ঢাকা: দেশজুড়ে বইছে ছাত্রলীগের সম্মেলনের হাওয়া। কিন্তু বৃহৎ এ ছাত্র সংগঠনের আগামীর নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না।
অপেক্ষকৃত তরুণ নেতৃত্ব ১০১টি সাংগঠনিক জেলা ইউনিট কিভাবে সামলাবে তা নিয়ে এক রকম দুশ্চিন্তায় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা।
ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির চৌকস ও জনপ্রিয় ছাত্রনেতা জয়দেব নন্দী, মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক, শারমিন সুলতানা লিলি, শেখ রাসেল, মনোয়ারুল ইসলাম মাসুদ, আবু হানিফ, হাসানুজ্জামান তারেক, আবদুর রহমান জীবন বয়সের কারণে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়েছেন।
আর আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুল কবীর রাহাতের বয়স শেষ করার জন্য আড়াই মাস হাতে রেখেই সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেছে বর্তমান কমিটি-এমন গুঞ্জন ছাত্রলীগের সর্বত্র। এমনকি প্রকাশ্যে অভিযোগ করে বহিষ্কারও হয়েছেন সংগঠনটির এক কেন্দ্রীয় নেতা।
জানা যায়, পদপ্রত্যাশী ছাত্রলীগ নেতারা বিশেষ মহলের তুষ্টিতেই ব্যস্ত। শিক্ষাগত যোগ্যতা, সাংগঠনিক দক্ষতার দিকে মনোনিবেশ না করে সাবেকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা। কয়েকজন নেতা তো বলেই ফেলেলেন, ‘যোগ্যতায় পদ দেয়? পদ দেয় ভাইয়ে। ’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নৈতিক পদস্খলন শুরু হয় ছাত্রলীগ নেতাদের। ক্ষমতার দম্ভ থেকে শুরু হয় সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা।
অতিরিক্ত বিত্তবৈভবের প্রতি ঝুঁকে পড়েন তারা। পদ দখল করে থাকলেই লাভ- এমন সংস্কৃতিও চালু হয় সংগঠনে। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দুই বছর পর পর সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও চার থেকে পাঁচ বছর পর সম্মেলন করার প্রবণতা শুরু হয়।
২০০৬ সালে এরসঙ্গে যুক্ত হয় নতুন অনুসঙ্গ, অস্ত্র ও ‘অনুর্ধ্ব-২৯’ বছর বয়স। গঠনতন্ত্রে ২৭ বছরের কথা বলা হলেও মৌখিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে ‘অনুর্ধ্ব-২৯’।
বয়সের বাধ্যবাধকতায় শক্ত প্রতিযোগীদের বয়সের ফাঁদে ফেলে বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। একে ঘিরে তৈরি হয় সাবেক তিন সভাপতিসহ কয়েকজন নেতার একটা ‘সিন্ডিকেট’।
এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, সদস্য ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাবেক এক সদস্য।
তারা নিজেদের অনুগামী ও তুলনামূলক অদক্ষদের বসিয়ে সুবিধে নেওয়ার পথও সুগম করেন। বিত্তবৈভব গড়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন ছাত্রলীগকে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুল কবীর রাহাতকে বয়সের ফেরে মূল প্রতিযোগিতা থেকে দূরে রাখার কূটকৌশলের অংশ হিসেবে আড়াই মাস আগে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হয়।
‘তবে এখনও তার বয়স রয়েছে। এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমে মন্তব্য করে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় বহিষ্কার হয়েছেন সংগঠনের উপ-স্কুল বিষয়ক সম্পাদক রাজেশ চন্দ্র সিংহ। ’
জানা যায়, ছাত্রলীগের সম্মেলনের সময় নতুন নেতৃত্ব নির্ধারণ করতে একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। সম্মেলনে প্রতিটি সাংগঠনিক জেলা শাখা থেকে ২৫ জন ভোট দিতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট শাখা তাদের নামের তালিকা কেন্দ্রে জমা দেয়। কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন দিলে তারা ওই ভোট দিতে পারেন। এই তালিকা করা ও অনুমোদন সিন্ডিকেটের ইচ্ছানুযায়ীই হয়। সম্মেলনের সময় তারা (কাউন্সিলর) ঢাকায় এলে সদ্য সাবেক সভাপতি বা সাধারণ সম্পদক এবং সংশ্লিষ্ট শাখা সভাপতির মাধ্যমে তাদের নিজস্ব প্যানেলে ভোট দিতে বলা হয়।
