ঢাকা, রবিবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আজ কেরানীগঞ্জ গণহত্যা দিবস

উপজেলা করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০২২
আজ কেরানীগঞ্জ গণহত্যা দিবস

কেরানীগঞ্জ (ঢাকা): আজ ২ মার্চ কেরানীগঞ্জ গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক নিরস্ত্র বাঙালিকে নির্বিচারে গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

এ দিনটি ইতিহাসে কেরানীগঞ্জ দিবস বা জিনজিরা দিবস হিসেবে পরিচিত।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত কেরানীগঞ্জবাসীর ওপর হামলা চালায়। এতে স্থানীয়সহ আশ্রয়প্রার্থী বহু লোক প্রাণ হারান। সশস্ত্র পাকিস্তানি আর্মিরা হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয় ঘর-বাড়ি, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনায়। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বহু মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করে। রক্তের বন্যা বয়ে যায় প্রতিটি গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই বর্বর ঘটনা ‘কেরানীগঞ্জ গণহত্যা’ নামে পরিচিত।

এছাড়া ওইদিন রাতে পাকিস্তানিরা বুড়িগঙ্গার অন্য পাড়ের মিটফোর্ড হাসপাতাল দখল করে নেয় এবং হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদের ছাদ থেকে আনুমানিক ৫টায় ফ্লেয়ার ছুঁড়ে গণহত্যা শুরু করার জন্য সংকেত দেয়। আনুমানিক ভোর সাড়ে ৫টা থেকে শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞ একটানা ৯ ঘণ্টা চলে। যা শেষ হয় আনুমানিক আড়াইটায়। মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরের পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনী ৬০ জন লোককে একসঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।  

জিঞ্জিরা গণহত্যার পরদিন অর্থাৎ ৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্র জিঞ্জিরা গণহত্যাকে ধামাচাপা দিয়ে বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যা খবর প্রচার করে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা ‘মর্নিং নিউজ’র একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ’। আর তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশন ওইদিন ২ এপ্রিল রাতে খবর প্রচার করে, বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হুদা মাস্টার বাংলানিউজকে বলেন, কেরানীগঞ্জ ছিল শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা ও রাজধানীবাসীর প্রধান আশ্রয়স্থল। ২৫ মার্চের রাতে গণহত্যার পর থেকে ঢাকা শহরে নিরীহ লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দলে দলে কেরানীগঞ্জে আসতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা এ সংবাদ পেয়ে ২ এপ্রিল কেরানীগঞ্জে হামলা চালিয়ে প্রায় ৫ হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে।  

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বাংলানিউজকে বলেন, ২ এপ্রিল ভোরে যখন পাক সেনারা কেরানীগঞ্জে হামলা চালায় স্থানীয় যুবকরা প্রথমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হাজার হাজার নীরহ বাঙালিদের হত্যা করে। হত্যাযজ্ঞ শেষে পাকিস্তানিরা চলে গেলে সন্ধ্যার পর শহীদদের মরদেহ কালিন্দি, নেকরোজবাগ, ইমামবাড়ি, কসাইভিটা, নজরগঞ্জ ও কালীগঞ্জ কবরস্থানসহ বিভিন্ন স্থানে গণকবর দেয়া হয়। কোনো কোনো কবরে ১৫-২০ জনকেও রাখা হয়েছিল। এমনকি ধানক্ষেতেও শহীদদের মাটি চাপা দেওয়া হয়।  

কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা মহসিন মন্টু সেই দিনের ভয়ার্ত স্মৃতির বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, পুরো ঢাকা শহর তখন পাকিস্তানি সেনারা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। এই বন্দিনগরী থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রধান উপায় ছিল বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেয়া। পাকবাহিনী ২৫ মার্চ কাল রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ঢাকা শহরে কার্ফু দিয়ে মর্টার ও মেশিনগান চালিয়ে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করে। ২৬ মার্চ ২ ঘণ্টার জন্য কার্য শিথিল করলে ঢাকা শহরের আতঙ্কিত হাজার হাজার মানুষ কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, শুভাঢ্যা, আগানগর, কালিন্দী ও কামরাঙ্গীরচর হয়ে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়। কেরানীগঞ্জের প্রতিটি মানুষ অসহায় শরণার্থীদের সাহায্যে তাদের সঞ্চিত টাকা পয়সা, খাবার-দাবার সবকিছু উজাড় করে আপন করে নেয়। একটানা ৪-৫ দিন ধরে শরণার্থীদের সেবা করতে গিয়ে ১ এপ্রিল রাতে কেরানীগঞ্জবাসী যখন ক্লান্ত দেহে গভীর ঘুমে আচ্ছন, ঠিক তখনই ২ এপ্রিল ভোরে পাক হানাদার বাহিনীর মর্টার ও মেশিনগানের মুহুমুহু শব্দে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। ভোর ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত বর্বর পাক সেনারা নারকীয় তাণ্ডব চালায়। বর্বরোচিত তাণ্ডবে ওই দিন কেরানীগঞ্জে পাঁচ সহস্রাধিক নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারায়।  

তিনি আরও বলেন, ২৬ মার্চ কেরানীগঞ্জ থানা দখল ও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়। জাতীয় নেতাদের বড় অংশ এখানে আশ্রয় নেন এবং পরে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এ পথ দিয়ে শেখ ফজলুল হক মনি, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল মালেক উকিল, তোফায়েল আহমেদ ও শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ ভারতে পাড়ি জমান। ২৫ মার্চ ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ চলার ঘটনা ও জাতীয় নেতাদের কেরানীগঞ্জে আশ্রয়ের খবর বিবিসিতে প্রচার হলে পাক হায়েনার দল কেরানীগঞ্জে আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়, এরই ধারাবাহিকতায় ২ এপ্রিলের এই হত্যাযজ্ঞ।  

দিবসটি উপলক্ষে অন্যবারের মতো এবারও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডসহ শহীদ পরিবার নানা কর্মসূচি পালন করছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।