ঢাকা, রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ১২ মে ২০২৪, ০৩ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি

টিসিবির লাইনে মধ্যবিত্ত, কার্যক্রম বাড়ানোর দাবি

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২
টিসিবির লাইনে মধ্যবিত্ত, কার্যক্রম বাড়ানোর দাবি টিসিবির পণ্য কিনতে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন

ঢাকা: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় কম দামে পণ্য পেতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক সেলের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণেই নিম্নবিত্তের সঙ্গে মধ্যবিত্তরাও এই লাইনে শামিল হচ্ছেন।

আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তাল মিলাতে না পেরে টিসিবির পণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন বলে অভিযোগ মধ্যবিত্তদের।

অন্যদিকে প্রতারকচক্র সংঘবদ্ধভাবে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে একাধিকবার পণ্য কিনে খোলা বাজারে বাড়তি দামে বিক্রি করছে। ফলে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পেয়ে খালি হাতে যেতে দেখা গেছে অনেককেই।

টিসিবির কর্মকর্তারা বলছেন, টিসিবির ট্রাক সেল গত বছরের তুলনায় আড়াই গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাদের মজুদ ও সরবরাহ ভালো আছে। পণ্যের মানও ভালো এবং দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় মানুষ তাদের পণ্য কিনতে আগ্রহী হচ্ছে। জনবল কম থাকায় প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সহায়তা করতে পারে।  

এদিকে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতিদিনই সমস্যা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে হুড়োহুড়ি হচ্ছে। আবার শেষ পর্যন্ত পণ্য না পেয়ে অনেকেই হতাশ হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পণ্য না পাওয়ার জন্য প্রতারকচক্রকে দায়ী করছেন ভোক্তারা। বিভিন্ন প্রতারকচক্র সংঘবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে একাধিকবার পণ্য কিনে খোলা বাজারে লাভে বিক্রি করছে।  

শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) টিসিবির মুখপাত্র বা জনসংযোগ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বাংলানিউজকে বলেন, ৪৫০টি ট্রাকের মাধ্যমে টিসিবি পণ্য বিক্রি করছে। প্রতিদিনের সাম্ভব্য স্পট আমরা আগের দিন জানিয়ে দেই। আসন্ন রমজানের সময়ে আমরা আরও ব্যাপকভাবে ভোক্তাদের কাছে টিসিবির পণ্য পৌঁছে দিতে পারবো। টিসিবির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যথেষ্ট পণ্য মজুদ রয়েছে এবং আরও পণ্য পাইপলাইনে আছে। টিসিবির প্রত্যাশা, ক্রেতারা পণ্য শেষ হওয়ার পরই আবার কিনবেন। কিন্তু দেখা যায়, অনেকে প্রতিদিনই পণ্য কেনেন। আর প্রতারকচক্র তো আছেই!

তিনি বলেন, পণ্যের মান ভালো এবং দাম অনেক কম হওয়ায় একটি চক্র একাধিকবার লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য নিয়ে লাভের জন্য খোলা বাজারে বিক্রি করে। তারাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অন্যদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত পণ্য পান না। আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক না, এজন্য আমরা শুধু ধমক দিয়ে লাইন থেকে বের করে দিতে পারি। এর বাইরে আমাদের করার কিছু থাকে না। কারণ প্রতারকদের ঠেকানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনীয় বাড়তি জনবল আমাদের নেই। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন সহযোগিতা করলে ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করেন তিনি।



আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি ট্রাকে করে পণ্য বিক্রির কর্মসূচি শেষ হলেও মার্চ থেকে আবারো শুরু হবে। রমজান মাসেও চলবে। এবার পণ্য এবং বিক্রির আওতা দুইটোই আরও বাড়ানো হবে। আর যারা ইতোমধ্যে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা পেয়েছেন, তাদের তালিকা করে তারা যাতে টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পণ্য পান তা নিশ্চিত করা হবে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, টিসিবি ন্যায্যমূল্যের টিসিবি চার ধরনের ভোগ্যপণ্যের বিক্রি করছে। এখন নিন্মবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রাক থেকে পণ্য কিনছেন। কিন্তু টিসিবির কার্যক্রম বর্তমান প্রেক্ষাপটে সীমিত ও ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ। মোট চাহিদার মাত্র ৫ থেকে ৮ শতাংশ পূরণ করতে পারে টিসিবি। তবে টিসিবির কার্যক্রম বাড়ানোর সুযোগ আছে। এজন্য সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে সমন্বয় করে টিসিবির কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।  

