ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ মাঘ ১৪৩১, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩ রজব ১৪৪৬

রাজনীতি

বৃহস্পতিবার যশোর আ.লীগের সম্মেলন

পদে থাকতে মরিয়া শাহীন চাকলাদার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৫
পদে থাকতে মরিয়া শাহীন চাকলাদার শাহীন চাকলাদার

ঢাকা: প্রায় ১২ বছর পর হতে যাওয়া যশোর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে ফের সেক্রেটারি পদ নিজের দখলে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন শাহীন চাকলাদার। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে তাই তার সমর্থনে খুনিসহ দুর্ধর্ষ অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে শহর ও শহরতলীতে।



জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি প্রার্থী ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদারের বিজয় নিশ্চিত করতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও চাঁদাবাজির লক্ষ্যে তাদের জড়ো করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

এ সন্ত্রাসী চক্রটি ইতিমধ্যে কাউন্সিলরদের হুমকি ধামকি ও ভয়ভীতি দেখানো শুরু করেছে। কাউন্সিলরদের বলে দেয়া হয়েছে, শাহীনের পক্ষে সিলেকশন দাবিরও। এ অপরাধ তৎপরতায় সব ধরণের সহযোগিতা করছেন যশোর কোতোয়ালী থানার ওসি। যে কারণে নির্ভয়ে কাজ করে যাচ্ছে তার অপরাধ সহযোগীরা।

 ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে শাহীন চাকলাদারকে চিনতো না যশোরবাসী। ওই সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবার পর দীর্ঘ সময়ে তিনি বিভিন্ন পরিচয়ে নিজেকে আর্বিভূত করেছেন। বিশেষ করে ঠিকাদার, সন্ত্রাসী, খুনি, মাদক ব্যবসায়ীদের গডফাদার হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছেন। এতদাঞ্চলের যেসব সন্ত্রাসী গ্রুপ ছিল সেগুলোর অধিকাংশই এখন তার ছত্রছায়ায় পরিচালিত হয়। যে কারণে শাহীন চাকলাদার নামটি এখন যশোরবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। আর এ প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে জনপ্রতিনিধির তকমা লাগাতে দু’বার ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে।

 কে এই শাহীন চাকলাদার
চাকলাদার পরিবহন শাহীন চাকলাদারের পারিবারিক ব্যবসা। দেশ স্বাধীনের পর থেকে তারা এ ব্যবসা করে আসছেন। মূলত পরিবহন ব্যবসা দিয়েই চাকলাদার পরিবার যশোরে পরিচিতি লাভ করে। তার পিতা মরহুম আবদুল মান্নান চাকলাদার ছিলেন তহশিলদার। তিনি ১৯৮৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

শাহীন চাকলাদারের দেয়া তথ্যানুযায়ী, তিনি ১৯৮৭ সালে বিএ পাস করেন। পরবর্তী সময়ে পরিবহন ব্যবসার পাশাপাশি তিনি ঠিকাদারি ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তবে বর্তমান সরকারের সময় তার নানামুখী ব্যবসার পরিধি বেড়েছে।

১৪ বছর আগেও একটি ওষুধের দোকান চালাতেন তিনি। এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলার ‘নির্বাচিত’ চেয়ারম্যান। মাত্র ১৪ বছরের ব্যবধানে হয়েছেন প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। বনেছেন বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও।
 
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই আলোচিত চরিত্রে পরিণত হন শাহীন চাকলাদার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যশোরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেন তিনি।

তার দাপটে রাজনীতি থেকে প্রায় উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরিফ আবদুর রাকিবের কাছে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে শাহীন চাকলাদার এসেছিলেন একটি ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার তদবির করতে। স্ত্রীর সঙ্গে দূরসম্পর্কের আত্মীয়তার সূত্রে রাকিবকে সেসময় তিনি খালু বলে ডাকতেন।

সন্ত্রাসের অভিযোগ
যশোরের রাজনৈতিক অঙ্গনে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মরিয়া শাহীন চাকলাদার। এজন্য তিনি সমাজের চিহ্নিত অপরাধীদের জড়ো করে আলাদা একটি ইউনিট গড়ে তোলেন। তার চাচাত ভাই যুবলীগ সেক্রেটারি রেন্টু চাকলাদার, ফন্টু চাকলাদার, সদর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহারুল ইসলাম ও ফারুক হোসেন সিরুর নেতৃত্বে ইউনিট সদস্যরা শহরে সক্রিয়। এই গ্রুপের অর্ধশতাধিক সদস্য প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কাঁঠালতলায় শাহীন চাকলাদারের প্রিন্টিং অফিসে মিলিত হয়ে অ্যাকশন প্লান করে। এদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলাও রয়েছে।

অনেক আগে থেকেই শাহীন চাকলাদার যশোর শহরে সন্ত্রাসের জনক হিসেবে পরিচিত। এ পরিচিতির প্রভাবও পড়ে তার নির্বাচনী প্রচারণায়। বর্তমান সরকারের শুরুতে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হন। এ সময় তার পক্ষে নির্বাচনে কাজ করার জন্য তার ক্যাডার বাহিনী মাঠে নামানো হয়। নির্বাচনে খুব সহজেই তিনি জয়ের মালা ছিনিয়ে নেন। কিন্তু সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরও সদর উপজেলার ১৩জন ইউপি চেয়ারম্যান তাকে মেনে নিতে পারছিলেন না। এসব বিষয় নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের দূরত্ব বাড়তে থাকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, ৩০ জুলাই ২০১৩ উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় শাহীন চাকলাদার একক ক্ষমতা চেয়ে রেজুলেশন করার উদ্যোগ নেন। উপস্থিত ইউপি চেয়ারম্যানরা বিরোধিতা করেন। একপর্যায়ে জোর করেই রেজুলেশনের উদ্যোগ নিলে তারা সভা বর্জন করেন। ইউপি চেয়ারম্যানরা বাইরে বেরুনোর আগেই শাহীন চাকলাদারের নির্দেশে উপজেলা পরিষদের গেটে তাদের ওপর হামলা চালায় তার চাচাতো ভাই ফন্টু চাকলাদার ও সদর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহারুল ইসলামসহ একদল সন্ত্রাসী। পরবর্তী সময়ে এ ঘটনায় মামলা হলেও শাহীন চাকলাদারের ক্ষমতার দাপটের কাছে তারা টিকতে পারেননি।

২০০৯ সালে বিমানবন্দর সড়কে ইউনুস আলী নামে এক চালককে হত্যার অভিযোগে যুবলীগ কর্মী সোহাগকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি শাহীন চাকলাদেরই সক্রিয় সদস্য। তাকে ছাড়িয়ে নিতে শাহীন চাকলাদার তদবিরও করেন।

২০১০ সালের ১৪ মার্চ সদর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রিপন হোসেন ওরফে দাদা রিপনকে শাহীন চাকলাদার সিন্ডিকেটের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। এ হত্যা মামলায় শাহীন চাকলাদার ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত শাহারুল মদদদাতা ছিলেন বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়। জীবনের ভয়ে ও পুলিশের চাপের মুখে রিপনের বাবা হুকুমের আসামি হিসেবে তাদের নাম উল্লেখ করতে পারেননি। তবে, মামলার বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন দুজনের নাম।

২০১১ সালের ২৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ের সামনে এক ট্রাফিক পুলিশকে চড় মারার ঘটনায় শাহীন চাকলাদার তেজগাঁও থানায় তিনঘণ্টা আটক ছিলেন। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতির সময় আওয়ামী লীগের এক শীর্ষনেতার হস্তক্ষেপে তিনি মুচলেকা দিয়ে গভীর রাতে ছাড়া পান। এ ব্যাপারে একটি জিডি করা হয়।

২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর যশোর শহরের সদর হাসপাতাল মোড় এলাকা দুপুরে আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের বেশুমার বোমাবাজি আর মুহুর্মূহু গুলিবর্ষণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। শাহীন চাকলাদার ক্যাডার পরিবেষ্টিত হয়ে নিহত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী শিমুলের লাশ হাসপাতালে দেখতে যাবার সময় হঠাৎ তার সঙ্গীরা বোমাবাজি ও গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের সামনেই সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে গুলিবর্ষণ আর বোমাবাজি করলেও পুলিশ হরতাল সমর্থকদের হটিয়ে দিতে উল্টো টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে।

২০১৪ সালের ১৬ জুলাই যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিয়াদ হত্যা মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বিপুলসহ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড করায় কোতোয়ালী থানার ওসি সহিদুল ইসলামকে হুমকি দেন শাহীন চাকলাদারের ক্যাডার আফজাল হোসেন, গাজী আব্দুল কাদির, মাহমুদ হাসান বিপুসহ কয়েকজন। তারা ওসিকে বলেন, মামলা নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারির সাথে কথা বলেছেন?

এদিকে, একটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, যশোরের চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রক হাসান ও মিজানকে ক্রসফায়ারে দেয়ার পর তাদের অনুসারীদের এখন শাহীন চাকলাদারই নিয়ন্ত্রণ করেন।

ক্যাডার বাহিনী
শাহীন চাকলাদারের ক্যাডার বাহিনীর তালিকা দীর্ঘ। থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে এ তালিকায় সন্ত্রাসী হিসেবে যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন-ভেকুটিয়ার শাহারুল ইসলাম, ধর্মতলার ভুট্টো, শাওন, কামরুজ্জামান ওরফে কাম, পুরাতন কসবার টাক মিলন, মিস্ত্রি শফিক, জুয়েল, ফিরোজ, ঢেপা শাহীন, স্বপন, রাসেল, রিতু, কুজো সফি, ফিরোজ, লিখন, লিটন, বাঁশহাটির সবুজ, সাইদুজ্জামান ওরফে দাঁতাল বাবু, বিশে, শাপলা, বিরামপুরের কাঠ নান্নু, কেরামত, এসবি বিপ্লব, আবদুল মান্নান, কিসমত নওয়াপাড়ার নবাব, উপশহরের সুজন, রনি, মুনসুর, ভাস্কর্য মোড়ের হিটার মামুদ, কাজী পাড়ার বাবলু, কারী আশরাফ, আশকার, লতিফ, বাবু, আরএন  রোডের বিল্লাল, আনিস, চৌগাছার শামীম ও মোমিন, উপশহরের চিমা, প্রণব, জুলফিকার, পুরাতন কসবার সিরু, বিরামপুরের মনসুর, ঘোপের তুহিন, ফয়সাল, চাঁদাবাজ মকবুল, শওকত, বারান্দিপাড়ার জাকির ও তারিক। এরা সবাই পুলিশের কাছে চিহ্নিত অপরাধী এবং মাদক ব্যবসায়ী। এমন কোন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে তারা চাঁদাবাজি করে না।

যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিতকুমার নাথ এ প্রসঙ্গে বলেন, এ অঞ্চলের যেসব চোরাকারবারী ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রক শাহীন চাকলাদার। এছাড়া টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে তার পরিবারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ রয়েছে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক লোক রাজনীতির নেতৃত্বে না থাকায় দলের বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রবীণ এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, শাহীন চাকলাদারের মতো একজন দুর্বৃত্তকে যশোরবাসীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এই নেতা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যশোরের গলায় কাঁটা হয়ে আটকে আছেন।

তিনি জানান, জনপ্রতিনিধির আড়ালে ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়ায় শাহীন চাকলাদার সবার কাছে এক আতংকের নামে পরিণত হয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।