ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

নাটোরে এবার ৩০০ কোটি টাকার লিচু উৎপাদন

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৫ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২২
নাটোরে এবার ৩০০ কোটি টাকার লিচু উৎপাদন ছবি: বাংলানিউজ

নাটোর: লিচুর মৌসুম শুরু হলেই নাটোরের গুরুদাসপুর, বনপাড়া, আহম্মদপুরসহ পাইকারি বাজারগুলো বেশ জমে ওঠে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

ইতোমধ্যে গাছ থেকে লিচু নামানো শেষ পর্যায়ে পৌঁছালেও পাইকারি আড়তগুলোতে লিচু স্তূপাকারে রেখে বেচাকেনা চলছে সমান তালে। আর কয়েকদিন পরেই শেষ হবে লিচু বেচাকেনার মৌসুম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার লিচুর উৎপাদন বেশি হলেও আকারে একটু ছোট হয়েছে। তাই দামও অনেকটা কম। গত বছর প্রতি হাজার লিচু রকম ভেদে বিক্রি হয়েছে ২,২০০ টাকা থেকে ২,৪০০ টাকায়। সেখানে এবার আড়তগুলোতে পাইকারি দরে প্রতি হাজার লিচু বিক্রি হচ্ছে রকম ভেদে ১,২০০ টাকা থেকে ১,৭০০ টাকা দরে। অর্থাৎ প্রতি হাজার লিচুতে এবার গড়ে ৫০০ টাকা করে কম দাম পাচ্ছেন কৃষক ও সংশ্লিষ্ট বিক্রেতারা। এতে লিচু চাষিরা আর্থিক বিবেচনায় অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

অপরদিকে কৃষি বিভাগ বলছে, চলতি মৌসুমে নাটোর জেলায় লিচুর উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তাতে কৃষকরা আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হচ্ছেন। তাদের মতে জেলায় মোট লিচুর উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ৮৯৭ মেট্রিক টন। আর কেজি হিসাবে মোট লিচুর উৎপাদন দাঁড়ায় ৭৫ লাখ ২ হাজার ১৫০ কেজি। বাজার দর ৪০০ টাকা হিসাবে যার মূল্য দাঁড়ায় ৩০০ কোটি টাকা।

ছবি: বাংলানিউজ

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৯২৪ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। উৎপাদন ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৮৯৭ মেট্রিক টন বা ৭৫ লাখ ২ হাজার ১৫০ কেজি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১৬০ হেক্টর ও উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন, নলডাঙ্গা উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১৫ হেক্টর ও উৎপাদন হয়েছে ৯০ মেট্রিক টন, সিংড়া উপজেলায় আবাদ ৯৮ হেক্টর ও উৎপাদন ৭৮৪ মেট্রিক টন, গুরুদাসপুর উপজেলায় আবাদ ৪১০ হেক্টর ও উৎপাদন ৩ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন, বড়াইগ্রাম উপজেলায় আবাদ ৪০ হেক্টর ও উৎপাদন ৩২০ মেট্রিক টন, লালপুর উপজেলায় আবাদ ১০৫ হেক্টর ও উৎপাদন ৮২৫ মেট্রিক টন এবং বাগাতিপাড়া উপজেলায় আবাদ হয়েছে ৯৬ হেক্টর জমিতে ও উৎপাদন হয়েছে ৭৬৮ মেট্রিক টন।  

কৃষি বিভাগ জানায়, জেলায় সবচেয়ে বেশি লিচু উৎপাদন হয় গুরুদাসপুর উপজেলায়। গত বছরের চেয়ে এবার সেখানে ১০ হেক্টর বেশি আবাদ হয়েছে। এখানে মোজাফ্ফর, বোম্বে ও চায়না-৩ জাতের লিচু চাষ বেশি হয়ে থাকে। আর এই উপজেলার নাজিরপুরের লিচুর কদরও রয়েছে দেশজুড়ে। এজন্য এলাকার কানুমোল্লার বড়তলা, ঝাউপাড়া বিন্যাবাড়ি ও বেরগঙ্গারামপুর মিলে গড়ে উঠেছে ছোটবড় ১৭টি লিচুর আড়ত।

প্রতিদিন এ আড়তগুলো থেকে গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকার লিচু যায় রাজধানীসহ সারা দেশে। প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এসব আড়তের কর্মকাণ্ড। মে মাসের শুরু থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে এসব আড়ত। মৌসুমী এসব আড়তে প্রতিদিন আড়াই শ’ থেকে তিনশ’ জন শ্রমিক কাজ করে টাকা আয় করেন। এছাড়া জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া, আহম্মদপুর, শহরের স্টেশন বাজার, বাগাতিপাড়ার মালঞ্চিসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোটবড় আড়ত রয়েছে।

