ঢাকা: দেশের ইতিহাসে খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। বর্তমানে বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৪৬ টাকায়।
এদিকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাজারকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, দেশের সয়াবিনের উৎস ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়েতে সয়াবিনের দাম বেড়েই চলেছে। দাম বাড়ার কারণ আরেকটি কারণ চীনের অতিরিক্ত তেল সংগ্রহ। এজন্য তারা আগস্ট মাসেই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন।
শনিবার (০২ অক্টোবর) রাজধানীর সূত্রাপুর, রায়সাহেব বাজার, শ্যামবাজারসহ কয়েকটি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৪৪ থেকে ১৪৬ টাকায় ও বোতলজাত সয়াবিন ১৫০ থেকে ১৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৬৬০ থেকে ৭২০ টাকায়। প্রতি লিটার সুপার পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আমাদের ভোজ্যতেলের বাজার আমদানি নির্ভর। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না কমলে দেশের বাজারে কমবে না। করোনা মহামারির কারণে শ্রমিক সংকটে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় গত জুন-জুলাই মৌসুমে পাম অয়েল উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি। একইসঙ্গে চীনের হঠাৎ অতিরিক্ত তেল সংগ্রহ তেলের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনায় মৌসুম শুরু হবে। তাই এর আগে ভোজ্যতেলের দাম কমার সম্ভাবনা নেই বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে দেশের সবচেয়ে বড় তেল রিফাইনারি কোম্পানি সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেশন অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিত সাহা বাংলানিউজকে বলেন, সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের একটা দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সরকার যেটা নির্ধারণ করে দেয় সেটার ওপর কথা বলা যায় না। তবে আমরা বলেছিলাম- আমাদের কিছু কথা আছে। তখন বলেছে, পরবর্তী মিটিংয়ে যা বলার বলতে। এখন দুই-তিন দিনের মধ্যে সম্ভবত আগামী সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের তেল ব্যবসায়ীদের একটা বৈঠক হবে। সেখানে আমরা যা বলার বলবো।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমরা আশঙ্কা করছি আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে তেলের দাম বাড়ছে ভবিষ্যতে আরো দাম বাড়বে। এজন্য আগেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। এখন দেখা যাক মন্ত্রণালয় কি করে। দামের বিষয়ে সোম ও মঙ্গলবার জানতে পারবেন। তবে সরকার যদি দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়- তাহলে ডিউটিতে একটু ছাড় দিলে ভোক্তারা সুবিধা পেতে পারে বলে জানান তিনি।
সূত্রাপুর বাজারের খুচরা বিক্রেতা বিসমিল্লাহ স্টোরের মো. রিপন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা মান ও প্রকার ভেদে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি করছি ১৪৪ থেকে ১৪৬ টাকায়। আর বোতালজাত প্রতি লিটার ১৫০ থেকে ১৫৩ টাকায় এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৬৬০ থেকে ৭২০ টাকায় বিক্রি করছি। কম দামে তেল পেলে আমরা সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারবো। আমরা বেশি দামে কিনি, তাই বেশি দামে বিক্রি করি।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত দাম অনুযায়ী খুচরা বাজারে সুপার পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে না বলে ভোক্তারা অভিযোগ করেছেন। তারা জানান, সরকার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১২৯ টাকা নির্ধারণ করলেও বিক্রি হচ্ছে ১৪৬ টাকায়। আর সুপার পাম অয়েল ১১৬ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে তা ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকার ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর প্রায় মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু বাজারে তার কোনো প্রতিফলন নেই। তাহলে দাম নির্ধারণ করে কি লাভ হলো?
অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক বিষয়ক জাতীয় কমিটির সেই বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেন, এখন থেকে কমিটি নির্ধারিত দামে বাজারে ভোজ্যতেল বিক্রি হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম সর্বোচ্চ ১৩৫ টাকায় উঠেছিল। গত এক দশকে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১০০ থেকে ১১৫ টাকার মধ্যে ওঠানামা করলেও এক বছর ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম লাগামহীন। এজন্য ভোজ্যতেলের দাম কমাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর ছাড়ের অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছিল। তবে সরকার অগ্রিম মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) আদায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতে দামে প্রভাব পড়ার সুযোগ কম। পার্থক্য এটুকুই যে এখন ভ্যাট পরে দিতে হচ্ছে, আগে অগ্রিম নেওয়া হতো। কোম্পানিগুলো ভ্যাট ছাড়ের দাবি জানিয়ে বলছে, এখন এক লিটার তেলে ভ্যাট ২০ টাকার মতো। পাঁচ লিটারে তা ১০০ টাকা দাঁড়ায়। বিশ্ববাজারে দাম যত বাড়ে, সরকারের করের পরিমাণও বাড়ে।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এ সময়ে খুচরা বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ৪৬০ থেকে ৫১০ টাকার মধ্যে। এক লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৮৪ থেকে ৮৬ টাকায়। আর প্রতি লিটার সুপার পাম অয়েলের দাম ছিল ৭৩ থেকে ৭৬ টাকা। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন করে পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম সর্বোচ্চ ৭২৮ টাকা, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ১২৯ টাকা ও সুপার পাম অয়েলের দাম ১১৬ টাকা নির্ধারণ করেছে।
টিসিবির হিসেবেই গত এক বছরে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলে ৩৮ দশমিক ১০ শতাংশ, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনে ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ, এক লিটারের খোলা সয়াবিন তেলে ৫১ দশমিক ৭৬ শতাংশ ও সুপার পাম অয়েলে ৬৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ দাম বেড়েছে।
জানা গেছে, গত বছর এপ্রিল-জুন সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০০ ডলারের আশপাশে। আর এ বছর এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ২০০ ডলারে। আর বর্তমানে প্রতি টন সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩৭০ ডলারে। যদিও এক মাস আগে তা এক হাজার ৪৪০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আর প্রতি টন পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১৮০ ডলারে। পাম অয়েলের দামও এক মাস আগে এক হাজার ২৩০ ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত সরিষা, সূর্যমুখীসহ অন্যান্য তেলবীজ থেকে সোয়া দুই লাখ টন তেল পাওয়া যায়। বাকিটা আমদানি করতে হয়। মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা থেকে এই তেল আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ২০২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০২১
জিসিজি/এনএসআর