ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতি

সরকারকে খালেদার সাত দফা

বাংলানিউজ টিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪
সরকারকে খালেদার সাত দফা ছবি: কাশেম হারুন/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সরকারকে সাত দফা প্রস্তাবনা দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটনেতা খালেদা জিয়া।

বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় গুলশানে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন।


 
খালেদা জিয়া বলেন,  দেশে যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান না হলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। সুতরাং এই সংকট উত্তরণে অনতিবিলম্বে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অবাধ, নিরপেক্ষ, ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে।
 
সেই লক্ষ্যে আমরা প্রস্তাব করছি, জাতীয় সংসদের নির্বাচন অবশ্যই একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। যাতে সকল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করতে পারে এবং সকল পক্ষের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হবে।

নির্বাচন ঘোষণার আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ, দক্ষ, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
 
নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর সম্মতিক্রমে গঠিত নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
 
নির্বাচনের উপযোগী শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে তারিখ ঘোষণার পরপরই বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করতে হবে।
 
নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরুর আগেই চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট ও বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত সদস্যদের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে প্রত্যাহার এবং কর্তব্যপালন থেকে বিরত রাখতে হবে।
 
সকল রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাসমূহ প্রত্যাহার করতে হবে।
 
বর্তমান সরকারের আমলে বন্ধ করে দেয়া সকল সংবাদপত্র ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল খুলে দিতে হবে। মাহমুদুর রহমানসহ আটক সকল সাংবাদিককে মুক্তি দিতে হবে।

প্রস্তাবনা উত্থাপনের পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তবে সব প্রশ্নের উত্তরই ছিলো অস্পষ্ট।
 
আগাম নির্বাচনের কোনো আভাস পেয়ে তিনি এ প্রস্তাবনা উপস্থাপন করলেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, তাদেরকে এক বছর সময় দেওয়া হয়েছে। আর সময় দেওয়া যায় না। জনগণ এখনই নির্বাচন চায়। তাই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিতে হবে।

রাজবন্দি বলতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আটক জামায়াত নেতাদের বোঝাচ্ছেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, যদি কেউ অপরাধ করে থাকে তাহলে ফেয়ার ট্রাইয়ালের মাধ্যমে তাদের বিচার হতেই পারে। কিন্তু মিথ্যা মামলায় অনেককে আটক রাখা হয়েছে। সে ব্যাপারেই আমরা কথা বলছি।
 
তার দেওয়া সাত দফা প্রস্তাবনা মেনে নিয়ে জাতীয় সংকট নিরসনের আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা জনমত গঠনের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ঘোষণা করছি এবং ঐক্যবদ্ধভাবে একটি জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলতে সকল গণতান্ত্রিক দল, শক্তি ও ব্যক্তির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
 
পর্যাক্রমে ধারাবাহিক কর্মসূচি দেওয়া হবে জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে জনগণের ভোটাধিকার হরণের দিন ৫ জানুয়ারিকে আমরা ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসাবে পালনের আহ্বান জানিয়েছি।

তিনি বলেন, গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের লক্ষ্যে ঐ দিন সারা- দেশে সভা-সমাবেশ ও কালোপতাকা বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় একটি সমাবেশ করতে চেয়েছি। আশা করি আমাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে। বাধা দিয়ে, আক্রমণ করে জনগণের আন্দোলন  দমানো যাবে না।

হীনপন্থায় ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্রক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছে অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, ভোট ছাড়াই ক্ষমতা দখলের কারণে জনগণের কল্যাণ তাদের কাছে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা কোনো ধরনের জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে না। তারা বলেছিল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার প্রয়োজনে নাকি ৫ জানুয়ারির  ভোটারবিহীন তথাকথিত নির্বাচন করতে হয়েছে। খুব শিগগিরই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তারা নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার করেছিল।
 
কিন্তু তারপর একটি বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এবং সিভিল সমাজসহ সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকবৃন্দ একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সমঝোতার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল সকল দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার আহ্বান জানিয়ে আসছে-দাবি খালেদা জিয়ার।
 
তিনি অভিযোগ করেন, নিজেদের দেওয়া অঙ্গীকারও এখন আর আওয়ামী লীগ মানছে না। তারা যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। তারা বলছে, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নাকি গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষা পেয়েছে। এই দাবি সম্পূর্ণ যুক্তিহীন।

আরেকটি আগাম নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির কাছে লিখিত কোনো অঙ্গীকার আওয়ামী লীগ করেছিলো কি না জানতে চাইলে খালেদা জিয়া বলেন, তারা তো প্রকাশ্যেই বলেছিলো, নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন দেবে। এখানে লেখালেখির কী আছে?
 