ছবি: বাংলানিউজ

গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. হারুনুর রশীদ বাংলানিউজকে বলেন, গুরুদাসপুরে এবার ২০৫টি বাগানে ৪১০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে, যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন। এখানকার লিচু সুস্বাদু হওয়ায় বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা কিনে নিয়ে যান এবং রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করেন। এবার গুরুদাসপুর উপজেলা থেকে ১৪০ কোটি ২২ লাখ টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এদিকে সরজমিনে গুরুদাসপুরের নাজিরপুর ইউনিয়নের বেড়গঙ্গারামপুর বটতলা লিচুর মোকামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি হাজার লিচু রকম ভেদে ১,২০০ টাকা থেকে ১,৭০০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। বাগান থেকে আনা লিচু উন্মুক্ত ডাকে কিনছেন পাইকার-ফড়িয়ারা। কেনা লিচুগুলো আড়তে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। শ্রমিকরা এসব লিচু দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য প্যাকেট করছেন।

এছাড়া সাধারণ ফড়িয়ারা ফলের পসরা সাজিয়ে সড়কের দুইপাশ কিংবা আড়তের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিচু বিক্রি করছেন। এখানে লিচুর আমদানি বেশি এবং দামে অন্যান্য এলাকার তুলনায় একটু কম হওয়ায় শহর ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে অনেকেই আসছেন লিচু কিনতে।

স্থানীয় কৃষক আব্দুল আলীম ও সোলায়মান আলী বাংলানিউজকে জানান, অনুকূল আবহাওয়া এবং উচ্চ তাপমাত্রায় চলতি মৌসুমে লিচুর ফলন ভালো হয়েছে। তবে আকারে একটু ছোট হওয়ার কারণে এবার দাম একটু কম হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি হাজারে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কম পাওয়া যাচ্ছে।

তারা আরও জানান, জেলার সবগুলো উপজেলাতে কমবেশি লিচু উৎপাদিত হয়। তবে গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম- এই দুই উপজেলার রয়না ভরট, জালশুকা, জোয়াড়ি, গোয়ালফা, আগ্রাণ, গুরুদাসপুর, নাজিরপুর, বিয়াঘাট, নারায়ণপুর, বেড়ঙ্গারামপুর ও শাহাপুর কালীনগর এলাকা লিচু গ্রাম নামে খ্যাত। আর আগাম ফলন ও ভালো দাম পাবার আশায় গুরুদাসপুরের নাজিরপুর এলাকায় বেশিরভাগ চাষি মোজাফ্ফর জাতের লিচু বাগান করেছেন। লিচু সুন্দর, মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদাও রয়েছে দেশ জুড়ে।

স্থানীয় আড়তদার ও মেহেদী ফল ভাণ্ডারের মালিক মো. আব্দুল মান্নান বাংলানিউজকে বলেন, লিচুর উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে গুরুদাসপুরে ছোট-বড়  ১৭টি আড়ত গড়ে ওঠেছে। এবারও প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ ট্রাক লিচু যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্রগ্রাম, যশোর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।  

তবে এবার লিচুর উৎপাদন বেশি হলেও দাম গত বছরের তুলনায় কম। পাইকার বা ক্রেতাদের আনাগোনাও কম বলে দাবি করেন তিনি। একই কথা জানান আল্লাহর দোয়া ফল ভাণ্ডারের মালিক সেলিম হোসেন, ভাই ভাই ফলভাণ্ডারের মালিক বজলুর রশীদ ও আব্দুল গফুর।

ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী আমিনুল ও সোহাগ রানা বাংলানিউজকে বলেন, গত ১০ বছর ধরে এসব আড়ত থেকে লিচু কিনে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করছি। এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো। লিচুর রঙ, আকার এবং স্বাদও বেশ ভালো। এখানকার লিচুর বেশ কদর রয়েছে। তাই প্রতি বছরের মতো এবারও লিচু কিনে ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। এ পর্যন্ত তারা ৪ ট্রাক লিচু ঢাকায় পাঠিয়েছেন।

স্থানীয় লিচু আড়ত কমিটির সভাপতি মো. সাখাওয়াত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, চলতি মৌসুমে লিচুর হাট ঘিরে ১৭টি আড়তের ইজারা মূল্য ডাকা হয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। প্রায় ১৫ বছর ধরে এখানে লিচু বেচাকেনা চলছে। ক্রেতা, বিক্রেতা ও কৃষকদের সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া হয়। কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে বিষয়ে আড়ত কমিটির পক্ষ থেকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। পাশাপাশি মৌসুম জুড়ে থানা পুলিশও নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ ড. ইয়াছিন আলী বাংলানিউজকে বলেন, এই জেলায় মোজাফ্ফর জাতের লিচুর চাষ বেশি হয়। এছাড়া বোম্বে ও চায়না-৩ জাতের লিচু চাষ হয়ে থাকে। এবার লিচুর উৎপাদন বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় দাম কিছুটা কম হলেও উৎপাদন বাড়ায় কৃষকরা লাভবান হবেন। বাগান থেকে লিচু নামানো প্রায় শেষ, বিক্রিও অনেকটা শেষ পর্যায়ে। আশা করা যাচ্ছে, এবার জেলায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০২২
এনএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad