ঢাকা: শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগের কথা বলে প্রচারণা চালিয়ে নিজের এমএলএম কোম্পানিতে বিনিয়োগে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতেন এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান। বিনিয়োগের ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার প্রলোভন দেখাতেন তিনি।
২০১৮ সালে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার গ্রাহকের ১১০ কোটি টাকা নিয়ে শুরু হয় তার সুদবিহীন কোম্পানি। এরপর গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করেই রাগীব নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গড়ে তোলেন মাদ্রাসা ও হোটেলসহ ১৭টি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তার এই ১৭ কোম্পানিতে ৯শ’ কর্মচারী ও লক্ষাধিক গ্রাহক রয়েছে। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীদের বেতন ও গ্রাহকদের লভ্যাংশ কোনোটি দিতেন না রাগীব হাসান।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তি ও ইমামদের টার্গেট করে সুদবিহীন প্রতারণার ফাঁদে ফেলে রাগীব আহসান আত্মসাৎ করেছেন প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহম্পতিবার রাজধানীর শাহাবাগ থানাধীন তোপখানা রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান ও তার সহযোগী মো. আবুল বাশার খানকে গ্রেফতার করে র্যাব। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ভাউচার ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদ্রাসায় অধ্যয়ন শুরু করেন রাগীব। পরে তিনি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিন বছর হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। ১৯৯৯ সালে ২০০০ পর্যন্ত খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে মুফতি সম্পন্ন করেন। পরে তিনি পিরোজপুরে একটি মাদ্রাসায় চাকরি শুরু করেন। ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালে তিনি বিভিন্ন মসজিদে ইমামতিও করেছেন। এর পাশাপাশি ‘এহসান এস মাল্টিপারপাস’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন। মূলত এই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে এমএলএম কোম্পানির আদ্যপান্ত রপ্ত করেন রাগীব আহসান।
সেই থেকে ২০০৮ সালে নিজেই ‘এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন রাগীব। এরপর তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের ধার্মিক সাধারণ মানুষ, মাদ্রাসার শিক্ষক ও ইমামদের টার্গেট করে শরিয়ত সম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগের প্রচারণা চালাতেন। বিভিন্ন ওয়াজ মাজফিলেও তার কোম্পানির জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করতেন। এক লাখ টাকার বিনিয়োগে ২০ শতাংশ মুনাফা প্রাপ্তির প্রলোভন দেখাতেন।
র্যাব খন্দকার আল মঈন বলেন, রাগীবকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি, তার কোম্পানিগুলোতে প্রায় ৩শ’ কর্মচারী রয়েছে, যাদের কোনো ধরনের বেতন দিতেন না তিনি। কর্মচারীররা মাঠ পর্যায় থেকে বিনিয়োগকারী ও গ্রাহক সংগ্রহ করলে তাদের কমিশন দেওয়া হতো। কিন্তু রাগীব তার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেই প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। তবে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, ১০ হাজার গ্রাহকের ১১০ কোটি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। হাউজিং, ল্যান্ড প্রজেক্ট, ব্যবসায়িক দোকান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে সাধারণ গ্রাহকে টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাগীব তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। তার আত্মীয়দের মধ্যে শ্বশুর প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি, পিতা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, ভগ্নিপতি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। এছাড়া রাগীব আহসানের তিন ভাইয়ের মধ্যে গ্রেফতার আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহ-পরিচালক এবং বাকি দুই ভাই প্রতিষ্ঠানের সদস্য।
প্রতারক রাগীব আহসানের ১৭টি প্রতিষ্ঠান হলো—এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহ্সান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমেটেড, নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদরাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার, এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম। এই সব প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের নামে/বেনামে সম্পত্তি ও জায়গা জমি করেছেন।
র্যাব কমান্ডার আরও বলেন, প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা রাগীব আহসানের কাছে টাকা নিতে গেলে তিনি চেক দিতেন। সেটিও তার প্রতারণা ও জালিয়াতির একটি অংশ ছিল। অনেকেই পাওনা টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। তার অফিসে টাকা চাইতে গিয়ে অনেক গ্রাহক লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গ্রেফতার রাগীবের বিরুদ্ধে থানা ও আদালতে ভুক্তভোগীরা ১৫টি মামলা দায়ের করেছেন। সেগুলো এখনও চলমান রয়েছে বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
রাগীবের আত্মসাৎ করা অর্থ ও সম্পদের পরিমাণ কত, জানতে চাইলে খন্দকার আল মঈন বলেন, অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দেব। তারা রাগীবের সম্পদ ও অর্থপাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
প্রতারণার মধ্যমে আত্মসাৎ করা অর্থ রাগীব কোনো জঙ্গি কার্যক্রমে খরচ করেছেন কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২১
এসজেএ/এমজেএফ