সিন্ডিকেটের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে জেলার নেতা নির্বাচিত হওয়ার কারণে সিন্ডিকেটের কথা মতোই তাদেরও ভোট দিতে হয়।
এভাবেই ওই সিন্ডিকেট কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিজেদের অনুগতদের বসান। পরে তাদের মাধ্যমে শাখাগুলোর কমিটি ঘোষণা দেওয়া হয়। একই পদ্ধতিতে গত এক দশক ধরে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে ওই সিন্ডিকেট।
দেরিতে সম্মেলন দেওয়া ও বয়স সীমার মারপ্যাচে ২৬তম সম্মেলনে (২০০৬ সালে) বাদ পড়েন সে সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম কতোয়াল, সাইফুজ্জামান শেখর, মারুফা আক্তার পপি, খলিলুর রহমান খলিল, আবদুল আলীম, সালাউদ্দিন মোহাম্মদ চৌধুরী, দেলোয়ার হোসেন, হেমায়াত উদ্দীন হিমু।
২৭তম সম্মেলনে (২০১১ সালে) বাদ পড়েন ইকবাল মাহমুদ বাবলু, খায়রুল হাসান জুয়েল, আবু আব্বাস ভূঁইয়া, আশরাফুর রহমান আশরাফ, শাহীনুর রশীদ টুটুল, সোহেল রানা মিঠু, আব্দুল্লাহ আল মামুন, শেখ সোহেল রানা টিপু, সাজ্জাদ সাকিব বাদশা।
২০০৬ এবং ২০১১ সালের কমিটি যদি যথাসময়ে তাদের দুই বছর মেয়াদ শেষ করে অনুষ্ঠিত হতো তাহলে, এসব ছাত্রনেতাদের শীর্ষ নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা থাকতো বলে দাবি করে সূত্রটি।
সংশ্লিষ্ট নেতারা বলেন, এভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন করায় যেমন দক্ষ-অভিজ্ঞরা বাদ পড়ছেন তেমনি কেন্দ্রের দায়িত্বে আসে অপেক্ষাকৃত কম তরুণ নেতৃত্ব। অনুর্ধ্ব ২৯ বয়সী ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক যখন দায়িত্ব পালন করবেন তখন জেলার নেতাদের বয়স হয়ে যায় ৩২ এর উপরে। কেন্দ্র তখন জেলার উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নিতে হিমশিম খায়। এতে ঘটে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনাও।
এ কারণে বর্তমান কমিটি সারাদেশে কমপক্ষে ৬০০ নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করেছে। কয়েকটি জেলায় তাৎক্ষণিক কমিটি বিলুপ্তির ঘটনাও ঘটেছে।
তারা বলছেন, এতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কোন্দলের প্রভাব ছাত্রলীগেও পড়ছে। এ সমস্যায় কুমিল্লা শহর শাখার নেতা সাইফুল ইসলাম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুমন দাস, দিনাজপুর হাজী দানেশে দুই ছাত্র নিহত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও।
তবে ‘সিন্ডিকেট’ বিষয়ে কোনো কথা বলতে নারাজ আওয়ামী লীগ নেতারা। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠন পরিচালিত হওয়ার বিষয়টিই বারবার বলেছেন তারা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলানিউজকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ যদিও আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম, কিন্তু একটি স্বতন্ত্র সংগঠন। তারা তাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
‘আর সম্মেলনের বিষয়ে নেত্রী (আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) সরাসরি নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এখানে আমাদের কিছুই বলার নেই,’ যোগ করেন তিনি।
‘সিন্ডিকেট’ বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, সামনে ছাত্রলীগের সম্মেলন। অনেকে প্রার্থী আছে, তাদের প্রতি আমার শুভ কামনা থাকলো। এই সংগঠন নিয়ে সিন্ডিকেট বলতে কিছুই নেই। এটা অর্থহীন ও অবাস্তব কথা।
সম্মেলন বা বয়স নিয়ে সমস্যা হলে তা নেত্রী বিবেচনা করবেন বলেও জানান তিনি।
তবে ত্যাগী ও পরিশ্রমী ছাত্র নেতাদের আনতে প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করবেন বলে আশা করেন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতারা। তারা বলছেন, অন্যথায় সিন্ডিকেট বন্দী ছাত্রলীগ তার মহিমা হারাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০২০৪ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৫
এসইউজে/এমএ