ঢাকা, শুক্রবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

রামেকে স্বজনহীন রোগীদের আস্থার প্রতীক আলেয়া

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২১
রামেকে স্বজনহীন রোগীদের আস্থার প্রতীক আলেয়া আলেয়া

রাজশাহী: ৩৫ বছর বয়সী আলেয়া বেগম৷ দীর্ঘদিন যাবত রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) হাসপাতালে ট্রলি টানার কাজ করতেন। বর্তমানে হাসপাতালে দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকের (পরিচ্ছন্নতাকর্মী) কাজ করেন।

কাজের ফাঁকে ফাঁকেই হাসপাতালে আসা স্বজনহীন রোগীদের সর্বদা খোঁজ করেন৷ এমন কাউকে পেলেই আপন করে নেন। তিনিই সেই সব রোগীর স্বজন হয়ে যান।

নিজেই তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। নিজের টাকা দিয়েই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীও কিনে দেন৷ বিনিময়ে কারও কাছ থেকে চান না কিছুই। মানুষটাকে সুস্থ করে তুলতে পারলেই তার মুখে হাসি ফোটে। কারণ স্বজনহীন রোগীদের সেবা-শুশ্রূষা করায তার কর্ম-ধর্ম ও নেশা। কারও মা, কারও বোন, কারও মেয়ে হয়ে প্রায় ১৩ বছর ধরে এমন নিরবেই শতাধিক মানুষকে সুস্থ করে চলেছেন তিনি।

শুধু তাই নয়, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা স্বজনহারা মানুষের থাকার জায়গা না থাকলে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। চিকিৎসার পর সুস্থ হলে, রোগীকে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। সারাদিন এভাবে হাসপাতালের বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি স্বজনহীন রোগীর সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করছেন তিনি। অসহায় রোগীদের সেবায় আলেয়া যেন স্বজনহীন বেওয়ারিশ রোগীদের এক আস্থার প্রতীক।

অসহায় মানুষের সেবায় যেন তার আত্মতৃপ্তি। নিরবে নিভৃতে ১৩ বছর ধরে নিরলসভাবে প্রায় ১৫০ জন স্বজনহীন মানুষের সেবা করে সুস্থ করে তুলেছেন তিনি। তার এমন মহৎ কাজের পাশে কোন সংগঠন বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসে নি। এতে অবশ্য তার কোনো ধরনের কষ্ট ও অভিযোগ নেই। মানব সেবায় নিজেকে প্রতিদিন উজার করে দিচ্ছেন এ নারী।

রামেক হাসপাতালে আলেয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানন, সিরাজগঞ্জ সদরের খাজা গ্রামের বাসিন্দা তিনি। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হওয়ায় মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় আলেয়াকে। পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের পর যৌতুকের টাকা পরিশোধ করতে সক্ষম না হওয়ায় স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান। তখন থেকেই জীবনে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। ২০০৩ সালে দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে রাজশাহী চলে আসেন তিনি।

মহানগরীর হেতেম খাঁ এলাকার এক বস্তিতে আলেয়া শুরু করেন এক নতুন জীবন৷ সংসার চালানোর জন্য প্রথমে পুরনো বই বাঁধাইয়ের কাজ শুরু করেন। তবে ক্ষুদ্র এ উপার্জনে তার সংসার যেন চলছিল না৷ হঠাৎ এমন সময়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নূরজাহান বেগমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনিই হাসপাতালে কাজের ব্যবস্থা করে দেন।

একদিন হাসপাতালে আলেয়ার চোখের সামনে দু'জন রোগীর মৃত্যু হয়৷ একজন রোগী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, অবস্থার অবনতি ঘটে। ছটফট করতে করতে তার মৃত্যুও হয়৷ কিন্তু তাদের সেবাযত্নের জন্য কোনো স্বজন পাশে নেই। ব্যাপারটি আলিয়াকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দেয়। এরপর থেকেই হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে অভিভাবকহীন রোগীদের খোঁজ করে তাদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন৷ আর এভাবেই নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়ে দুঃখী অসুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাচ্ছেন এ শ্রমজীবী নারী।