গাজীপুর সমাবেশ করতে না পারার দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে তিনি বলেন, দেশবাসী দেখেছে, কী ফ্যাসিবাদী কায়দায় গাজীপুরে আমাদের সমাবেশ করতে দেওয়া হলো না। আমাদের সমাবেশস্থলে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে একটি পাল্টা সমাবেশের ঘোষণা তারা দেয়। আর প্রশাসন সেই বেআইনি সমাবেশ আহ্বানকারীদের নিরস্ত না করে ১৪৪ ধারা জারি করে। আমাদের সমাবেশ বন্ধ করে দেয়। গাজীপুরে আমাদের নেতা-কর্মীরা মিছিল করতে চাইলে পুলিশ তাদের ওপর আক্রমণ করে।
 
পুলিশি ছত্রছায়ায় ক্ষমতাসীনদের সমর্থক সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে মহড়া দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, মিথ্যা মামলায় অস্থায়ী আদালতে আমি হাজিরা দিতে যাওয়ার সময় আমাদের নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষ ও আমার গাড়িবহরের উপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায় সশস্ত্র হামলার দৃশ্য আপনারা দেখেছেন। সশস্ত্র হামলাকারীদের নাম-পরিচয় ও ছবিসহ সংবাদমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে। সেই সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার দূরে থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়নি। অথচ আমাদের দলের অসংখ্য নেতা-কর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের গ্রেফতার ও হয়রানি করা হচ্ছে।
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বড় ছেলে তারেক রহমানের দেওয়া বক্তব্য সমর্থন করেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, তারেক সরাসরি শেখ মুজিবকে রাজাকার বলেননি। তিনি যা বলেছেন, তা তথ্যের ভিত্তিতে বলেছেন। আমরা বলেছি, তার দেওয়া বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করতে চাইলে তা তথ্যের ভিত্তিতে সরকার করতে পারে।
 
৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এ নিয়ে ৩ বার সংবাদ সম্মেলনে এলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রথমবার ১৫ জানুয়ারি হোটেল ওয়েস্টিনে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। সে সময় খালেদা জিয়া বলেন, এই সরকারকে বেশিদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় রাখা বিপজ্জনক হবে।
 
দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনটি করেন সদ্য শেষ হওয়া বছরের ৪ ফ্রেব্রুয়ারি। এ সংবাদ সম্মেলন থেকে খালেদা জিয়া নির্বাচনের আগে ও পরে সারাদেশে নিহত নেতা-কর্মীদের একটি তালিকা তুলে ধরেন এবং অবিলম্বে সংলাপে বসতে সরকারকে আহ্বান জানান।
 
এর পর দীর্ঘ প্রায় ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো সংবাদ সম্মেলন করেননি বিএনপি চেয়ারপারসন। তবে সভা-সমাবেশে ও ঘরোয়া অনুষ্ঠানে অসংখ্যবার কথা বলেছেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গণি,  লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, এমকে আনোয়ার,  ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা আব্বাস,  ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার, সারোয়ারী রহমান, খালেদা জিয়ার প্রেস সেক্রেটারি মারুফ কামাল খান সোহেল প্রমুখ।
 
জোট নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এলডিপির চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীরবিক্রম, জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য রেদওয়ান উল্লাহ শাহেদী, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামী, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, জাতীয় পার্টির (জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি এইচ এম কামরুজ্জামান খান, ইসলামিক পার্টির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল মবিন, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনপিপির চেয়ারম্যান ডা. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, পিপলস পার্টির (পিএল) চেয়ারম্যান গরীবে নেওয়াজ, ন্যাপ ভাসানীর চেয়ারম্যান মো. আজহারুল ইসলাম, ডেমোক্রেটি লীগের (ডিএল) সাধারণ সম্পাদক সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক সাঈদ আহমেদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা মহিউদ্দীন একরাম প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১,২০১৪/আপডেট ২২০৯ ঘণ্টা
 
** যখন প্রয়োজন রাজপথে থাকবেন খালেদা
** তারেক তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলেছেন, দাবি খালেদার
** যুদ্ধাপরাধ বিচারে মিথ্যা মামলার অভিযোগ খালেদার
** বুঝে-শুনে কথা বলবেন, কাজ করবেন: খালেদা
** ‘সরকার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি মানছে না’
** ‘জাতীয় সংকট ঘনীভূত হচ্ছে’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।