ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দাদন ব্যবসায়ীর চাপে ৬ বছর বাড়ি ফেরেননি ব্রোজেন

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০২২
দাদন ব্যবসায়ীর চাপে ৬ বছর বাড়ি ফেরেননি ব্রোজেন ব্রোজেনের ভাই, পাশে বাড়ি

লালমনিরহাট: এক হাজার টাকায় মাসিক সুদ ছয়শ’ টাকা। সুদখোর মহাজনের চাপে সপরিবারে গ্রাম ছাড়ার ছয় বছর পরও বাড়ি ফেরেননি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কৃষক ব্রোজেন্দ্র নাথ ব্রোজেন (৫৩)।

ব্রোজেন উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের মহিষাশ্বহর গ্রামের জামতলা এলাকার বাসিন্দা।

স্থানীয়রা জানান, ব্রোজেন কৃষি কাজ করে এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সুখেই ছিলেন। সাত/আট বছর আগে এক বন্যায় তার গ্রামে ধানক্ষেত নষ্ট হলে বিপাকে পড়েন তিনিসহ অন্য কৃষকরা। সংসার চালাতে চড়া সুদে স্থানীয় রাজ মোহাম্মদের ছেলে চিহ্নিত দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলামের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নেন ব্রোজেন। তবে এ ঋণের খবর তার পরিবার ছাড়া কেউ জানত না। প্রায়ই সেই সুদের টাকার জন্য সুদখোর মহাজন দলবল নিয়ে তার বাড়িতে আসতেন।

সুদের টাকা শোধ দিতে না পেরে গত ২০১৬ সালে হঠাৎ এক রাতে পরিবার নিয়ে বাড়ি ছাড়েন ব্রোজেন। বৃদ্ধ বাবা সুরেন্দ্রনাথ প্রতিটি রাত ছেলের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে গুণতে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রোজেন সপরিবারে নিরুদ্দেশ হওয়াও খবর পেয়ে দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুল দলবল নিয়ে ব্রোজেনের বৃদ্ধ বাবাকে ১৩ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দেন। জাহেদুল তার লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে বৈঠক করে সুদ কমিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা দিলে বিষয়টি মিটমাট করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর সেই সাড়ে চার লাখ টাকা পরিশোধের জন্য ব্রোজেনের বাবাকে চাপ দিতে থাকেন জাহেদুল। টাকা না থাকায় ব্রোজেনের বাবা বাধ্য হয়ে চাষাবাদের ৫৪ শতাংশ জমি জাহেদুলকে দিয়ে দেনা মেটান। পরে জাহেদুল অন্যের কাছে ওই জমি বিক্রি করে টাকা নেন। জমি ৫৪ শতাংশ বিক্রি করেও ছেলে এবং তার পরিবারের খোঁজ না পেয়ে শোকে দুই বছর আগে মারা যান সুরেন্দ্রনাথ। দীর্ঘ ছয় বছরেও কোনো খোঁজ নেই ব্রোজেন্দ্র নাথের পরিবারের।

ব্রোজেনের ভাই গজেন্দ্রনাথ বলেন, ব্রোজেন সম্ভবত ৫০ হাজার টাকা ঋণ করেছিল। যা সুদে আসলে দাঁড়ায় ১৩ লাখ টাকায়। আমরা জমি বিক্রি করে সাড়ে চার লাখে দেনা মিটিয়েছি। তবে বৈঠকে দেখানো স্ট্যাম্পটি আজও ফেরত দেননি জাহেদুল। নিখোঁজ ভাইয়ের কোনো সন্ধানও মেলেনি।  

