মাগুরা: মুসলীম রেঁনেসা যুগের কবি ফররুখ আহমেদ। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে জন্ম ভিটা।
ব্রিটিশ আমলে তৈরি কাঠের বাড়িটি এখন নতুন প্রজন্মের কাছে ঐতিহ্যের স্বাক্ষর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাঠের তৈরি ঘরের দরজায় পড়েছে লাল কালির একটি তীর চিহ্ন। কবির কাঠের তৈরি ঘরের পাশে রয়েছে পাকা ভবন। ভবনের সিঁড়ির গায়ে ইংরেজিতে লেখা আছে কয়েকটি সংখ্যা।
সম্প্রতি মধুখালী থেকে মাগুরা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে কবি ফররুখ আহমদের বাড়ির উপর দিয়ে নকশা করায় সাধারণ মানুষ ও কবি পরিবারের সদস্যদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
কবি পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরিদপুর জেলার মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা শহর পর্যন্ত নতুন রেললাইন প্রকল্পের যে কাজ শুরু হয়েছে বাড়ির পাশে লাল নিশান ও লাল কালিতে লেখা তারই অংশ।
গত ২৭ মে রামনগর হরিপদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভার্চ্যুয়ালি এই প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক হাজার ২০২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের বিদ্যমান রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে মাগুরা জেলা। নকশা অনুযায়ী মাগুরা জেলার এই অংশে রেললাইন যাবে কবি ফররুখ আহমদের বসত ভিটার উপর দিয়ে।
সবুজ আর প্রকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মাঝাইল গ্রাম। গড়াই নদীর নির্মল বাতাস কবিপ্রেমিদের কাছে অতুলনীয়।
মুসলিম রেঁনেসার কবি হিসেবে পরিচিত ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মধুমতী নদীর তীর ঘেঁষা এই গ্রামেই কবির পূর্ব পুরুষদের আদিবাস। রেললাইন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে যাওয়ায় কবির স্মৃতি বিজড়িত বসতবাড়ি রক্ষানিয়ে তাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং স্থানীয় প্রশাসন অবশ্য জানিয়েছে কবির বাড়ি অক্ষত রেখেই স্থাপন করা হবে নতুন রেললাইন।
শনিবার সরেজমিন শ্রীপুর উপজেলা মাঝইল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের বিভিন্ন স্থানে লাল নিশান দিয়ে ঘেরা। কোথাও আবার ইংরেজি অক্ষরে লেখা। কবি ফররুখ আহমদের বাড়িতে তিন পাশে পড়েছে তিনটি লাল নিশান।
এলাকাবাসীর দাবি কবির বাবা খান বাহাদুর সৈয়দ হাতেম আলী ও মা বেগম রওশন আক্তারের কবর। কবির স্মৃতি যেন সরকারিভাবে রক্ষা করা হয়।
কবির ভাইয়ের মেয়ে সৈয়দা দিলরুবা বাংলানিউজকে বলেন, জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে আবেদন করেছি। যেখানে কবির বাড়ি পাশ কাটিয়ে অন্য জায়গা দিয়ে রেললাইন স্থাপনের দাবি করেন তিনি। তা না হলে কবির স্মৃতি বিজড়িত ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এলাকাবাসী বাটুল শেখ জানান, ছোটবেলা থেকে কবির নাম শুনে আসছি। কোনোদিন দেখিনি তারে। তবে তার কবিতা পড়েছি। তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তার কবিতা আমরা শ্রেণি পাঠে পড়েছি। এখনও তার কবিতা পড়ি। এই গুণি মানুষের স্মৃতি চিহ্ন রক্ষা দাবি জানান তিনি।
কবির ভাইয়ের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে প্রায়ই দর্শনার্থীরা আসে কবির বাড়ি দেখতে। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ কবির বাড়ি অক্ষত রেখে রেললাইন নির্মাণ করার।
কবি ফররুখ আহমদের নাতি মো. আকিদুল শেখ বাংলানিউজকে বলেন, কবির বাড়িতে ঘিরে রয়েছে ঐতিহ্যের চিহ্ন। এখানে প্রতিটি স্থানে কবির স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। তিনি বিকল্প উপায়ে রেললাইন নির্মাণের দাবি করেন।
কবির ছেলে সৈয়দ মো. ওয়াহিদুজ্জামান মোবাইল ফোনে বাংলানিউজকে বলেন, এটি মাগুরার একটি ঐতিহাসিক বাড়ি। যেখানে অনেক গুণি মানুষের আগমন ঘটেছে। ফলে সেখানকার প্রতিটি স্থাপনার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। রেললাইন মাগুরার মানুষের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ওই বাড়িটি রক্ষা করাও জরুরি। ফলে সরকারের কাছে আমাদের দাবি হচ্ছে কবির স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি রক্ষা করে রেললাইন স্থাপন করা হোক। একই সঙ্গে ওই এলাকায় কবির নামে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানাই।
মাগুরার জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘রেললাইন স্থাপনের নকশা তৈরির সময় বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। আমরা দেখতে পাই রেললাইনের জন্য যে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে তার মধ্যে কবি ফররুখ আহমদের বসতভিটা পড়েছে। তখন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে প্রকল্পের নকশা পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কবির বাড়ির স্থাপনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় ওই খানের রেল লাইনের নকশা পরিবর্তন করেছে মন্ত্রণালয়। সেখানে কবির বাড়ির পাশ দিয়ে উড়ালসেতুর মাধ্যমে রেললাইন স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।
মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা শহর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক আসাদুল হক মোবাইল ফোনে বাংলানিউজকে বলেন, ‘রেল লাইনটি যাবে কবির বাড়ির পাশ দিয়ে। কবির বাড়ির স্থাপনা অক্ষুণ্নরাখতে ওই অংশের লাইন যাবে উড়ালসেতু হয়ে। এছাড়া রেললাইন অন্য জায়গা দিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন উঠলে পুরো প্রকল্পের নকশায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হতো। সেক্ষেত্রে পুরো প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ হুমকির মধ্যে পড়তো’।
বাংলাদেশ সময়, ১৬৪৮ ঘণ্টা, ০৬ জুন, ২০২১
আরএ