ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

নুরী-আনোয়ারাদের সফলতার চাবিকাঠি ‘ছাগল পালন’

জুলফিকার আলী কানন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০২১
নুরী-আনোয়ারাদের সফলতার চাবিকাঠি ‘ছাগল পালন’ নুরী-আনোয়ারাদের সফলতার চাবিকাঠি ‘ছাগল পালন’

মেহেরপুর: ১২০০ টাকার একটি ছাগলই আজ নুরী বেগমের সফলতার চাবিকাঠি। এই একটি থেকেই আজ প্রায় ৬০টি ছাগল তার ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা ফার্মে।

যা নুরীর সংসারে এনে দিয়েছে স্বচ্ছলতা আর সম্মান।

জানা যায়, বাবা-মায়ের আদরের সন্তান নুরীর বিয়ে হয়েছিল একই গ্রামের আজগর আলীর সঙ্গে। কিন্তু নুরী শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় তার স্বামী আজগর দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যেত্রে চলে যান। এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন নুরী। পরে সন্তান ও নিজের পেট চালাতে বেছে নেন চাল-ময়দার ব্যবসা। কিন্তু গ্রামের লোকজন বাকি নিয়ে আর সেটা পরিশোধ করতো না। এতে একটা সময় তার পুঁজি (মূলধন) হারিয়ে যায়। অসহায় হয়ে পড়েন নুরী।

এমন পরিস্থিতিতে তিনি কোনোভাবে ১২০০ টাকা জোগার করে একটি ছাগল কিনে পালতে শুরু করেন। সেই একটি ছাগল থেকে আজ প্রায় ৬০টি ছাগল তার ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা ফার্মে।

নুরী খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, আমি এ বছর একযোগে ১ লাখ টাকার ছাগল বিক্রি করেছি। সেই টাকা ব্যাংকে রেখেছি। আমার ছেলে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। আমার মেয়ে সাহানা খাতুনের দুই মেয়ে চিন্তা মনি ও ভাবনা মনিকে লেখা পড়া শিখিয়েছি। ভাবনাকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া শিখিয়ে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। তাকেও ৭০ হাজার টাকা দিয়েছি।

নুরী খাতুন আফসোস করে বলেন, আমার বাবা-মা অতি আদর করে আমার নাম রেখেছিলেন নুরজাহান। সারে জাহানের আলোর সঙ্গে মিল রেখে নুরজাহান নাম রাখেন তারা। কিন্তু আমার সে কপাল হয়নি। প্রতিবন্ধী হওয়ার অপরাধে আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে অন্যেত্রে দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যান। এরপর আমি অভাব আর হাজার বিপদের মধ্যেও ভেঙে পরিনি। সব সময় নিজে কিছু করার চেষ্টা করতে থাকি। সেই চেষ্টা থেকে আজ সফলও হয়েছি।  

এর মধ্যে নুরী খাতুন তার সুখের কথাও বললেন।

নুরী খাতুন বলেন, অবশেষে গত ৮ বছর আগে আমার স্বামী আবারও আমার কাছে ফিরে এসেছিলেন অসুস্থ হয়ে। প্রায় দেড় বছর আমার কাছে থাকার পর মারা গেছেন। এই সময়ের মধ্যে আমি তাকে সব ধরনের সেবা-যত্নও করেছি। কিন্তু আল্লাহ তাকে তুলে নিয়েছেন।

নুরীর আর্থিক স্বচ্ছলতা দেখে সাহারবাটি গ্রামের রোকেয়া খাতুন নামে এক নারীও এখন ছাগল পালতে শুরু করেছেন। এছাড়া নুরীর মতো স্বামী পরিত্যক্ত রোকেয়ার বাড়িতেও এখন ২১টি ছাগল, আত্তাফন নেছার বাড়িতে ১২টি ছাগল, বিধবা বেদেনা খাতুনের বাড়িতে ৮টি, আনজুয়ারা খাতুনের ৬টি, সাহানারা খাতুনের ৯টি, মজির উদ্দীনের বাড়িতে ২৬টি ছাগল রয়েছে।

সাহারবাটি গ্রামের ছাগল পালনকারী আত্তাফন নেছা, সাহানারা খাতুন, রোকেয়া খাতুন বেদেনা খাতুন ও আনজুয়ারা খাতুন বাংলানিউজকে জানান, গ্রামের নুরী খাতুনই তাদের ছাগল পালন করা শিক্ষা দিয়েছেন। নুরীকে দেখেই তারা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছেন। আজ তারা সফলও। ছাগল পালন করেই চলছে তাদের সবার সংসার। তাদের মতো গ্রামের প্রায় ২৫/৩০ জন নারী ছাগল পালন করে সংসার চালাচ্ছেন। এসব পরিবারের নারীদের এখন আর কারও কাছে অসহায়ের মতো হাত পাততে হয় না। সম্মানের সঙ্গেই বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন সবাই।

