রচুর দুর্গন্ধ ছড়ানোর তথ্যের ভিত্তিতে গত ২৫ মে সকালে রাজধানীর দক্ষিণখানের সরদার পাড়ার সরদার বাড়ি জামে মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে গার্মেন্টস কর্মী আজহারুলের মরদেহের অর্ধগলিত ৬ টুকরো উদ্ধার করে পুলিশ। পরকীয়া সম্পর্কের জেরেই এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান (৫৪) ও নিহতের স্ত্রী আছমা আক্তার (২৪)। গত ৫ মাস ধরেই আছমার সঙ্গে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমানের পরকীয়া সম্পর্ক চলছিলো।
এর আগে, এ বছর রমজান মাসে ঈদের আগের দিন টাঙ্গাইলের কালিহাতী আজহারুলের গ্রামের বাড়ি চলে যান তারা। ছুটি শেষে গত ১৮ মে জোরপূর্বক আজহারুলকে ঢাকা পাঠায় তার স্ত্রী আছমা। পরদিন ১৯ মে ইমাম আজহারুলকে ফোন করে মসজিদে আসতে বলেন। ওইদিন কাজ শেষে গার্মেন্টস থেকে সরাসরি ইমামের সঙ্গে দেখা করতে মসজিদে যায় আজহারুল। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইমাম আব্দুর রহমান মসজিদে তার নিজ কক্ষে কোরবানির পশু জবাইয়ের ছুরি দিয়ে আজহারুলকে আঘাত করেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে আজহারুল মসজিদের সিঁড়িতে পড়ে গেলে তার গলার ডান দিকে ওই ছুরি দিয়ে একাধিক আঘাত করেন ইমাম। মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে মরদেহ কক্ষের ভেতরে নিয়ে এসে ছুরি-চাপাতি দিয়ে ৬ খণ্ড করেন ঘাতক ইমাম। এরপর গুম করতে তার মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেয় এবং ট্যাংকের মুখটি সিমেন্টের বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখে।
এদিকে আজহারুল হতাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া আসামি দক্ষিণখানের সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান (৫৪) ও নিহতের স্ত্রী আছমা আক্তার হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেফতার হওয়া দুই আসামিকে ৪দিন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পর রোববার (৩০ মে) বিকেলে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের পৃথক দুই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আছমা ও আব্দুর রহমান। আদালত তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল হক মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, গার্মেন্টস কর্মী আজহারুলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর মরদেহ গুম করতেই ছয় টুকরা করে সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন গ্রেফতার দুই আসামি।
তিনি বলেন, নিহতের স্ত্রী আছমা আক্তার ও মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমানের মধ্যে পরকীয়া সম্পর্ক ছিল। যার কারণেই তারা আজহারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
নিহত আজহারুল টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার রাজাবাড়ি গ্রামের জুলহাস উদ্দিনের ছেলে। তার মা সালেহা বেগম। পরিবারের পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে আজহারুল ছিলো আদরের সন্তান।
নিহতের বাবা জুলহাস উদ্দিন জানান, আছমা আমাদের বাড়িতে থেকেই ওই ইমামের সঙ্গে কথা বলে পরিকল্পিতভাবে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে ওর মা ভেঙে পড়েছে। আমি আছমা ও ওই মসজিদের ইমামের ফাঁসির দাবি জানাই।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আজহারুলের মেজো ভাই সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে আছমার বিয়ে হয়। বিয়ের দু-তিন মাস পর তারা জানতে পারেন এর আগেও টাঙ্গাইলের দুর্গাপুর ইউনিয়নে এক ছেলের সঙ্গে আছমার বিয়ে হয়েছিল। ওই বিয়ে দুই দিন টিকে ছিলো। এরপর আরেকজনের সঙ্গে পরকীয়া প্রেম করে বিয়ে করেন। সেটিও টেকেনি। এরপর আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়। এর বছর খানেকের মধ্যেই আছমা ও আজহারুল বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর সাহাবুদ্দিনকে তালাক দিয়ে আজহারুলকে বিয়ে করেন আছমা।
আরো পড়ুন>
** ইমামের আগেও ২ পরকীয়া, আজহারের আগে ৩ বিয়ে ছিল আসমার!
** স্বামীকে হত্যার আগে মোবাইলে ৭১ বার ইমামের সঙ্গে কথা বলেন আসমা!
**সাত টুকরা মরদেহের দাফন সম্পন্ন
**নিজ শয়ন কক্ষেই আজাহারকে ৬ খণ্ড করেন ঘাতক ইমাম
**সেপটিক ট্যাংক থেকে খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার, স্ত্রীই হত্যার পরিকল্পনাকারী
** স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনায় আছমাকে ফোন কিনে দেন ইমাম
** স্ত্রীর দিকে ‘কু-নজর’, বাগ-বিতণ্ডার জেরে হত্যা
** পরকীয়ার জেরে খুন করে লাশ সাত টুকরো
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২১
এসজেএ/আরএ