ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

রাজনীতি

অধিক জনপ্রিয়তার অহঙ্কারে ভরাডুবির প্রান্তে বিএনপি!

টি. এম. মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৬ ঘণ্টা, জুন ১, ২০১৫
অধিক জনপ্রিয়তার অহঙ্কারে ভরাডুবির প্রান্তে বিএনপি!

বগুড়া: দেশের সাধারণ জনগণের মাঝে জনপ্রিয়তা নেই, এ কথা বললে হয়তো ভুল হবে। তবে যথাযথ কর্মকাণ্ড দিয়ে সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি এ কথাও দিবালোকের মত সত্য।

মাঠে ফসল হলেই হবে না, সেটিকে সুন্দরভাগে গুছিয়ে ঘরে তোলাটাই সফলতা। দেশের জনগণের মাঝে অধিক জনপ্রিয়তা রয়েছে, এই অহংকারে দলটি এখন ভরাডুবির দ্বারপ্রান্তে।

একটি রাজনৈতিক সংগঠনের মূল শক্তি ও ক্ষমতা হচ্ছে তার গঠনতন্ত্র। সেই গঠনতন্ত্র যদি কাগজেই সীমাবদ্ধ রেখে শুধু জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে দল পরিচালনা করা হয়, সেক্ষেত্রে দলের পতন অনিবার্য।

জনপ্রিয়তার অহঙ্কারে গঠনতন্ত্র না মানার কারণে স্বকীয়তা ও সাংগঠনিক শক্তি হারিয়ে বিএনপি এখন ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক শক্তি।

বছরের পর বছর ধরে গঠনতন্ত্র না মানার কারণে দলীয় কোন্দল,বিরোধ, হানাহানি এবং দলের ভেতর দুর্নীতি বেড়ে চলেছে সীমাহীন ভাবে। এতে উৱসাহ ও আস্থা হারাচ্ছেন প্রকৃত ও আন্তরিক নেতাকর্মীরা। ব্যর্থ হচ্ছে একের পর এক আন্দোলন-কর্মসূচি।

দল পরিচালনায় গঠনতন্ত্র না মানার এই প্রবণতা দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিস্তৃত জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও।

বিএনপির নীতি নির্ধারকরা দলের গঠনতন্ত্রে চোখ বোলান কি না তা-বলা সত্যিই মুশকিল। এর প্রমাণ মেলে বিএনপির বিভিন্ন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া দেখে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রত্যেক দুই বছর পর পর কাউন্সিলরদের (সদস্য) নিয়ে কমিটি গঠনের কথা। এতে জেলা কমিটির পরিধি অনূর্ধ্ব ১০১ সদস্য, উপজেলা/থানা ও পৌর/শহর কমিটি হবে ৭১ সদস্য বিশিষ্ট। কিন্তু দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশনা বা বিরোধ নিষ্পত্তির অজুহাতে এসব কমিটি গঠনে গঠনতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়। শুধু তাই নয়,একই ব্যক্তিকে অঙ্গ দল, সহযোগী অঙ্গদল এবং মূলদলসহ একই সঙ্গে ৩ থেকে ৪টি কমিটি ও পদে স্থান দেওয়া হয়।

জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি ও দেশের মধ্যে বিএনপির সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়াতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বগুড়ায় বিএনপির নামধারী কিছু নেতাকর্মী রয়েছেন ক্ষমতায় থাকাকালীন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও বর্তমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ভাঙ্গিয়ে কমিটি গঠন থেকে শুরু করে এহেন অপকর্ম নেই যারা তা করেননি। এমনকি দলের বর্তমান দুর্দিনেও একটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে, যারা কিছু হলেই তারেক রহমানের দোহাই দিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ওপর কথায় কথায় ক্ষমতার দাপট দেখায়। পাশাপাশি ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের থেকে আদায় করে নানা অন্যায় সুবিধা।

এই চক্রের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস রাখে না। কারণ প্রভাবশালী এসব নেতার হাতে রয়েছে এক ঝাঁক তরুণ ও যুবক যাদের অধিকাংশই তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। অর্থের বিনিময়ে এবং নিজেকে নিরাপদে রাখতে হঠাৎ করেই এসব তরুণ ও যুবককে আনা হয়েছে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বে। রাজপথে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নিজেদের পেশীশক্তি প্রদর্শনের বদলের তাদের ক্ষমতা প্রদর্শিত হয় দলের নিবেদিত প্রাণ ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চান এর নেতৃত্বাধীন বগুড়া জেলা বিএনপির কমিটি ২৬ জন উপদেষ্টাসহ ১৯৮ সদস্য বিশিষ্ট। যা ২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কমিটির অনুমোদন দেন।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও ৭ জন সহ সভাপতি ও দুইজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, একজন সাংগঠনিক ও দুই জন সহ-সাংগঠনিক, একজন দপ্তর, একজন সহ-দপ্তর, একজন প্রচার, একজন সহ-প্রচার ও একজন কোষাধ্যক্ষের সমন্বয়ে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি হওয়ার কথা রয়েছে। অথচ বগুড়া জেলা কমিটিতে শুধুমাত্র সহ-সভাপতি পদেই রাখা হয়েছে ২১ জনকে। দুই জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের জায়গায় রাখা হয়েছে ৮ জনকে।

