কেরানীগঞ্জ: গ্রাম্য সালিশে নির্ধারণ করা হলো কেরানীগঞ্জে আলোচিত কবিরাজের ভুল চিকিৎসায় পা হারানো শিশুর ভবিষ্যত! কোনো মামলা-মোকাদ্দমা না করার শর্তে স্থানীয় প্রভাবশালীরা শিশুর ডান পায়ের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন মাত্র এক লাখ টাকা।
গৃহহীন অসহায় পরিবারটি যেখানে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল তাদের একমাত্র ছেলে সন্তানটিকে ঘিরে সেখানে কবিরাজের ভুল চিকিৎসায় সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেল।
ঘটনাটি ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার আব্দুল্লাহপুর কলাকান্দী মধ্যপাড়া এলাকায়। গত ৯ সেপ্টেম্বর সীমা-বাসার দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নেয় শিশু পুত্র অনিক। জন্মের পর থেকেই শিশুটির কান্না না কমায় জন্মের ষষ্ঠ দিন চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে স্থানীয় কবিরাজ ও কথিত ডাক্তার কিশোর দেবের কাছে নিয়ে গেলে তিনি ঝাড়-ফুঁকের পাশাপাশি একটি ট্রাইজন নামক ইনজেকশন পুশ করেন। শিশুটিকে বাসায় নিয়ে এলে কান্না না থামায় দ্বিতীয় দিন আবারও সেই কবিরাজের কাছে নিয়ে গেলে সেইদিনও আরও একটি ইনজেকশন পুশ করেন। এতে শিশুর পা ফুলে গেলে কবিরাজ নিজেই প্রথমে শিশুটিকে স্যার সলিমুল্লাহ্ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে শিশু অনিকের অবস্থা অবনতি হলে ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেও ডাক্তার শিশুটিকে ভর্তি করাতে না পেরে বাংলাদেশ স্পেশালাইড হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে সেখানে আইসিও না থাকায় ধানমন্ডিতে মাদার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানকার চিকিৎসক জানান, শিশু অনিকের ডান পায়ের হাড়ে পচন ধরেছে। এখন তার পা কাটা ছাড়া কোনো উপায় নেই। অবশেষে গত ২৬ সেপ্টেম্বর শিশুটির পা কেটে ফেলা হয়।
ছেলে অনিকের পা কাটার ২৩ দিনপর নির্মম ঘটনাটি নিয়ে সংবাদ প্রচার হয় দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) থেকে শুরু করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পর্যন্ত সুষ্ঠ বিচারের আশ্বাস দেন পরিবারটিকে, তবে এরপরই পাল্টে যায় সবচিত্র। কবিরাজ ও কথিত ডাক্তারকে বাঁচাতে নড়ে চড়ে বসে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। স্থানীয় খবির মেম্বার, তাইজুল ইসলাম, বাতেন, জাহাঙ্গীরসহ কিছু প্রভাবশালী মাতুব্বর মিলে এক লাখ টাকায় মিমাংসা করে দেন ঘটনাটি। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেনো কোন দাবি দাওয়া না করতে পারে সেজন্য ভুক্তভোগী অনিকের বাবা-মার সিগনেচার নেওয়া হয় সাদা কাগজে।
শিশুর বাবা আবুল বাসার অভিযোগ করে বাংলানিউজকে বলেন, কবিরাজ না বলে ইনজেকশন পুশ করার কারণে আমার আদরের ধন আজ পঙ্গু। আমার মতো কেউ যেন হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে না যায় আর কোনো শিশুর পা হারাতে না হয়।
এক লাখ টাকার বিনিময় কেনো আপোষ হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলাকায় বসবাস করতে হবে, আমরা গরীব মানুষ তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা থাকতে পারবো না। তবে আমি টাকা নয় ছেলের অঙ্গহানীর বিচার চাই।
এ ব্যাপারে স্থানীয় মাদবর খবির মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, শিশুটির বাবা আমার আত্মীয়। কবিরাজ তার ভুলের সব ঘটনা সত্যি বলেছে এবং কবিরাজ নিজে বাচ্চার চিকিৎসার সব খরচ দিবে বলে হাসপাতালে ভর্তিও করিয়েছেন। জানতে পেরেছি ২ লাখ ১০ হাজার টাকার খরচ করেছে। পরিবার আমাকে জানিয়েছেন পা কাটার পর নাকি তিনি মাদার কেয়ার হাসপাতালে টাকা পরিশোধ করে চলে এসেছে। আরও এক লাখ টাকা ছেলের বাবাকে দেওয়া হয়েছে ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।
স্থানীয় মাদবর ও বাড়ি ওয়ালা মারফত ভান্ডারী বাংলানিউজকে বলেন, আমার বোধগম্য হয় না কবিরাজ কেন এই ৬ দিনের বাচ্চাকে ধরে ইনজেকশন দেবে সে তো কবিরাজ। এখন বাচ্চাটির কি হবে?
কবিরাজ দেব কিশোর ওরফে ধীমান সরকার নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি একজন পল্লী চিকিৎসক ও আমার বাবা কবিরাজি করতেন, তার কাছ থেকে শিখে আমিও উৎসাহ পাই এবং ঝাড়-ফুঁক করতে শুরু করি। আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে এ কাজ করছি।
ওই শিশুটির বয়স যখন ৬ দিন তখন তার মা আমার কাছে নিয়ে এলে আমি তাকে নাভি শুকানো ও ঠাণ্ডা ভালো করার জন্য দুইদিন ঝাড়-ফুঁক ও দুটি ট্রাইজন ইনজেকশন পুশ করি। পরে জানতে পারি যে তার পায়ে ইনফেকশন হয়েছে।
দেব কিশোরের দাবি জম্মের পর থেকে শিশুটির ইনফেকশন ছিল। পরবর্তীকালে স্থানীয়রা সালিশে মিমাংসা করে দেন, ‘শিশুটিকে চিকিৎসা বাবদ সকল খরচ আমি বহন করবো। আমি তাই করেছি। প্রথমে ঢাকার আজগর আলী হাসপাতাল ও বাংলাদেশ স্পেশালাইড হাসপাতাল এবং শেষে ধানমন্ডি মাদার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করি। গত ২৬ সেপ্টেম্বর শিশুটির পা কেটে ফেলতে হয়। এতে আমার মোট ২ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। পরে আরও এক লাখ টাকা দিলাম। এরপর আর কি থাকে আমি বুঝিনা। ’
এ ব্যাপারে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারটিকে আমরা থানায় আনতে পারছি না, কোনো অভিযোগও করছেন না। আমরা ব্যাপারটা দেখছি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) শাহাবুদ্দিন কবির বাংলানিউজকে জানান, সংবাদ প্রকাশের পরপরই পুলিশ আসামিকে আটক করতে অভিযানে নামে। পুলিশের দুইদিনের অক্লান্ত চেষ্টায় আসামি দেব কিশোর সরকারকে আটক করতে সক্ষম হয়। ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কবিরাজ ও কথিত ডাক্তার দেব কিশোর সরকার পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।
>>> ভুল ইনজেকশনে পা হারালো নবজাতক
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০২১
এনটি