ঢাকা, শুক্রবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

ভোরের স্নিগ্ধ শিশিরে শীতের আবেশ

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০২১
ভোরের স্নিগ্ধ শিশিরে শীতের আবেশ মাকড়শার জালে জমেছে শিশির বিন্দু। ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: কার্তিকের স্নিগ্ধ সকালের শিউলি ঝরা প্রকৃতি থেকে যায় যায় বলছে হেমন্ত। ভোরের রক্তিম সূর্যটাও হয়ে উঠছে মিষ্টি।

পাখির কিচিরমিচির শব্দে রক্তাভ আকাশে সূর্য যখন উঁকি দিচ্ছে; তখনই শিশির ছড়াচ্ছে সবুজ দূর্বাঘাসে। নিগূঢ় রাতের আড়মোড়া ভেঙে ভোরের আলো ফুটতেই শিশিরবিন্দুগুলো আটকা পড়ছে ধানক্ষেতের মাকড়সার জালে। আর শীষের ডগায় জমা শিশিরগুলো যেন মুক্ত দানার মত দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

হিম হয়ে উঠেছে কার্তিকের সকাল। সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে ম-ম করছে মল্লিকা, শিউলি, কামিনী আর ছাতিম ফুলের সৌরভ। কুয়াশার আঁচল সরিয়ে ঝিরিঝিরি করে যখন উত্তুরে বাতাস বইছে শরীরে তখন ছড়িয়ে পড়ছে শীতের হিম স্পর্শ। ক্রমেই নামছে তাপমাত্রার পারদ। কমছে প্যাচপ্যাচে গরম। ভোরে ও সন্ধ্যায় হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে গ্রাম ও শহুরে প্রকৃতি। শেষ রাতের হিমেল পরশ আর সকালের নরম রোদের আবেশ জানান দিচ্ছে হেমন্তের হাত ধরেই আসছে শীত।

ষড়ঋতুর এই বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য এমনিতেই সবাইকে বিমোহিত করে। এর ওপর এমন নিয়ম মেনে শীত নামেনি অনেক বছর। করোনার কারণে গেল ক'মাস আগেও স্থবির হয়ে পড়েছিল সবকিছু। তবে প্রকৃতির জন্য শাপে বর হয়ে উঠেছে করোনা। দীর্ঘ একটা সময় বায়ু দূষণের মাত্রা কমায় সরূপে ফিরেছে প্রকৃতি; অন্তত এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই একরাশ সজীব স্বপ্ন নিয়ে আবারও হাজির শীতষ্ণ প্রকৃতি।  

কুয়াশামাখা প্রকৃতি আর মাঠের সোনালি ধানের সোঁদা গন্ধ কৃষকের চোখে-মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠেছে এখনই। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে কার্তিকের পর অগ্রহায়ণ পেরিয়ে পৌষ-মাঘ শীতকাল ধরা হলেও এবার শেষ কার্তিকেই শীত শীত অনুভূত হচ্ছে। ভোররাতে হাতে সেলাই করা রঙিন নকশি কঁথা, কম্বল বা চাদর গায়ে মুড়ি না দিলে যেন উষ্ণতা মিলছে না। ঘুমন্ত শরীরটাও যেন ওম চাইছে। একই কারণে সকাল-বিকেল শীতের কাপড় নিয়েই বাইরে বেরুতে হচ্ছে শীতকাতুরে মানুষকে। আলমিরায় বন্দি থাকা গরম কাপড়গুলো তাই এখনই ঠাঁই নিতে শুরু করেছে ঘরের আলনায়।

গরমের সেই ক্ষিপ্রতা নেই। গাছের নরম-কচি পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে মিষ্টি রোদ। বিকেল পাঁচটা গড়ালেই পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে সূর্য। গোধূলি লগ্নের রাঙা সূর্য সবাইকে রোমাঞ্চিত করে জলদিই নামিয়ে দিচ্ছে হিমেল সন্ধ্যা। রাতে বয়ে চলা ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাস কাঁটা দিচ্ছে শরীরে। গরম কাপড় উঠছে তাই সবার গায়েই।  