বর্তমানে রাজশাহী মহানগরের মুন্সীডাঙ্গা এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন আলেয়া। পরিবার বলতে তার মা রওশন আরা ও মেয়ে টুম্পা। তার সঙ্গে একজন ছেলেও থাকেন। যাকে তিনি রামেক হাসপাতালে পেয়েছিলেন হাত-পা কাটা অবস্থায়। সুস্থ হওয়ার পর কোন অভিভাবকের সন্ধান না পাওয়ায় নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। আলেয়া তার নাম দিয়েছেন বোল্টু।

মানবসেবার অনন্য এ উজ্জ্বল নক্ষত্র তার কাজের জন্য স্বীকৃতিও পেয়েছেন। গত বছরের মার্চে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠানে তাকে ‘কীর্তিমান হিতৈষী’ সম্মাননা পদক দেওয়া হয়। ডিসেম্বরে একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে দেওয়া হয় স্বেচ্ছাসেবা সম্মাননা।

রামেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আলেয়ার কাছে ৫ জন অভিভাবকহীন রোগী ছিলেন। তারা কেউ ঠিক করো কথা বলতে পারেন না। নিজের বাড়ির ঠিকানা বলতে পারেন না। হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আলেয়া এসব রোগীদের খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা, মলমূত্র ত্যাগ করানো থেকে শুরু করে সবকিছুই দেখাশোনা করছেন। সারা দিন তার দম ফেলার ফুরসত নেই আলেয়ার। রোগী বেশি হলে সেই সকালে হাসপাতালে যান আর গভীর রাতে ফিরতে হয়।

আলেয়া বাংলানিউজকে বলেন, হাসপাতালে দীর্ঘ ৫ বছর ধরে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছি। এখনো স্থায়ী নিয়োগ পাইনি। অনেক সময় ঠিকাদাররা আমাকে বাদ দিয়ে দেন। কিন্তু ডাক্তাররা আমাকে পছন্দ করায় বারবার ফিরিয়ে আনা হয়। রামেক হাসপাতালের চাকরিটা অন্তত স্থায়ী হলে আর কোন চিন্তা করতে হবে না। হাসপাতালে দৈনিক মজুরির শ্রমিক হিসেবে যা পাই তা দিয়ে সংসার চলে না। কারণ আয়ের বড় একটি অংশ রোগীদের পেছনে খরচ করতে হয়। বাধ্য হয়ে রাতের বেলায় বই বাঁধানোর কাজ করি। এক হাজার পাতা সেলাই করলে এখন ১০০ টাকা পাই।

তিনি আরও বলেন, অনেক রোগীর সব ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয় না। তখন অন্যান্য রোগীদের স্বজনদের থেকে অল্প অল্প করে টাকা উঠিয়ে ওষুধ কিনেছি। আবার নিজের বেতনের টাকা অনেক সময় খরচ করেছি রোগীদের পেছনে। তবে রোগীর স্বজনেরা টাকা দিতে চাইলে কষ্ট লাগে। কারণ নিঃস্বার্থে তাদের সেবা করেছি। কোন ধরনের আশায় কিছু করিনি। যতদিন বেঁচে আছি এভাবে মানুষের সেবা করতে চাই। মানুষকে সেবা করে সুস্থ করে তুলতে পারলে এক ধরনের আনন্দ কাজ করে।

আলেয়া চান সরকার কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব অসহায় স্বজনহীন রোগীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক।

তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, এখন যে ৫ জন রোগী আছে তার মধ্যে একজনকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে নিজের ও আত্মীয়-স্বজনের নাম-ঠিকানা জানেনা। এই রোগীকে রাখার মতো আমার কাছে কোনো জায়গা নেই। সুস্থ রোগীকে তো হাসপাতালে রাখা যাবেনা। তাহলে এখন একে নিয়ে আমি কি করবো? বছরের প্রায় সময়ই এমন পরিস্থিতিতে আমাকে পড়তে হয়। আমি গরীব মানুষ। সামান্য বেতনের টাকা যা পাই তাই দিয়ে এদের চিকিৎসা করাই। এতে আমাকে হিমশিম খেতে হয়।

দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, সরকার কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব স্বজনহীন অসহায় মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে খুবই ভালো হতো।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২১
এসএস/জেডএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।