ঢাকা: ১৯৯৬ সালের ২৬জুন মান্নান ভূঁইয়াকে বিএনপির মহাসচিব পদে বসিয়ে ছিলেন খালেদা জিয়া। টানা ১১ বছর ওই পদে থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
মঙ্গলবার রাতে মান্নান ভূঁইয়ার মৃত্যুর পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে বাণী দিয়েছেন তাও অলিখিত। প্রেস উইংয়ের দাবি তারা নাকি ফোনে মিডিয়াকে চেয়ারপার্সনের বাণী পাঠিয়েছেন। কাউকে প্রেস রিলিজ পাঠাননি।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এটাই কি দেশের রাজনীতির নিষ্ঠুরতা?
আশির দশকে বিএনপির রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মান্নান ভূঁইয়া। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সীমাহীন পরিশ্রম ও সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের একজন। ১৯৮৮ সালে দলের যুগ্ম মহাসচিব পদের দায়িত্ব পান তিনি। পরে ’৯৬ সালের ২৫ জুন খালেদা জিয়া দলের মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন মান্নান ভূঁইয়াকে। ওই পদে বিশ্বস্ততার সঙ্গেই ১১ বছর পার করেছিলেন তিনি।
কিন্তু ১/১১-এর পটভূমি ওলট-পালট করে দিলো সব কিছু। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার ছোট একটি চিরকুট মান্নান ভূঁইয়ার কপালে বহিষ্কারের কালিমা লেপে দিল।
৭ জুলাই সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল থেকে দেশে ফিরে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন মান্নান ভূঁইয়া। গুরুতর অসুস্থতার খবরটি তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীদের মনে দোলা দেয়। ৯ জুলাই রাতে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে মান্নান ভূঁইয়ার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে বেশির ভাগ সদস্যই মত দেন। কিন্তু কারো কারো বিরোধিতার মুখে শেষ পর্যন্ত চেয়ারপারসন এ ব্যাপারে আর আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আগেই বিএনপির মহাসচিব খোন্দাকার দেলোয়ার হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মান্নান ভূঁইয়াকে দেখতে স্কয়ার হাসপাতালে গেছেন। এরপর একে একে বিএনপির বেশির ভাগ শীর্ষ নেতাই স্কায়ার হাসপাতালে গেছেন মান্নান ভূঁইয়াকে দেখতে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ তাদের রাজনৈতিক সহযোদ্ধাকে একনজর দেখতে হাসপাতালে গেছেন। কিন্তু যে দলে প্রায় ৩০ বছর নিজের মেধা ও শ্রম দিয়েছেন, সেই দলের চেয়ারপারসন একনজর দেখতে যাননি এই বর্ষীয়ান নেতাকে।
মহাসচিব হিসেবে ১১ বছর দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বার বার চেষ্টা করেছেন বিএনপিকে কট্টরপন্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে। এ ব্যাপারে তিনি অনেকটা সফলও হয়েছিলেন বলে মনে করেন অনেকে।
রাজনীতিবিদ হিসেবে আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ছিলেন বিচক্ষণ। কিন্তু ১/১১-এর প্রেক্ষাপট তার কপালে বহিষ্কারের কলঙ্কতিলক এঁকে দিলেও দল ভাঙায় তিনি খুব একটি আগ্রহী ছিলেন না। বহিষ্কারের পরও তিনি আলাদা কোনও রাজনৈতিক দল গঠন করেননি। নিজ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করলেও তিনি বিএনপি সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক বক্তব্য দেননি।
জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথম জানাজার পর সংসদনেতা ও স্পিকারের পক্ষ থেকে সংসদের চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এই বর্ষীয়ান নেতাকে। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা জানানো হয়নি। মরদেহ নেওয়া হয়নি তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। ঢাকায় দুইটি জানাজা অনুষ্ঠিত হলেও বিএনপির হাতেগোনা কয়েকজন নেতা ছাড়া কাউকে দেখা যায়নি।
সকাল ৭টা থেকে ১১টা পর্যন্ত মান্নান ভূঁইয়ার মরদেহ তার গুলশানের বাসভবনে রাখা হলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার ছাড়া আর কোনো বিএনপি নেতা সেখানে যাননি।
একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের প্রস্থানকালে তার প্রতি এমন আচরণ দেশের নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও এর চরম বিদ্বেষী ও নিষ্ঠুর রূপটাই তুলে ধরে।
বাংলাদেশ সময় ১৭৫০ ঘণ্টা, ২৮ জুলাই ২০১০