ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

‘যে ঘরে মেয়ে আছে ওই ঘরেই নজর দিতেন নাগিন সোহাগ’

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০২১
‘যে ঘরে মেয়ে আছে ওই ঘরেই নজর দিতেন নাগিন সোহাগ’

ঢাকা: ‘বস্তির যে ঘরের মেয়ে বড় হতে দেখতেন, ওই ঘরের দিকে নজর দিতেন নাগিন সোহাগ। প্রথমে ওই ঘরে গিয়ে খাতির জমাতেন।

ধীরে ধীরে যাওয়া-আসা শুরু করতেন। গল্প-গুজব করে সময় দিতেন, এমন কিছু লোভ দেখানো সহযোগিতাও করতো নাগিন সোহাগ। ভালো বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে, ফুসলিয়ে ওই ঘরের মেয়েকে বের করে নিয়ে যেতেন। এরপর ওই মেয়েকে ভারতের দালালদের কাছে বিক্রি করে দিতেন নাগিন সোহাগ ও তার মামা কাল্লু। ’

‘আমাদের বস্তির অনেক মেয়েকে নাগিন সোহাগ ও কাল্লুর খপ্পরে পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে, আজ পর্যন্ত তাদের কেউই ফিরে আসেননি। বস্তির অনেক মেয়েকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন নাগিন সোহাগ। কিন্তু ওদের পরিবার রাজি না থাকা ওই মেয়েগুলো বেঁচে গেছেন’- এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মিরপুরের পল্লবীর শাহপরাণ বস্তির থেকে ভারতে পাচারের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী এক কিশোরী ও তার মা।

এদিকে ভুক্তভোগী মা বলেন, মেয়েকে উদ্ধার করে ফিরে আসার পর শুনেছি, বস্তির আরও দুই মেয়েকে নাগিন সোহাগ নিয়ে যাবেন। আমি তখন ওই দুই পরিবারের কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলি। এতে ওই দুটি মেয়ে আর যেতে রাজি হয়নি।

তিনি বলেন, বস্তির অনেক মেয়ে নিখোঁজ আছেন। যখন কিশানগঞ্জ থেকে আমার মেয়েকে নিয়ে ফিরছি, ওই পল্লিতে এই বস্তির একটি মেয়েকে দেখেছি। কথা বলতে পারিনি।

এর আগে, গত জানুয়ারি রাজধানীর পল্লবীর শাহপরাণ বস্তির স্বাবলম্বী হতে চাওয়া ১৭ বছর বয়সী এক তরুণীকে বিউটি পার্লারে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করে দেয় মামা-ভাগ্নে পাচারকারী চক্রটি। সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে তরুণীকে নৌকার যোগে পাচারের সময় মাঝির কাছে থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে তার মা’কে কল করে বিষয়টি জানায়।

এরপর কোনো উপায় না দেখে একমাস পর (ফেব্রুয়ারি) ওই মা একাই তার মেয়েকে উদ্ধার করতে পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একই প্রক্রিয়ায় তাকেও ভারতে দালালদের কাছে বিক্রি করে দেন কাল্লু ও নাগিন সোহাগ। ভারতে ঢুকেই কৌশলে ওই মা পালিয়ে যান। এরপর তিনি দিল্লি, কলকাতার অলিগলি চোষে বেড়ান নিখোঁজ মেয়ের খোঁজে। বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও পুলিশের সহায়তায় ভারতের বিহার-কলকাতা সীমান্তের উত্তর দিনাজপুর পাঞ্জিপাড়ার নিষিদ্ধপল্লি থেকে মেয়েকে উদ্ধার করেন তিনি।

মেয়েকে নিয়ে দেশে ফেরার সময় সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কাছে আটক হয় ওই তরুণী ও তার মা। বিএসএফের সদস্যরা সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং একটি পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তাদেরকে বিজিবির সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেন।

গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর আলোড়ন সৃষ্টি হলে গত ১৬ আগস্ট মধ্যরাতে রাজধানীর পল্লবীতে অভিযান চালিয়ে ভারতে নারী পাচারকারী মামা-ভাগিনা চক্রের মূলহোতা কাল্লু ওরফে কালু (৪০) নাগিন সোহাগ ওরফে সোহাগ (৩২) এবং মাদারীপুরের শিবচর এলাকায় থেকে চক্রের ভারতীয় এজেন্ট বিল্লাল হোসেনকে (৪১) গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৪)।  

গ্রেফতার তিন আসামিদের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্লবী থানায় ভুক্তভোগী পরিবার ও র‌্যাব বাদী হয়ে মানবপাচার দমন আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়। আসামি কাল্লু ও নাগিন সোহাগ ও বিল্লাল হোসেন এখন দুইদিনের রিমান্ডে থানা হেফাজতে রয়েছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ। মানবপাচার হওয়ার রুট। পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. পারভেজ ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে মানবপাচার দমন আইনে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করে তিন আসামিকে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাদের ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

তিনি বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের তিনজনই মানবপাচারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এছাড়াও জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

বস্তিবাসীর অভিযোগ:

