ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

রাজনীতি

হারানোর ভয়ে কার্যালয় ছাড়ছেন না খালেদা

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৫
হারানোর ভয়ে কার্যালয় ছাড়ছেন না খালেদা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম / ফাইল ফটো

ঢাকা: কূটনৈতিক এলাকা হওয়ায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার অভিযোগ আগে থেকেই আছে। তারওপর একবার বের হয়ে গেলে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে এরই মধ্যে গুঞ্জন রটে গেছে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে।

সাবধানি খালেদা জিয়া তাই কার্যালয় রক্ষায় গুলশান-২-এর ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাসাতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ছাড়ছেন না গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর ভাড়া বাড়িটিও। বিএনপি নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের ছেলে তানভীর ইসলামের মালিকানাধীন ‘ফিরোজা’ নামে ওই বাড়িটিতে ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল থেকেই ভাড়া থাকছেন তিনি। বলা যায়, শহীদ মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর হাতে গোনা ক’টা দিন বাদ দিলে ‘ফিরোজা’ই হয়ে ওঠে খালেদা জিয়ার ঠিকানা।

তবে প্রায় সোয়া দুই মাস ধরে গুলশান-২-এর ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাসায় নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়েই বসবাস করছেন বিএনপি প্রধান। এই বাড়িটির মালিক দলের স্থানীয় সরকার বিষয়ক সহ-সম্পাদক আবু নাসের মো. ইয়াহিয়া।

তিনি সাবেক এমপি ও বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক জাকারিয়া তাহের সুমনের ভাই। তাদের পিতা আবু তাহেরও কুমিল্লার বরুড়া থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।  

গত ৩ জানুয়ারি এই বাড়িতে নিজের কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে ‘ফিরোজা’ ছেড়ে আসেন খালেদা জিয়া। এরপর কিছু দিন তিনি অবরুদ্ধ থাকেন। পরে শুরু হয় স্বেচ্ছাবাস। এই স্বেচ্ছাবাসই আরো দীর্ঘ হচ্ছে বলে জানাচ্ছে টানা সোয়া দুই মাসে একবারও রাজনৈতিক কার্যালয়ের বাইরে পা না রাখা খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ সূত্র।

সূত্র বলছে, গ্রেপ্তার বা অন্য কোনো ব্যত্যয় না ঘটলে খুব শিগগিরই খালেদা জিয়াকে এই কার্যালয়ের বাইরে দেখা যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

আর এ কারণেই দিন দিন আরো বেশি বসবাসযোগ্য করে তোলা হচ্ছে খালেদা জিয়ার কার্যালয়। নিরাপত্তা বাড়াতে এরইমধ্যে দু’দফা কাঁটাতারের বেড়া বসানো হয়েছে সীমানা প্রাচীরের ওপরে। ঝালাই-মেরামতে মজবুত করা হয়েছে প্রধান ফটক। আনা হয়েছে রেফ্রিজারেটর, খাট, দুইটি এয়ার কন্ডিশনার। নিজের বাসার নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীও কার্যালয়ে আনিয়ে নিয়েছেন খালেদা জিয়া।

একই সঙ্গে যতোটা সম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি করে তোলা হয়েছে বাড়ির ভেতরের পরিবেশ।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, কার্যালয়ে বসবাসের পরিকল্পনা ছিল না খালেদা জিয়ার। কিন্তু সম্প্রতি সরকারপক্ষ থেকে কার্যালয় উচ্ছেদের পরিকল্পনা চাউর হওয়ার পর বাধ্য হয়েই এখানে থাকছেন তিনি।

ওই নেতা আরো বলেন, খালেদা জিয়া আশঙ্কা করছেন, তিনি বের হলেই এই কার্যালয়টি উঠিয়ে দেবে সরকার। এরপর জনহিতকর কোন কাজে ব্যবহার করে উচ্ছেদকর্মটি জায়েজ করবে।

অপর এক সূত্র বলছে, ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায় খালেদা জিয়ার অবস্থাও হয়েছে তেমন। মঈনুল রোডের বাড়ি হারানোর তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে নিজের কার্য‍ালয় সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে।

আর এই ভবনের মালিক ইয়াহিয়াও বিশেষ নজর দিয়েছেন বাড়িটির উন্নয়নে। তার বাড়িটিকে ২০০৮ সালে রাজনৈতিক কার্যালয় বানান খালেদা জিয়া। এতে ভীষণ খুশি হন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান ইয়াহিয়া।

পরিবারটির ঘনিষ্ঠ এক যুবদল নেতা বাংলানিউজকে জানান, বাড়িতে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয় বলে ইয়াহিয়া খুব আনন্দিত। কার্যালয়ের ভাড়া নিতে চাননি তিনি কখনো। তবুও ম্যাডামের (খালেদা) নির্দেশে যথাসময় সেসব পরিশোধ হয়।

গুলশান সূত্র জানায়, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণসহ যেকোনো সিদ্ধান্তে খালেদা জিয়ার নির্দেশই চূড়ান্ত ধরতে বলেছেন ইয়াহিয়া। এখনও খালেদার নিরাপত্তা বাড়ানো বা বাড়ির যেকোনো সংস্কারে খালেদা জিয়ার প্রয়োজনকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন তিনি।

