ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

বাসের হেলপার থেকে কোটিপতি শাহীরুল

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২১
বাসের হেলপার থেকে কোটিপতি শাহীরুল প্রতারক শাহীরুল ইসলাম সিকদার

ঢাকা: উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সৌখিন পরিবহন বাসের কন্ডাক্টর (হেলপার) হিসেবে শাহীরুল ইসলাম সিকদারের (৪৮) কর্মজীবনের শুরু।  দীর্ঘ ৮ বছর (১৯৯৬-২০০৩ সাল পর্যন্ত) পর এই পেশা থেকে বেরিয়ে সিকিউরিটি গার্ড সরবরাহের নামে শুরু হয় তার প্রতারণার প্রথম ধাপ।



রাজধানীর রামপুরায় গড়ে তোলেন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড প্রতিষ্ঠান। সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে জমি-জমা ও ফ্ল্যাট বিক্রি, সরকারি চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেন বিপুল অর্থ। গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। শুধু তাই নয়, প্রতারণার কৌশল হিসেবে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা বাঁধিয়ে রাখতেন অফিস কার্যালয়ে। নিজেকে কথিত মানবাধিকার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিতেন শাহীরুল। সঙ্গে রাখতেন একাধিক অস্ত্রও। খুব শৈল্পিকভাবে দীর্ঘ ১৯ বছরের প্রতারণা চালিয়ে ঢাকায় গড়ে তোলেন ৫০ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। ঢাকায় দুইটি ফ্ল্যাট, দুইটি বাড়ি, দুইটি বিলাসবহুল গাড়ি ও ২৪ কাঠা জমি রয়েছে এই প্রতারকের। শনিবার (২৩ অক্টোবর) বিকেল ৫টার দিকে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, প্রতারণার শিকার বেশ কিছু ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার (২২ অক্টোবর) থেকে শনিবার পর্যন্ত রাজধানীর রামপুরা থানাধীন বনশ্রীতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ প্রতারক শাহীরুলকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪।

অভিযানে তার কাছ থেকে তিনটি বিদেশি পিস্তল, একটি শর্টগান, একটি এয়ারগান, একটি এয়ার রাইফেল, ২৩৭ রাউন্ড গুলি, পাঁচটি ম্যাগজিন, পাঁচটি খালি খোসা, ২২টি কার্তুজ, চারটি চাকু, তিনটি ডামি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া হোমল্যান্ড সিকিউরিটির চাকরির আবেদন ফরম, চুক্তিপত্র, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ব্যানার, প্যাড, স্ট্যাম্প, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ, গোপন ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ড, নেইম প্লেট, বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবি, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, পাসপোর্ট, মানি রিসিভ বই, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড, মোবাইল ফোন উদ্ধার করে র‌্যাব-৪।

অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, সরকারি চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিনে প্রতারণায় শাহীরুল রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট ও জমিসহ দৃশ্যমান প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া তার কথিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে-হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, হোমল্যান্ড ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, মানবাধিকার সংস্থা, শাহীরুল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, হোমল্যান্ড হাউজিং, হোমল্যান্ড বেভারেজ, মাদারল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস, শাহীরুল ইসলাম বাংলাদেশ আউট সোর্সিং অ্যান্ড পাওয়ার সাপ্লাইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন।

র‌্যাব-৪ এর সিও বলেন, শাহীরুল নিজেকে পরিচয় দিতেন একটি কথিত মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান এবং ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড’ নামক ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। এছাড়া চাকরি দেওয়ার নামে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এমন অভিযোগে রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকায় শাহীরুলের নিজের বাসা ও প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

যেভাবে প্রতারক শাহীরুলের উত্থান:

উচ্চ মাধ্যমিক পাস শাহীরুল কর্মজীবন শুরু করেন গাড়ি ব্যবসা দিয়ে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সৌখিন পরিবহনে কাজ করেছেন। এরপর শুরু করেন প্রতারণা ব্যবসা। ২০০৩ সালে সিকিউরিটি গার্ড সরবরাহ প্রতিষ্ঠান চালু করেন। এরপর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি নামে প্রাতিষ্ঠান করেন। অল্প সময়ে বিপুল টাকার লোভে ২০১৪ সালে রামপুরায় ‘হোমল্যান্ড সিকিউরিটি’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান খুলে শুরু করেন অর্থ আত্মসাৎ। এরপর থেকে তিনি অবৈধভাবে সম্পদের মালিক হতে শুরু করেন। প্রতরণার অভিযোগ আড়াল করতে শাহীরুল তার অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিসের পরিবর্তে নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি বেনামি মানবাধিকার সংস্থা খুলে নিজেকে চেয়ারম্যান পরিচয় দিতেন।

এছাড়া ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো প্রদর্শন করে এবং বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতেন। প্রতারণার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী ও পুরুষকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড, ড্রাইভার, কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী, বিক্রয় কর্মকর্তা, লাইনম্যান হিসেবে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

শাহীরুলের প্রতারণার কৌশল:

শাহীরুল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দিতে চাকরির চটকাদার বিজ্ঞাপন দিতেন। দেশের শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীরা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আবেদন করলে, তাদেরকে কৌশলে তার পরিচালিত কোম্পানির মাধ্যমে নিয়োগ দিতে প্রতিশ্রুতি দিতেন। এরপর চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ১৫-২৫ হাজার টাকা জামানত হিসেবে নিতেন। তাছাড়া সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫-১০ লাখ টাকা নিতেন।

র‌্যাব জানিয়েছে, শাহীরুল নিজেকে শুটিং ক্লাবের সদস্য বলে পরিচয় দিত। প্রশিক্ষণ, ইউনিফরম ও আনুষাঙ্গিক খরচ হিসেবেও টাকা নেওয়া হতো। এভাবে অনেকের কাছ থেকে নামমাত্র নিয়োগ দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার অফিস বা বাসায় ঘোরাঘুরি করেও টাকা ফেরত পেত না। বরং টাকা চাইলে অবৈধ অস্ত্র দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের ভয়ভীতি দেখাতেন। এছাড়া প্রতারক শাহীরুল নিজেকে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অপরাধে ডিএমপির রামপুরা থানায় চাঁদাবাজি ও প্রতারণার মামলা রয়েছে।

কী পরিমাণ সম্পদ শাহীরুলের রয়েছে এমন প্রশ্নে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘২০০৩ সাল থেকে তিনি প্রতারণায় জড়িত। সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকায় দুটি বাড়ি, দুটি ফ্ল্যাট, দুটি গাড়ি ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা তার নামে ২৪ কাঠা জমির তথ্য পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ আমরা পেয়েছি। তবে, ব্যাংক, ফিক্সড ডিপোজিট, স্বজনদের নামে কি পরিমাণ সম্পদ আছে, তা এখনো জানা যায়নি। ’

অস্ত্রগুলো কোথায় থেকে কিনেছেন বা সংগ্রহ করেছে তা জানতে চাইলে র‌্যাব-৪ এর সিও বলেন, ‘উনি বলেছে সবগুলোর লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু কোনোটারই লাইসেন্স দেখাতে পারেনি। এসব অবৈধ অস্ত্র তার নিজ হেফাজতে রেখেছিল।

প্রতারক শাহীরুলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০২১
এসজেএ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।