অনেকের সংসারে এখন লেগেছে দিন বদলের হাওয়া। অভাবের কারণে এক সময় যাদের সংসারে নুন আনতে পানতা ফুরাতো, আজ তাদের সংসারে রয়েছে আনন্দের বন্যা।

এদিকে, গাংনী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ছাগল পালনকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বেসরকারি এনজিও সংস্থাও এখন ছাগল পালনকারীদের উদ্বুদ্ধ করণের জন্য কাজ করছেন। ছাগল পালনকারী নারীদের বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়াও ছাগলের বসবাস উপযোগী স্বাস্থ্য সম্মত ঘর বানাতে অর্থ সহযোগিতা করছে এনজিও।

পলাশীপাড়া সমাজকল্যাণ সমিতির প্রকল্প পরিচালক কামরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গাংনী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছাগল পালন করছেন প্রায় ১২০০ জন নারী-পুরুষ। উপজেলায় ব্যক্তি পর্যায়ে প্রায় ২০০ ছোট-বড় খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামারে প্রায় ৬ হাজার ছাগল রয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ছাগল পালনকারীকে ছাগল সুস্থ রাখার করণীয় শীর্ষক প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এছাড়া ছাগল পালনকারী নারীদের ২ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। এ টাকা দেওয়া হয়েছে ছাগলের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ঘর বানানোর জন্য।

গাংনী উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মোস্তফা জামান বাংলানিউজকে বলেন, স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে অল্প সময়ের মধ্যে লাভবান হওয়ায় বর্তমানে গাংনী উপজেলার প্রতিটি গ্রামেই বাড়িতে বাড়িতে গড়ে উঠেছে ছাগল খামার। বর্তমানে উপজেলায় ছোট, মাঝারি ও বড় দিয়ে প্রায় শতাধিক খামার রয়েছে। গাংনী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠা এসব খামারে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ১৪৯টি ছাগল রয়েছে। ছাগল পালনকারীদের সরকারিভাবে বিনামূল্যে কৃমিনাশক ওষুধ, পিপিআর রোগের ভ্যাকসিন সরকারি মূল্যে দিয়ে থাকি। এছাড়া ছাগল পালনে বিভিন্ন পরামর্শ ও ছাগলের স্বাস্থ্য উপযোগী ঘর তৈরি করার পরামর্শ দিয়ে থাকে প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে। ছাগলের সংক্রামক রোগের তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়াও রুটিন মাফিক ভ্যাকসিন দেওয়া ও পরিদর্শনও করে বিভাগটি।  

তিনি আরও বলেন, ভৌগলিক কারণে মেহেরপুর জেলাটি উঁচু হওয়ায় ও প্রচুর চারণ ভূমি থাকার কারণে এখানে দেশীয় প্রজাতি ব্লাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালার একটি বড় সুযোগ রয়েছে।

গাংনী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ব্যক্তি উদ্যোগে ব্লাক বেঙ্গল ছাগলের ফার্ম গড়ে তুলে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন নারীরা।

উপজেলার সাহারবাটি, হিজলবাড়িয়া, চেংগাড়া, ধর্মচাকী, ভোমরদহ, মালশাদহ, গোপালনগর, নওপাড়া, চৌগাছা, বাওট, ছাতিয়ানসহ বিভিন্ন এলাকায় এখন অসহায় নারীরাই গড়ে তুলেছেন দেশীয় প্রজাতীর কালো ছাগলের (ব্লাক বেঙ্গল) খামার।

 

সমাজ থেকে পিছিয়ে পড়া অসহায় বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত নারীরা ছাগল পালনের মধ্য দিয়ে আর্থিক সংকট কাটিয়ে তারা তৈরি করেছেন স্বপ্নের সোপান। তাদের এ অর্জন দেখে সমাজের অবহেলিত ও আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া অন্য নারীরাও ছাগল পালনে এগিয়ে আসছেন।

অসহায় এসব নারীরা দেশীয় প্রজাতির ব্লাক বেঙ্গল ছাগল পালন করে যেমন তাদের অর্থনীতির চাকা ঘুরাচ্ছেন, তেমনি সমাজে তাদের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার পথও পেয়েছেন। উপজেলার বিভিন্ন মাঠে মাঠে তাই নারীদের ছাগল চরানোর দৃশ্য এখন প্রতিদিনের।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০২১
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।