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলানিউজকে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো টিসিবির ট্রাক সেল। তবে এটা দিয়ে পুরো দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ টিসিবির যে সক্ষমতা আছে তা দিয়ে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ক্ষুদ্র একটা অংশ পূরণ করা সম্ভব। যারা টিসিবির পণ্য কিনবে পারবেন তারাই সুবিধা পাবেন।

তিনি বলেন, টিসিবির কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। সামনে রমজান, সে সময় যদি সরকার টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পণ্য দিতে পারে তাহলে ভোক্তারা একটু হলেও স্বস্তি পাবে। সরকার উপজেলা পর্যায়ে কার্যক্রম বাড়িয়েছে কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে ট্রাকে পণ্যের পরিমান বাড়িয়ে দিয়ে আরও বেশি সংখ্যক স্থানে দিতে হবে। সেটা ঢাকা শহরকেন্দ্রিক নয়, শহর-উপশহরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলেও টিসিবির কার্যক্রম বাড়াতে হবে। চলমান কার্যক্রম রামজান পর্যন্ত অব্যাহত রাখার প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রাখতে হবে, যাতে টিসিবি প্রয়োজনে আমদানি ও অভ্যন্তরীণ পর্যায় থেকে পণ্য সরবরাহ করে ভবিষ্যতে এর কার্যক্রম যেন বাড়িয়ে করতে পারে।

ক্যাব-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের হোসাইন বলেন, আসল কথা হলো মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে আয় বাড়ছে না। ফলে টিসিবির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। মধ্যবিত্তও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো ছাড়া তাদের উপায় নেই। কিন্তু সেখানেও পর্যাপ্ত পণ্য না থাকায় তারা হতাশ হচ্ছেন।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। টিসিবির ট্রাক সেলসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করে যাচ্ছে। টিসিবি সারা বাংলাদেশে ৪৫০ ট্রাকে ন্যায্যমূল্য তেল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ বিক্রি করছে, যা দিয়ে বাজারে ৫ থেকে ৮ শতাংশ প্রভাব ফেলতে পারছে। এ বছর রমজানের আগে ও রমজানে এক কোটি নিম্ন আয়ের মানুষকে দুইবার সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া গত এক বছরে টিসিবির কার্যক্রম দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি হয়েছে। কার্যক্রম আরও বৃদ্ধির চেষ্টা করছে সরকার।

টিসিবির ট্রাকের ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিসিবির পণ্যের মান এখন অনেক ভালো এবং দাম কম তাই মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। টিসিবির ট্রাক সেলে এক সময় কম দামে নিত্যপণ্য কিনতে আসতো নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা পেশায় ছিলেন দিনমজুর, রিকশাচালক, গাড়িচালক কিংবা গৃহকর্মী। এখন সেই লাইনে পণ্য কিনতে দাঁড়াচ্ছেন মধ্যবিত্তরাও।

ডিলাররা বলেন, লাইনে যারা দাঁড়ান শেষ পর্যন্ত তাদের সবাই পণ্য পান না। দুই-তিন ঘণ্টা দাঁড়ানোর পরও কেউ কেউ ফিরে যান। কারণ পণ্য সীমিত। এছাড়া এক শ্রেণির প্রতারকচক্রও রয়েছে, তারা দলবেঁধে লাইনে দাঁড়িয়ে একাধিকবার পণ্য কিনে বেশি দামে বাইরে বিক্রি করে দেয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও কিছু করার নেই। কারণ পরিস্থিতি সামলানোর মতো লোকবল আমাদের নেই।

টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সারাদেশে ৪৫০টি পয়েন্টে এখন ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরসহ ঢাকা বিভাগে ১০১টি পয়েন্টে পণ্য বিক্রি হয়। শুক্রবার বাদে সপ্তাহে প্রতিদিন প্রতিটি ট্রাকে দিনে ৬০০ লিটার সয়াবিন তেল, ৪০০ কেজি ডাল, ৫০০ কেজি চিনি এবং ৫০০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়।

টিসিবির ট্রাকে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা, মসুর ডাল প্রতি কেজি ৬৫ টাকা, চিনি ৫৫ টাকা, পেঁয়াজ ৩০ টাকা। আর সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, পণ্যগুলোর বর্তমান বাজার মূল্য যথাক্রমে ১৬৮ টাকা, ১০০ টাকা, ৮০ টাকা এবং ৩৮ টাকা। একজন ক্রেতা সয়াবিন তেল দুই লিটার, চিনি ও মসুর ডাল দুই কেজি এবং পেঁয়াজ সর্বনিম্ন দুই কেজি থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি কিনতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০২২
জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।