বস্তির স্থানীয় একজন বাসিন্দা রিকশাচালক। তার স্ত্রীকেও ভারতে পাচার করেছেন কাল্লু-সোহাগ। এখনও তিনি স্ত্রীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, গত ৮ মাস ধরেই কাল্লু আর নাগিন সোহাগ আমার স্ত্রীকে ভালো চাকরি দিয়ে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হইনি। একদিন আমার স্ত্রী কিছু না বলেই বাসা ছেড়ে চলে যায়। এই মাসখানেক আগেই জানতে পারি, কাল্লু-নাগিন সোহাগ তাকে ভারতে পাঠিয়েছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত তরুণীদের টার্গেট করে ভারতে বিভিন্ন মার্কেট, সুপারশপ, বিউটি পার্লারে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করত চক্রটি। জনপ্রতি এক-দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত পেতেন কাল্লু। প্রলোভন দেখিয়ে তরুণীদের একবার সাতক্ষীরা নিতে পারলেই আটকে ফেলা হতো। সেখানে চক্রের ভারত সীমান্ত সমন্বয়কারী বিল্লাল হোসেনের কাছে তরুণীদের বুঝিয়ে দিতেন। সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকায় চারটি সেভ হাউজে এসব তরুণীদের রাখতেন বিল্লাল। সেখান থেকে রাতে ও ভোরের সময় জল ও স্থল পথে অবৈধভাবে তরুণীদের ভারত পাচার করতেন। ওপারে থাকা ভারতের অপর এজেন্ট মো. আলীর কাছে তরুণীদের তুলে দিতেন বিল্লাল।

বাংলাদেশ থেকে ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত নারী পাচারের কাজে কাল্লু ও নাগিন সোহাগের আরও ২০-২৫ জন সহযোগী রয়েছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তিন আসামি চক্রের অনেকের নাম-ঠিকানা দিয়েছে। তবে, বাকি সদস্যদের গ্রেফতার করা যায়নি। কারণ সবাই গাঁ-ঢাকা দিয়েছেন।

ভারতে নারী পাচারের রুট:

ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রলোভন দেখিয়ে তরুণীদের সংগ্রহের পর ঢাকা থেকে বাসযোগে প্রথমেই নিয়ে যাওয়া হয় সাতক্ষীরা। সেখান থেকে দেবহাটা সীমান্তবর্তী গ্রামে। একদিন অবস্থানের পর ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে যাওয়া ইছামতি নদী নৌকাযোগে পার হয়ে ভারতের বসিরহাট সীমান্তবর্তী গ্রামে যাওয়া হয়। বসিরহাট থেকে স্থলপথে বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে নিয়ে যাওয়া হয় কৃষ্ণনগর। এটি কলকাতা-বিহারের সীমান্তে অবস্থিত। কৃষ্ণনগর থেকে হেঁটে তরুণীদের নেওয়া হয় কিশানগঞ্জ। এই গ্রামটিও বিহার সীমানা ঘেঁষেই অবস্থিত। সেখান থেকে বাসে ও মোটরসাইকেলে করে আলাদাভাবে তরুণীদের নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার শিলিগুড়ি। সেখন থেকে পরিবহন পাল্টে নেওয়া হয় পাঞ্জিপাড়ার নিষিদ্ধপল্লিতে।  

মানচিত্র অনুযায়ী কৃষ্ণনগর, কিষানগঞ্জ ও শিলিগুড়ির ঠিক মাঝখানেই অবস্থিত পাঞ্জিপাড়া। এদিকে ফেরত আসার পথটি হলো পাঞ্জিপাড়া থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম বনগাঁ হয়ে ঝিনাইদহ দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে হয়।

মামা-ভাগ্নে কাল্লু-সোহাগ:

কাল্লু রাজধানীর পল্লবী এলাকার চিহ্নিত মানব পাচারকারী চক্রের মূলহোতা। কাল্লু ও নাগিন সোহাগ সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। গত ৮/১০ বছর ধরেই তিনি একইভাবে মানবপাচারের করে আসছিলেন। তবে, যাদের পাঠাতেন তাদের প্রত্যেকের ছবি ও তথ্য কাল্লু ধারণ করে রাখতেন। এ পর্যন্ত দুই শতাধিক নারীকে পাচার করেছেন কাল্লু-সোহাগ সিন্ডিকেট। তারা বিল্লালের কাছে জনপ্রতি ১ থেকে দেড় লাখ টাকায় নারীদের বিক্রি করতেন। সোহাগের মূল কাজ ছিলো, রাজধানীর দরিদ্র ও অল্পবয়সী তরুণীদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে যেতে রাজি করানো। এছাড়াও নাগিন সোহাগ পল্লবী থানার মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। তার বিরুদ্ধে মিরপুরের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। ২০১৭ সালে মাদক মামলায় দুই বছর কারাভোগ করেছেন নাগিন সোহাগ।

এদিকে গত ৭ বছর ধরেই বিল্লাল হোসেন কাল্লু-সোহাগের সঙ্গে কাজ করে আসছিলেন। বিল্লাল চক্রের সাতক্ষীরা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করেন। গ্রেফতার বিল্লাল ও তার সহযোগী (স্ত্রী) রাজিয়া খাতুন ২০১৮ সালে পল্লবী থানার একটি মানবপাচার মামলায় গ্রেফতার হয়ে এক বছর কারাভোগ করেছেন। জেল থেকে বের হয়ে আবার এই কাজই শুরু করেন। ২০১৭ সালের দিকে মানপাচারের দায়ে কাল্লুও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন। পরে জামিনে বের হয়ে আবারও ওই কাজে জড়ান।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০২১
এসজেএ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।