রাজশাহী; বরেন্দ্রভূমি খ্যাত। বলা হয় দেশের এই রুক্ষ অঞ্চলে গরমের সময় গরম বেশি, শীতের সময় শীত। তাই গরমের পর একটু আগেভাগেই এবার রাজশাহীতে আঁচড় বসিয়েছে শীত। গেল ক’দিন থেকেই শীত অনুভূত হচ্ছে। দিনের বাতাসে অনুভূত হচ্ছে শুষ্কতা। এখনই টানটান হয়ে উঠছে ত্বক। ফালি ফালি জোৎস্নার খেলা চলছে রাতের স্বচ্ছ আকাশে। ভোরের আলো দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়তেই মেঠোপথ ঘেঁষা মাঠের ধানের পাতাগুলো ভিজে উঠছে স্নিগ্ধ নীহারে। সূর্যের বর্ণচ্ছটায় শীষের ডগায় নুয়ে পড়া কাঁচের মত শিশির বিন্দুগুলো যেন প্রতিবিম্ব হয়ে উঠছে সবুজ প্রকৃতির।

হামাগুড়ি দিয়ে শীত যখন অপরূপ এই প্রকৃতিতে আসছে তখন শুরু হতে যাচ্ছে নবান্ন উৎসব। এই নবান্ন উৎসব আবাহমান বাংলার চিরায়ত প্রথা হিসেবে যুগযুগান্তর থেকে চলে আসছে। মধ্য হেমন্তে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে উঠতে থাকে নতুন ধান। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মনে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দেয়। কালের বিবর্তনে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও কৃষকরা নবান্ন উৎসব পালন করতে ভুলে যায়নি আজও।

তবে এমন ভিন্ন আবহে কার্তিক কাটলেও কবে নামবে শীত? গেল বছরের মত এবারও নভেম্বরের শুরুতেই শীতের দেখা মিলেছে। যদিও আবহাওয়া অফিস বলছে- মধ্য ডিসেম্বরের আগে বাড়বে না শীতের তীব্রতা। গত সপ্তাহ থেকেই মাত্র দিনের তাপমাত্রাও কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে রাজশাহীতে দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৮ থেকে ১৬-এর মধ্যে ওঠানামা করছে। এভাবে কমতে কমতে হাড় কাঁপানো শীত নামবে ডিসেম্বরেই। অর্থাৎ অগ্রহায়ণ শেষে পৌষের শুরুতেই নামবে কাঁপন ধরানো শীত।  

পরিবেশবিদরা বলছেন, নিরক্ষীয় বায়ুর প্রভাবে সমুদ্রের গভীর থেকে শীতল স্রোত তৈরি হচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরে এরইমধ্যে এই স্রোত দেখা দিয়েছে। এজন্য উত্তর নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণতা কমতে শুরু করে। এবার সেই লা নিনার প্রভাবেই ঠাণ্ডা পড়বে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, শীতের আগমন নির্ভর করে মূলত জলবায়ুর ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের বৃষ্টিপাতের ধারা পরিবর্তন ও দক্ষিণের বায়ু প্রবাহের যে হেরফের হয়েছে এতে আমাদের মৌসুমি বাউন্ডারিগুলো আর আগের মত নিয়মিত নয়। ফলে শীত কোনো বছর আগে আবার কোনো বছর পরে শুরু হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই বছর করোনার প্রভাবে লকডাউনের সময় বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এতে বৈশ্বিক আবহাওয়ার কিছুটা পরিবর্তন হয়ে শীত পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমবেশি হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রারও পরিবর্তন হয়। এতে বায়ুপ্রবাহের দিক ও সমুদ্র স্রোতের কিছুটা পরিবর্তন হয়। আমাদের দেশে যে শৈত্যপ্রবাহ আসে এটি মূলত উত্তর বা উত্তরপশ্চিম দিকের বায়ু। এই শীতল বায়ুর প্রভাবে আমরা ঠাণ্ডা অনুভব করি। অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় সেখানের উষ্ণ বায়ুর পরিমাণ কমে গেছে। এতে উত্তরের শীতল বায়ু এখন খুব সহজে আমাদের দিকে চলে আসতে পারছে। তাই দ্রুত শীত পড়েছে। এছাড়া এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি শীত পড়তে পারে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, এক সপ্তাহ থেকে আবহাওয়ার ধারাবাহিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গড় তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমেছে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সাধারণত তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রির নিচে নামলেই শীত পড়তে শুরু করে।

তিনি বলেন, দেশে ১৫  ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত শীতের তীব্রতা থাকবে। এ সময়টায় সর্বোচ্চ শীত পড়বে। এরপর থেকে আবার শীত কমতে শুরু করবে। তাই মধ্য ডিসেম্বরে রাজশাহীসহ গোটা উত্তরাঞ্চলে জেঁকে বসবে শীত। নভেম্বরে বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস রয়েছে। আর ঘূর্ণিঝড়ের রেশ না কাটতেই ডিসেম্বরে শৈত্যপ্রবাহেরও সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে, রাত ও দিনের তাপমাত্রা কমতে থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০২১
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।