কাঁটাতারের বেড়া ও ফটকের সার্বিক ব্যয়ের বিল খালেদার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেলের নামে হয়েছে। পরিশোধ হচ্ছে খালেদার পক্ষ থেকে।

অর্থাৎ খালেদার প্রয়োজন বিবেচনায় কার্যালয়ের যেকোনো পরিবর্তন বা সংস্কারের অনুমতি রয়েছে ইয়াহিয়ার এবং সেসব কাজের ব্যয় বহন হবে খালেদার পক্ষ থেকেই-ব্যাখ্যা সূত্রের।

শুধু এসবের ব্যয় নয়, কার্যালয়ের ভাড়া বা বিল পরিশোধে কোন অনিয়ম না করারও নির্দেশ রয়েছে খালেদার। ২০০৮ সালে কার্যালয়ে কাজ শুরুর আগেই সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন তিনি- জানান সে যুবদল নেতা।

একই নির্দেশ গুলশানের ভাড়া বাসার ক্ষেত্রেও দিয়ে রেখেছেন তিনি- জানান খালেদার এক উপদেষ্টা।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল রাত সোয়া একটার দিকে এ বাড়িতে ওঠেন খালেদা জিয়া। তার আগেই বলে রেখেছেন ভাড়া ও বিল পরিশোধে কোন অনিয়ম যেন না হয়।

খালেদার জিয়ার এক আত্মীয়া বাংলানিউজকে বলেন, রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, জানি। তবে খালেদা তার দেনা মেটানোর বিষয়ে সবসময় সতর্ক।

‘ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মঈনুল রোডের বাড়ি হারানোর স্মৃতি এখনো তাড়া করে খালেদা জিয়াকে’- বলেন খালেদার এই সুহৃদ।

প্রয়াত স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতিঘেরা মঈনুল রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি হাতছাড়া হয় ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর। গৃহহারা হয়ে গুলশান কার্যালয়ে খুব কেঁদেছিলেন সেদিন খালেদা জিয়া। কার্যালয় থেকে বের হয়ে ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারের বাসায় ওঠেন।

জানা যায়, খালেদা জিয়া বাড়ি খোঁজার দায়িত্ব দেন ছোট ভাই ও উপদেষ্টা মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দার, উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু ও তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে।

প্রথমদিকে গুলশান-২ আবাসিক এলাকায় প্রায় দুই বিঘা আয়তনের একটি বাড়ি, মহাখালী ডিওএইচএস’র ১০ নম্বর সড়কের ২০৬ নম্বরে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য জি এম ফজলুল হকের বাড়ি এবং সর্বশেষ মেজর (অব.) কামরুলের মায়ের বাড়িটি দেখা হয়।

নানা জটিলতা আর অবস্থানগত কারণে আগের দুটি বাড়ি পছন্দের তালিকা থেকে বাদ পড়ে।

কার্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে খালেদারও পছন্দ হয় ‘ফিরোজা’। কামরুলের মায়ের মৃত্যুর পর বাড়িটি খালি পড়ে ছিল।

বাড়ি বিষয়ে ফালু ও তানভীরের (কামরুলের ছেলে, বর্তমান মালিক) বেশ কয়েকবার কথা হয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর সংস্কার কাজ শুরু হয়।

২০১০ সালের ১৪ নভেম্বরের একাধিক পত্রিকাসূত্রে জানা যায়, মঈনুল রোডের বাড়িতে ৬৭ জন স্টাফ, ৪৫টি ক্যামেরা, ১২টি বাথরুম, ৪টি রান্নাঘর, ১৮টি এসি, ৪৮টি সোফা, ৫টি ফ্রিজ ও ৬টি টিভি ছিল। যার চারভাগের একভাগ সুবিধাদিও নেই বর্তমান আবাসে।

১ মার্চ একদিকে খালেদার কার্যালয় তল্লাশির নির্দেশ দেন আদালত, অন্যদিকে খালেদার গুলশানের বাসার নিরাপত্তা সরিয়ে নেয় প্রশাসন।

‘লন্ডনে বাসরত বড় ছেলে তারেক রহমান ও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো, দুই পুত্রবধূ ও তিন নাতনীর ব্যবহারের সব সামগ্রী বাসাটিতে যত্নে রেখে দিয়েছেন খালেদা’- বাংলানিউজকে জানান এ বাসায় নিয়মিত যাতায়াতকারী মহিলাদলের নেত্রী।

খালেদার কার্যালয়ে বসবাস প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাসা বা কার্যালয় যেখানেই থাকুন খালেদা, সেটি তার বিষয়। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত ইচ্ছায় কারও হস্তক্ষেপ সমীচিন নয়। সরকার নিশ্চয়ই তার থাকার বিষয়টি নির্ধারণ করে দেবে না। ’

‘কার্যালয়ে থাকা-না থাকার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আমার জানা নেই’- বাংলানিউজকে বলেন খালেদার উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর।

‘পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে খালেদা জিয়া কতদিন এখানে থাকেন’- বলেন মাহবুব। তিনি জানান, খালেদা জিয়া কার্যালয়ের প্রাত্যহিক কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত।

বাংলাদেশ সময়: ০৬০১ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।