একই রকম অনিয়ম করা হয়েছে অন্যসব পদেও। এছাড়া প্রকাশনা, মুক্তিযোদ্ধা, আইন, সমাজ কল্যাণ, যুব, স্থানীয় সরকার, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদকসহ অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করা হয়েছে ৭০টি। যা বিএনপির সরাসরি গঠনতন্ত্র পরিপন্থী।

এর আগে ‘রেজাউল করিম বাদশা ও সাইফুল ইসলাম’ এর কমিটিতে কতজন ছিল সে বিষয়টি সঠিক করে বলতে না চাইলেও দলীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে নানা বিরোধের জের ধরে ঐ কমিটির পরিধি ছিল ২০১ সদস্যের।

অনুরূপভাবে বর্তমান বগুড়া পৌর বা শহর কমিটির পরিধি ৭১ হওয়ার কথা থাকলেও সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচনের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি। এর আগে সর্বশেষ অনুমোদনকৃত বগুড়া পৌর বিএনপি’র কমিটি ছিল ১৩১ সদস্য বিশিষ্ট। প্রায় একই ধরনের অনিয়ম হয়েছে জেলার সদর উপজেলাসহ ১২টি উপজেলা বা থানা কমিটিতেও।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন প্রবীণ ও নবীন নেতা বাংলানিউজকে জানান, এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে কোন লাভ হয় না। দলীয় হাই কমান্ড এসব দুর্নীতি ও অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয় বলেই দলের এই হাল হয়েছে। ১৫/২০ বছর আগে কমিটি গঠনে সামান্য কিছু স্বজনপ্রীতির ছোঁয়া দেখা গেলেও এখন শুধু স্বজনপ্রীতিই নয়, দলে এখন চলছে পদের বিনিময়ে সরাসরি টাকার খেলা। হাই কমান্ড জেলায় যাদের ওপর দলের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে, তারা দল চালাচ্ছেন তাদের ইচ্ছামত।

বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলেন, বাংলাদেশে কমিটি গঠনে গঠনতন্ত্র বিরোধী এতবড় অনিয়ম আর কোন রাজনৈতিক দলে হয় বলে তাদের জানা নেই।

অবশ্য জেলা বিএনপি’র সভাপতি সাইফুল ইসলাম যথারীতি এ সব অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, যারা দলে আশানুরূপ স্থান পায়নি, তারাই এ ধরনের বদনাম করার চেষ্টায় থাকেন। সাহস থাকলে সামনে এসে তারা অনিয়মের প্রমাণ দেখাক।
  
এ প্রসঙ্গে জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন বাংলানিউজকে জানান, বগুড়াতে গঠনতন্ত্র মেনে কমিটি গঠন করা সম্ভব হয় না। কারণ এখানে নেতা-কর্মী অনেক। তাই তাদের চাহিদার দিকে দৃষ্টি দিতেই দলীয় চেয়ারপার্সনের নির্দেশে এতবড় কমিটি করা হয়ে থাকে।

একই ব্যক্তিকে একাধিক কমিটি বা পদে রাখা প্রসঙ্গে এক সময়ের শক্তিশালী ছাত্রনেতা ও বর্তমান জেলা বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, এতে কমিটি দুর্বল হয় এবং ঐ নেতার মধ্যে অহংকারী ও স্বেচ্ছাচারিতা দেখা দেয়।

বগুড়া শহর বিএনপি’র সভাপতি মাহবুবার রহমান বকুল বলেন, ত্যগী কর্মী নিয়ে ছোট পরিসরে কমিটি গঠন করলে সেই কমিটি শক্তিশালী হয়।

জেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি ও প্রবীণ নেতা আব্দুর রহমান জানান, দলীয় গঠনতন্ত্র মেনে চললে এবং দলকে ব্যবসা হিসেবে না নিলে বিএনপি কখনই এতবড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতো না।     

বাংলাদেশ সময়: ০১০৪ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৫
 আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।