ঢাকা: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বর্তমান আবাস গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশির নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের একাংশ বলছেন, নির্দেশ যা-ই হোক, অন্তত ৪ মার্চ পর্যন্ত খালেদা জিয়া নিরাপদ ও নিরুপদ্রব থাকবেন।
তারা বলেছেন, তল্লাশির সঙ্গে গ্রেপ্তারের কোনো সম্পর্ক নেই। কার্যালয়ে অবৈধ কিছু পেলেই গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ আসবে। কিন্তু খালেদার কার্যালয়ে অবৈধ কোনো কিছু থাকার প্রশ্নই আসে না।
রোববার (১ মার্চ) খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তল্লাশির নির্দেশটি জারি করেন আদালত। এরপরই কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগে বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
বিএনপির আইনজীবী-নেতাদের কয়েকজন বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে জানান, ৪ মার্চ খালেদাকে আদালতে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু খালেদা নিরাপত্তার অভাবে বের হবেন না হয়তো। আর সরকারও তাকে ঘাটাবে না।
কারণ হিসেবে এই নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার কোনো ক্ষতি হলে সরকার বিপদে পড়ে যাবে। তাই তারা হুটহাট করে কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না। বরং এভাবে একেকবার একেক নির্দেশনা দেখিয়ে তাকে মানসিক চাপে রাখার চেষ্টা করবে।
আইনজীবীদের বিশ্বাস, খালেদা জিয়াকে ভয় দেখাতে, ‘নার্ভাস’ করতে এসব করা হচ্ছে। এ মুহূর্তে খালেদার কার্যালয় তল্লাশি বা তাকে গ্রেপ্তারের সাহস করবে না সরকার।
বিএনপি নেতাদের মামলাগুলো নিয়মিত তদারকি করতেন, এমন একজন আইনজীবী নেতা বাংলানিউজকে বলেন, সরকার খালেদা জিয়াকে বিচলিত করতে নানারকম তৎপরতা চালাচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় এসেছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, এবার এল তল্লাশির নির্দেশ।
এদিকে রোববার রাতেই খালেদার গুলশানের বাসার সামনে থেকে নিরাপত্তা প্রটোকল সরিয়ে নেওয়া হয়। বাড়িটিতে কেউ থাকে না বলেই এই উদ্যোগ বলে প্রশাসনের দাবি। এ বিষয়েও চিন্তিত নন ওই আইনজীবীরা।
দলের সিনিয়র এক আইনজীবী-নেতা বাংলানিউজকে বলেন, সরকার তল্লাশির নির্দেশ ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে রাখলো, যাতে সময়মতো কাজে লাগাতে পারে। মূলত ভয় দেখাতে চায় তারা।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোকা নন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। এ মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা বা তার কার্যালয়ে তল্লাশি চালানো সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে। আর এই ঝুঁকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেবেন না।
উদাহরণ হিসেবে আইনজীবীদের সাম্প্রতিক একটি নির্বাচনের ফল উল্লেখ করেন এই নেতা। তিনি বলেন, ২৫টি পোস্টের ২০টিতে আমাদের সমর্থিত প্রার্থীরা জিতেছে। বাকি ৫টি ছোট পোস্টে সরকার সমর্থিতরা জিতেছে। এভাবে প্রতিটি বিষয়ে তারা বুঝবেন নিজেদের ভুল।
এই নেতার দাবি, সরকার খালেদাকে যতটা প্রতিকূলতায় ফেলবে, ততই খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের মমতা বাড়বে। সরকারের প্রতি সমর্থনও ততই কমতে থাকবে।
সম্প্রতি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর সাবেক বিচারপতি টিএইচ খানের বাসায় বৈঠক করেন বিএনপিপন্থী কয়েকজন আইনজীবী।
তাদেরই একজন বাংলানিউজকে বলেন, টিএইচ খানের সঙ্গে আমাদের পরামর্শ হয়েছে। তিনিও সার্বিক দিক বিবেচনা করে বলেছেন, খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করবে না সরকার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা সমস্যায় পড়ার চেয়ে গ্রেপ্তারের ঝামেলা এড়ানোকেই শ্রেয় মনে করতে পারেন তারা।
এই আইনজীবী-নেতা আরো বলেন, অন্তত ৪ মার্চ পর্যন্ত সরকার খালেদাকে নির্বিঘ্নে ও নিরাপদেই থাকতে দেবে বলে আমরা মনে করছি। এরপরে তারা নতুন কৌশল করবে, তবে গ্রেপ্তার বা কার্যালয় তল্লাশির দিকে যাবে না।
তিনি বলেন, এদিন (৪ মার্চ) আদালতে হাজিরা দেওয়ার সুযোগ দেবে সরকার। খালেদা জিয়া না গেলে সরকারকে নতুন কৌশল নিতে হবে।
সিনিয়র অপর এক আইনজীবী-নেতা বাংলানিউজকে বলেন, পুলিশ যদি তল্লাশিতে যায়, সেক্ষেত্রে তাদেরও তল্লাশি নেওয়া হবে। এটাই নিয়ম। কোনো ক্ষতিকর বা অবৈধ কিছু নিয়ে তারা কার্যালয়ে ঢুকে বিএনপি নেত্রীকে ফাঁসিয়ে দেবে- সেটি হবে না।
তিনি বলেন, মূল ফটকে তাদের তল্লাশি নেওয়া হবে। এছাড়া কেউ যেন দেয়াল বেয়ে কার্যালয়ে ঢুকতে না পারে সেটিও লক্ষ্য রাখা হবে। সেখানে মিডিয়ার উপস্থিতিও থাকতে হবে।
আলাপের শেষদিকে এই নেতা বলেন, এসবই সাধারণ গালগপ্পো। মূল বিষয়টি হলো, সরকার বুঝে-শুনে চলবে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের কারও কারও মাথা গরম, কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি’রও তাই। তাদের উস্কানিতে ধরা না দিয়ে সহনশীলতার পরিচয় দিলেই লাভবান হবে সরকার।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বাংলানিউজকে বলেন, সার্চ ওয়ারেন্ট মানেই কিন্তু গ্রেপ্তার নয়। সার্চ করার সময় অবৈধ কিছু কার্যালয়ে পেলে তখনই আসবে গ্রেপ্তারের প্রশ্ন।
জমির বলেন, যারা তল্লাশি করতে আসবেন, তারা নিজেরাই কার্যালয়ের ভেতরে অবৈধ কিছু নিয়ে ঢুকছেন কি-না সেটিও প্রথমে যাচাই করে নেওয়া হবে। আইন তা-ই বলে।
খালেদা জিয়ার প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব প্রসঙ্গে এই নেতা বলেন, আমি তাকে যতটুকু চিনি, তিনি এসবে টলার পাত্রী নন। আইন বোঝেন, রাজনীতি বোঝেন, তাই পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্তও তিনিই ঠিক করবেন।
জমির বলেন, আত্মসমর্পণের বিষয়ে খালেদা জিয়া নিরাপত্তার অভাবের কথা বলছেন। সেটি অমূলক নয়। আসলেই তো তিনি নিরাপদ কি-না সেটি নিয়ে চিন্তা হওয়াই স্বাভাবিক। সরকারকেও বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। কারণ খালেদা জিয়ার কোনো ক্ষতি হলে সরকারের উপর তার দায় এসে পড়বে।
অবশ্য আইনজীবীদের এসব মতের সঙ্গে মেলে না বিএনপির অন্য অনেকের মতের।
রোববার সন্ধ্যায় বিএনপির যে ক’জন নেতা বা কর্মকর্তার সঙ্গে তল্লাশির নির্দেশ বিষয়ে আলাপ হয়, তারা এটিকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখছেন বলে জানান।
অস্বীকার করেননি খালেদার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেলও। তিনিও বাংলানিউজকে বলেন, বিচিত্র কিছু নয়, এটি গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াও হতে পারে।
গুলশান সূত্র জানায়, আদালতের এই নির্দেশটি খালেদা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন।
অপর সূত্র জানায়, নির্দেশ জারির খবরে কার্যালয়ে অবস্থানকারীরা কিছুটা অস্থির হয়েছিলেন। বিশেষ করে, গুলশানের মামলায় যাদের নাম উল্লেখ রয়েছে তাদের কাউকে কাউকে বেশ চিন্তিত দেখা গেছে।
প্রসঙ্গত, মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ কবির আদালতে তল্লাশির আবেদনে বলেছেন, খালেদা জিয়াসহ মামলাটির অন্য আসামিরা কার্যালয়টিতে পালিয়ে আছেন। নাশকতার কাজে ব্যবহার হতে পারে এ ধরনের বিস্ফোরক বা অন্যসব দ্রব্য সেখানে মজুদ থাকতে পারে। এজন্য কার্যালয়টিতে তল্লাশি করা প্রয়োজন।
এই মামলায় প্রধান ও হুকুমের আসামি হিসেবে খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অন্য ১৩ জন আসামি হচ্ছেন: বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ, শিরিন সুলতানা, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মারুফ কামাল খান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, হুমায়ুন কবির, এমএ কাইয়ুম, দেওয়ান সালাউদ্দিন, মোস্তফা, মামুন ও মানিক।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০১৫