সিরাজগঞ্জ: বর্ষাকালে নৌকা, শুষ্ক মৌসুমে বাঁশের সাঁকো। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার নলকা ইউনিয়নের ১০/১২টি গ্রামের অন্তত ২৫ হাজার মানুষকে এখনও এ মাধ্যমেই যাতায়াত করতে হচ্ছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে নলকা ইউনিয়নের কেসি ফরিদপুর খেয়াঘাটে দেখা যায় ঘাটের এপার থেকে ওপার একটি শক্ত রশি টানানো হয়েছে। নৌকার উপর উঠে রশি টেনে টেনে পার হচ্ছেন বেশ কয়েকজন যাত্রী। বর্ষা মৌসুমে তারা এভাবেই পার হয়ে থাকেন বলে জানান, শুষ্ক মৌসুমে পার হতে হয় বাঁশের সাঁকোয়।
কথা হয়, পূর্ব ফরিদপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ জহির উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা যহন যুবক আছিলাম, তহন থেইকাই হুনতাছি ব্রিজ অইবো। কিন্ত অয় না। নেতারা খালি ভোটের সময় আইস্যা ব্রিজের কতা হয়। ভোট ফুরাইয়্যা গেলে আর আইসে না।
কেসি ফরিদপুরের শহীদুল ইসলাম বলেন, বাপ-দাদার জীবন তো গেছেই। আমাগোর জীবনও কাইট্যা গেল বাঁশের সাঁকো আর নৌকায় নদী পার অইয়্যা। ছওয়ালপালেরাও এই ঘাটে বিরিজ দেইখতে পাইরবো কিনা হেইডাও কওয়া যায় না।
একই গ্রামের রফিকুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, রোজিনা খাতুন, কল্পনা খাতুন, কেসি ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফুল ইসলাম, তানভীর ও মনিরুল ইসলাম এবং কাঁঠালবাড়ীয়া গ্রামের হাবিবুর রহমানসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে তাদের নানা দুর্ভোগের কথা উঠে আসে।
তারা বলেন, দেশ উন্নত হয়েছে। বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সুন্দর সুন্দর রাস্তা-ঘাট ও সেতু হয়েছে। কিন্তু এই অঞ্চলে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়াই লাগেনি। আমাদের যেকোনো স্থানে যাতায়াতের জন্য দুটি পথ। একটি ফুলজোড় নদী পার হতে হয়, অপরটি প্রায় ৪ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা মাড়িয়ে পাকায় উঠতে হয়। এমন দুর্গম অঞ্চল আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্কুল শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- ফুলজোড় ও ইছামতি নদী বেষ্টিত ইউনিয়ন নলকা। এই ইউনিয়নের কেসি ফরিদপুর, চর ফরিদপুর, পূর্ব ফরিদপুর, কাঁঠালবাড়িয়া, বিষ্ণুপুর ও আঙ্গারু গ্রামগুলো ফুলজোড় নদীর পূর্বপারে অবস্থিত। কৃষিপ্রধান এসব গ্রামের মানুষকে শহর, বাজার, স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে ফুলজোড় নদী পারি দিতে হয়। বিকল্প পথ প্রায় ৪ কিলোমিটার দুর্গম কাঁচা সড়ক। শুষ্ক মৌসুমে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল কিংবা ভ্যানগাড়ি চলাচল করলেও বর্ষা মৌসুমে কাঁদাজলে মাখামাখি হয়ে থাকে। যেখানে পায়ে হেঁটে চলাও দুস্কর। তাই বাধ্য হয়ে ফুলজোড় নদী পার হয়েই যাতায়াত করতে হয় এ অঞ্চলের মানুষকে।
এ ছয়টি গ্রাম ছাড়াও নলকা, পাঙ্গাসী ও ঘুড়কা ইউনিয়নের আরও অন্তত ৫/৬ গ্রামের মানুষকে যাতায়াত করতে হয় এই নদী পার হয়েই। কৃষি প্রধান এ অঞ্চলের উৎপাদিত ফসল আনা-নেওয়া করা অত্যন্ত কষ্টকর। যথাসময়ে ফসল হাট-বাজারে না তুলতে পারায় ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত হন কৃষকেরা। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীদের চলাচলের একমাত্র পথে নৌকাই ভরসা। যাতায়াতে প্রায়শই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় মানুষকে। মুমূর্ষু রোগী নিয়ে খেয়াঘাটে এসে নৌকার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মাঝে মাঝে নৌকাডুবির ঘটনাও ঘটে।
যাতায়াতের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য এ অঞ্চলের মানুষ প্রায় দুই যুগ ধরে ফুলজোড় নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের দাবি করে আসছে। কিন্তু দীর্ঘ দুই যুগেও স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না এলাকাবাসীর। প্রতিটা নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিরা সেতু নির্মাণের আশ্বাস দিলেও তা কখনোই বাস্তবায়ন হয় না।
কেসি ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন বলেন, দাদপুর জিআর কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদেরও এ পথে যাতায়াত করতে হয়। এই ঘাটে তাই সেতু নির্মাণ করা জরুরি।
৭ নম্বর নলকা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল জাব্বার সরকার বলেন, নলকা ইউনিয়নটি ফুলজোড় আর ইছামতি নদী বেষ্টিত। কেসি ফরিদপুর ঘাটে সেতু না থাকায় ১০/১২ গ্রামের প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আশা করছি খুব শিগগিরই এখানে সেতু নির্মাণ করা হবে।
এ বিষয়ে রায়গঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বলেন, ওই সেতু নির্মাণের ব্যাপারে প্রস্তাবনা দেওয়া আছে। প্রস্তাবনা পাশ হলেই সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০২১
আরএ