ঢাকা: যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকসহ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিনজন নারী মেম্বার অব পার্লামেন্ট (এমপি) নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদেরকে অভিনন্দন জানায়নি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি।
বৃহস্পতিবার (০৭ মে) অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুশনারা আলী বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনে, টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনে ও রূপা আশা হক ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনে বিজয়ী হন। লন্ডন থেকে নির্বাচিত এই তিনজনই বিরোধী দল লেবার পার্টির মনোনয়নে নির্বাচন করেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ইতিহাসে এক সঙ্গে তিন বাঙালি নারীর বিজয় এটাই প্রথম। তাদের এই অভূতপূর্ব বিজয়ে গোটা বাঙালি জাতি যখন গর্বিত, ঠিক তখন একাধিকবার ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি পুরোপুরি নীরব। তাদের এই রহস্যজনক নীরবতাকে দলীয় সংকীর্ণ আচরণ হিসেবে দেখছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন কয়েকজন বিশ্লেষক বলছেন, দলীয় সংকীর্ণতা, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও খেয়ালিপনার কাছে পরাজিত হয়েছে বিএনপির কূটনৈতিক সদাচার।
সাধারণ মানুষের মধ্যেও অনেকেই বিষয়টিকে বিএনপির ‘রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতা ও দেউলিয়াপনার’ বহির্প্রকাশ হিসেবে দেখছেন।
সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার (০৭ মে) যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের পর শুক্রবার (০৮ মে) ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিনের আহমেদের বরাত দিয়ে প্রেসউইং থেকে জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের পুনর্নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনসহ নবনির্বাচিত তিন বাঙালি নারীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন খালেদা জিয়া।
পরক্ষণেই আবার ফোন করে বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেস উইং কর্মকর্তারা মিডিয়াকে জানান, তিন বাঙালি নারীকে নয়, শুধু ডেভিড ক্যামেরনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
ওই দিন (০৮ মে, শুক্রবার) বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেস উইং থেকে আরো জানানো হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে ডেভিড ক্যামেরনের জন্য লিখিত অভিনন্দনবার্তা পাঠানো হবে গণমাধ্যমের কাছে। এরপর চার দিন পেরিয়ে গেলেও সেটি আর পাঠানো হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার (১২ মে)সন্ধ্যায় বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকায় নিযুক্ত বৃটেনের হাইকমিশনারের মাধ্যমে ডেভিড ক্যামেরনের কাছে লিখিত অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কাছে অভিনন্দনবার্তার কপি পাঠানোর দায়িত্ব চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের। সেটি কেন পাঠানো হয়নি, তা খোঁজ নিয়ে দেখবো।
সূত্রমতে, বর্তমানে সরকার ও বিরোধী দলের বাইরে থাকা বিএনপির জন্য যুক্তরাজ্যের পুনর্নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে অভিনন্দন জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও হাইকমিশনের মাধ্যমে লিখিত অভিনন্দন জানিয়ে বৃটেনের কনজারভেটিভ পার্টির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক অটুট রাখার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের ডান ঘরনার রাজনৈতিক দল বিএনপি।
কিন্তু বৃটেনের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত তিন বাঙালি নারীর বিজয়ে অভিনন্দন জানানোর ব্যাপারে কোনো আগ্রহই দেখায়নি তারা।
কেউ কেউ বলছেন, তিন বাঙালি নারীর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি ও শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক আছেন বলেই তাদেরকে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকে বিএনপি। বরং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রেস উইং থেকে তিন নারীকে অভিনন্দন জানানো হবে বলা হলেও উপরের ‘ধমকে’ তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে সাবিহউদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, কেন তিন বাঙালি নারীকে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হয়নি, সেটি আমি বলতে পারবো না। এ সিদ্ধান্ত হাইকমান্ড থেকে আসার কথা।
পাশের দেশ ভারতের নজির টেনে রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বৃহস্পতিবার (০৭ মে) ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত বিল পাস হওয়ার ক’দিন আগেও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এর ঘোর বিরোধিতা করেছে। কিন্তু লোকসভায় ভোটাভুটির সময় সব বিরোধিতা ভুলে গিয়ে নির্দ্বিধায় ভোট দিয়েছে কংগ্রেস। কারণ বিষয়টা জাতীয় ঐকমত্যের। এখানটায় দলীয় সংকীর্ণতাকে দূরে রেখে বাম-ডান-কংগ্রেস-বিজেপিসহ সারা ভারতের সব দল একাট্টা। আর বিলটি পাস হবার পর রাজনৈতিক মতভেদ ও শত বিরোধিতার পরও রাজনৈতিক শোভনতা ও সৌজন্যবোধের কোনো কমতি দেখাযায়নি।
এমনকি নিজের আসন থেকে উঠে কংগ্রেসপ্রধান সোনিয়া গান্ধীর আসনের সামনে গিয়ে জোড়হস্ত প্রণাম করে নিজের ও দলের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদী।
শুধু তাই নয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তার ভাষণে বলেছেন, ‘এই বিল পাসের মধ্য দিয়ে প্রতিবেশিদের কাছেও এই বার্তাই পৌঁছে দেওয়া হলো যে, জাতীয় ইস্যুতে ভারতের সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ। ’
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা শিষ্টাচার থেকে আমাদের নেতানেত্রীরা শিক্ষা নিয়ে হলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ভাগ্নিসহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তিন নারী এমপিকে প্রথম দিনই অভিনন্দন জানাতে পারতেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু তিনি তা না করে দলীয় সংকীর্ণতা ও ব্যক্তিগত খেয়ালিপনা ও বিদ্বেষকেই বড় করে তুলেছেন। যা একাধারে দৃষ্টিকটু ও শোভনতাবিবর্জিত কাজ হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, রুশনারা আলী ও রূপা আশা হককে অভিনন্দন জানিয়েছে। এখানটায় বড় দল বিএনপির ক্ষুদ্র দলীয় অবস্থান ও সংকীর্ণ মনোভাব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের জাতীয় নির্বাচনে তিন বাঙালি নারী নির্বাচিত হওয়ায় পুরো বাঙালি জাতি যখন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে, গাঁটের টাকা খরচ করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদেরকে অভিনন্দিত করছে, তখন দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিরও উচিত ছিলো মেইনস্ট্রিমে থাকা। ’
তবে এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল বৃটিশ পর্লামেন্টের তিন বাঙালি নারী এমপিকে অভিনন্দন জানিয়েছে- এমনটি নয়। তাহলে বিএনপিকে কেন দায়ী করা? তাছাড়া বিএনপি তো এখন সরকারি দলেও নেই, প্রধান বিরোধী দলও নেই। সুতরাং তাদের তেমন কোনো দায়ও নেই। ’
বাংলাদেশ সময়: ২২২৭ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৫
সম্পাদনা: জেএম