শুধু ব্রোজেন্দ্রনাথই নয়, জাহেদুলের সুদের চক্রে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে স্থানীয় একরামুল হকের পরিবারও। তিনিও হাজারে দৈনিক ১৫ টাকা সুদে দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুলের কাছ থেকে চার লাখ টাকা ধার নিয়েছিলেন। সেই টাকার সুদই দিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ। এরপরও ১৩ লাখ টাকা দাবি করেন সুদখোর মহাজন। সুদের টাকার জন্য দাদনের লাঠিয়াল বাহিনী প্রায়ই বাড়িতে এসে হামলা চালাত। একপর্যয়ে একরামুল হক বাড়ির উঠানের জমিটুকু বিক্রি করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে আপোস করেন। কিন্তু বাকি সাত লাখ টাকা দেখা হলেই দাবি করেন জাহেদুল।

গেল মাসে সেই সাত লাখ টাকার জন্য একরামুলের স্ত্রীকে বাড়ির পাশে একা পেয়ে আটকে গালমন্দ ও মারপিট করেন জাহেদুল। পরে স্থানীয়রা ওই গৃহবধূকে দাদন ব্যবসায়ীর কবল থেকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় ওই দিনই ভিকটিম আদিতমারী থানায় লিখিত অভিযোগ করেন।  

একরামুলের স্ত্রী বলেন, সুদ দেওয়ার পরও জমি বিক্রি করে বৈঠক করে পাঁচ লাখ টাকা জাহেদুলকে বুঝিয়ে দিয়েছি। এরপরও আরও টাকা দাবি করে। তা না দেওয়ায় আমাকে আটক করে মারধর করেছে। এ ঘটনায় ওই দিনই থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু এখনো সেটি মামলা হিসেবে নেয়নি পুলিশ। এক মাস হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রথম দিকে আপোস করে দিতে চাইলেও ১৫/২০ দিন ধরে পুলিশ কিছু বলছে না। শুনেছি, বর্তমান ওসির নানার বাড়ি পাশের গ্রামে। সেই সূত্রে দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুলের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন বর্তমান ওসি।

এতেই শেষ নয়, একই গ্রামের স্কুল শিক্ষক আনিচুর রহমান মাত্র ৯০ হাজার টাকা নিয়ে সুদ দিয়েছেন সাত লাখ। এরপরও আসল ৯০ হাজার টাকার জন্য প্রায়ই চাপ দেন দাদন ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলাম।

জাহেদুল ইসলাম ছাড়াও ওই গ্রামে দাদনের ব্যবসা করেন মতিয়ার রহমান ও আতিয়ার রহমান নামে দুই ভাই। তাদের একজন মতিয়ার রহমান দেড় মাস আগে সুদের দেড় লাখ টাকার জন্য স্কুলশিক্ষক আনিচুরকে স্থানীয় হাটে আটক করে কোমড়ে গামছা বেঁধে আদিতমারী থানায় নিয়ে যান। সেখানে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোক্তারুল ইসলামের উপস্থিতিতে ঋণ শোধের শর্তে মুক্তি মেলে স্কুল শিক্ষকের। সেদিন থানায় সিদ্ধান্ত হয়, তিন মাস পর মাসিক পাঁচ/সাত হাজার টাকা কিস্তিতে সুদের টাকা পরিশোধ করতে হবে। বাংলানিউজকে এ তথ্য জানান ভুক্তভোগী স্কুলশিক্ষক আনিচুরের স্ত্রী।

শুধু আনিচুর, ব্রোজেন বা একরামুলই নন, দাদন ব্যবসায়ীদের চক্রে নিঃস্ব হয়েছে মহিষাশ্বহর গ্রামটি। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে নদীর পানির কারণে অনাবাদি গ্রামটির সব জমি। চড়া সুদের বা সুদখোরদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করেও সুফল পাননি স্থানীয়রা। তাদের লাঠিয়াল বাহিনী ছাড়াও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে দারুন সখ্য রয়েছে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।  

আদিতমারী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি-তদন্ত) রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, দাদন ব্যবসার কোনো বৈধতা নেই। সেদিক থেকে তাদের সাপোর্ট দেওয়ারও সুযোগ নেই।  

এক মাসেও গৃহবধূর অভিযোগ আমলে না নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।