লন্ডন: বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধদের সাম্প্রতিক উত্থান ও অপতৎপরতার উপর নির্মিত লেখক ও মানবাধিকার কর্মী শাহরিয়ার কবিরের ‘হোয়েদার বাংলাদেশ’ শীর্ষক ডকুমেন্টারি দেখতে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষপাতমূলক ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করলেন ১৯৯৬ সালে ব্রিটেনে পালিয়ে আসা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের উপর নির্মিত ওয়ারক্রাইম ফাইলের প্রডিউসার বিশিষ্ট ব্রিটিশ সাংবাদিক গীতা সায়গল।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক আব্বাস ফয়েজের সামনেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে এই সংগঠনটির পক্ষপাতমূলক ভূমিকায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান গীতা।
যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে এই ডকুমেন্টারি প্রদর্শনীতে গীতা সায়গল ছাড়াও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, হাইকমিশনার আব্দুল হান্নান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আব্বাস ফয়েজ, ডেইলি এক্সপ্রেসের সাংবাদিক টেড জুরি, ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সুলতান শরীফ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের স্থানীয় সংগঠক ও কাউন্সিলার খলিল কাজি, মানবাধিকার কর্মী আনসার আহমেদ উল্লা ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক জামাল খান ও পুষ্পিতা গুপ্ত প্রমুখ।
প্রদর্শনী পরবর্তী প্রশ্নোত্তর পর্ব ও আলোচনা অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ডেপুটি হাইকমিশনার খোন্দকার মোহাম্মদ তালহা। প্রদর্শনী শেষে ডকুমেন্টারিটি
সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় আব্বাস ফয়েজ ৭১ এর গণহত্যা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এই নৃশংস গণহত্যা মানব সভ্যতার একটি বিভীষিকাময় অধ্যায়। গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।
মত যাই থাকুক এই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার পাওয়া ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায্য অধিকার।
অ্যামনেস্টি প্রতিনিধি আরও বলেন, আমরা চাই ভিকটিমরা ন্যায্য বিচার পাক, এটি তাদের মানবাধিকার। পাশাপাশি অভিযুক্তরাও যেন ন্যায্য আইনি সহায়তা ও স্বচ্ছ বিচার পায়, তাদের এ মানবাধিকারও বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। আব্বাস এ সময় মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অ্যামনেস্টির অবস্থানটি আবারও জানান দেন অডিয়েন্সকে।
আব্বাস ফয়েজের পরই বক্তব্য দিতে ওঠেন সাংবাদিক গীতা সায়গল। তিনি আব্বাস ফয়েজের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, অ্যামনেস্টি শুধুমাত্র বাংলাদেশের একাত্তরের গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলবে আর পৃথিবীর অন্যান্য অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে কোন ভূমিকা রাখবে না এটি তো হয় না। তিনি আব্বাস ফয়েজের উদ্দেশ্যে বলেন, অ্যামনেস্টির মত একটি সংগঠনকে বিতর্কের বাইরে রাখতে বাংলাদেশের ওয়ারক্রাইম ট্রায়াল ও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে পক্ষপাতমূলক বক্তব্য রাখা বন্ধ করতে হবে। গীতা বলেন, বাংলাদেশের জনগণ যখন তাদের হৃদয়ের দীর্ঘ ক্ষত সারাতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আজ ঐক্যবদ্ধ, তখন যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকারের নামে অ্যামনেস্টির মত কিছু সংগঠনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা জনপ্রত্যাশার বিরুদ্ধে এমনটিই ভাবছে বাংলাদেশের জনগণ।
বক্তৃতায় বিশ্বের অন্যান্য স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সরবতা না দেখিয়ে শুধুমাত্র একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকার রক্ষায় অ্যামনেস্টির কেন এই সরবতা ? অনুষ্ঠানে উপস্থিত আব্বাস ফয়েজের দিকে এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন ওয়ারক্রাইম ফাইলস এর প্রডিউসার গীতা সায়গল। এরপর অবশ্য আব্বাস ফয়েজের আর গীতা সায়গলের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন সুযোগ হয়নি।
অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত সুধীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ‘হোয়েদার বাংলাদেশ’ এর নির্মাতা মানবাধিকার কর্মী শাহরিয়ার কবির। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তির জবাবে তিনি বলেন, সংখ্যা অনেকেই অনেকটা দিতে পারে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারি হিসেবটি হলো আসল অফিসিয়াল হিসেব। গবেষক, লেখক, যারাই এ বিষয়ে কিছু লিখতে চান সরকারি হিসেবটিই তাদের নিতে হবে। শাহরিয়ার কবির বলেন, হলোকাস্ট এ প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছিলো, এটি ইউরোপের সরকারি হিসেব। এই হিসেব নিয়ে প্রশ্ন তোলা এখানে অপরাধ হলে একাত্তরের গণহত্যায় নিহত সরকারি হিসেব নিয়ে প্রশ্ন তোলা কেন অপরাধ হবে না। মৃত্যুদণ্ড নিয়ে অ্যামনেস্টি সহ কোন কোন দেশের আপত্তি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার কবির বলেন, যারা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাই, প্রতিটি দেশের একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা আছে। আমরা যেমন মৃত্যুদণ্ড বিরোধীদের অবস্থানকে শ্রদ্ধার চোখে দেখি, ঠিক তেমনি তাদেরও আমাদের দেশের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত।
এর আগে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী। শাহরিয়ার কবিরের প্রশংসা করে তিনি বলেন, সেক্যুলার বাংলাদেশ রক্ষার আন্দোলনের মূল প্রতীক হিসেবেই এখন আমরা শাহরিয়ার কবিরকে দেখি। বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে তথ্য উপাত্ত সমৃদ্ধ যেসব ডকুমেন্টারি তিনি প্রকাশ করছেন, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতার মত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এগুলো সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ধর্মান্ধ, জঙ্গিবাদ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করে বলেন, বাংলাদেশ সরকার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যে ভূমিকা রাখছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছেও তা আজ প্রশংসিত।
হাইকশিনার আব্দুল হান্নান বাংলাদেশের সেক্যুলার রাষ্ট্রচেতনা রক্ষায় বর্তমান সরকারের অব্যাহত সংগ্রামে বিদেশি বন্ধু ও প্রবাসীদের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিয়ে যাওয়া এই রাষ্ট্র কখনই তাঁর সেক্যুলার চেতনা হারাতে পারে না, এই প্রজন্মকে এটি নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৪