ঢাকা: লাগামহীন সন্ত্রাস আর অস্ত্র ব্যবসার অভিযোগ মাথায় নিয়ে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী। নিকট অতীতে সন্ত্রাসের জনপদ বলে কুখ্যাতি কুড়োনো ফেনী কিছুদিন শান্ত থাকলেও এই এমপির সন্ত্রাসী বাহিনীর নেতৃত্বে আবারো সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হচ্ছে।
তার বেপরোয়া রাজনীতির কোপে প্রতিপক্ষ তো বটেই, ধরাশায়ী হচ্ছেন নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও। যে নেতাই নিজাম হাজারীর অবাধ্য হয় তাকে সরিয়ে দেয়া হয় রাজনীতি থেকে। এমনকি কখনো কখনো সম্মুখীন হতে হয় আরো ভয়াবহ পরিণতির। ফুলগাজী উপজেলা চেয়্যারম্যান একরামুল হক একরাম তেমনই অবস্থার শিকার বলে মনে করেন দলটির পদ ও সুবিধা বঞ্চিত নেতা-কর্মীরা। নিজাম হাজারীর কারণেই ফেনীতে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি।
দলীয় কোন্দল
অস্ত্র মামলায় জেল খেটে বের হবার পর সাবেক প্রভাবশালী নেতা জয়নাল হাজারীর অনুপস্থিতিতে ফেনীর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এ ‘অস্ত্র ব্যবসায়ী’। এর পর তৎকালীন জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক, পরে ফুলগাজী উপজেলা চেয়্যারম্যান একরামুল হক একরাম ও ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতাকে নিয়ে শুরু করে গ্রুপ রাজনীতি। আস্তে আস্তে ম্যানেজ করতে থাকেন প্রশাসন ও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের।
দীর্ঘদিন ধরে জেলার সকল পর্যায়ের নেতাদের সমন্বয়ে রাজনীতি করলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ নেতা কৌশলে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন সাবেক জয়নাল হাজারী সমর্থিত ও তার অবাধ্য নেতা-কর্মীদের।
জয়নাল হাজারী সমর্থক হওয়ায় বিগত জেলার ২০১২ সালের জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আজিজ আহম্মদ চৌধুরীকে কৌশলে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতির মাঠ থেকে বিদায় করে দেন নিজাম হাজারী।
তদস্থলে তার রাজনীতির নতজানু আবদুর রহমান বিকমকে সভাপতি করেন।
এরপর ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, সোনাগাজী, ফুলগাজী ও ফেনী সদর উপজেলার সব কমিটিতেই স্থান পায় নিজাম হাজারীর অনুসারীরা। রাজনীতিতে যোগ্য ও তৃণমূলের সমর্থন থাকলেও অনেককে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে জেলা ছাত্রলীগ, ফেনী সরকারি কলেজসহ সব উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে স্থান পায় এ নেতার অনুসারীরা। যারাই এমপির বিরোধিতা করছেন তারা রাজণীতি করার সুযোগ হারাচ্ছেন। অনেককে শুনতে হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের অপবাদও।
তৃনমূলের ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, নিজাম হাজারী নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর জন্য কমিটিতে দুর্বৃত্তদের জায়গা করে দিচ্ছে। যারা এবার ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন তাদের অনেকে চেনেই না। পক্ষান্তরে অনেক ত্যাগী ছাত্রলীগ নেতাকে দল থেকে বাধ্যতামূলকভাবে বাদ দেয়া হয়েছে।
রহিমুল্লাহ-নিজাম দ্বন্দ্ব
গেল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে মহাজোট মনোনীত প্রার্থী জাতীয় পার্টির রিন্টু আনোয়ার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও নিজাম হাজারীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী জেদ্দা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজী রহিমুল্লাহ।
নির্বাচনের পর কিছুদিন ভালো গেলেও বেশী ভাল সর্ম্পক টিকে থাকেনি দু’এমপির মধ্যে। প্রভাব বিস্তার করাকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়তই সংঘর্ষ বাঁধছে তাদের সমর্থকদের। হাজী রহিমুল্লাহর অভিযোগ, নির্বাচিত হয়েও নিজাম হাজারীর সমর্থকদের কারণে তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় ঢুকতে পারেন না।
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সোনাগাজীতে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে খুন হয়েছেন বেলাল হোসেন ও আজিজুল হক নামের ২ যুবলীগ নেতা। খুন হয়েছেন অনিক নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীও। আর সংঘর্ষে আহত হওয়ার খবর নিত্য-নৈমিত্তিক খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সর্বশেষ ৬ জুন সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর এলাকায় নিজাম হাজারী ও হাজী রহিমুল্লার সর্মকদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করাকে কেন্দ্র করে আজিজুল হক নামে এক যুবলীগ নেতা নিহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ২ দিন পরে সোনাগাজীতে প্রতিবাদ সভা আয়োজন করে নিজাম হাজারীর স্থানীয় সমর্থকরা। ওই সভা থেকে ফেরার সময় ৩১টি আগ্নেআস্ত্র, বিপুল সংখ্যক দেশীয় অস্ত্র ও ১২০টি বুলেটসহ নিজাম হাজারীর ২৬ অনুসারীকে আটক করে র্যাপিড় অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (ৠাব)। পরে তাদের নামে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করলে বিচারক তাদের জেল হাজতে পাঠান।
এ ঘটনায় নিজাম হাজারী ঘটনাস্থলে গিয়ে ২ ঘণ্টা চেষ্টা তদবির করেও তার অনুসারীদের র্যাবের হাত থেকে মুক্ত করতে পারেননি। পরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিজাম হাজারীর অনুসারী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, অস্ত্রগুলো তাদের এবং এগুলো বৈধ।
অস্ত্র ও অনুসারীদের জেল হাজতে পাঠানোর পর আরো বেপোরোয়া হয়ে ওঠেন এক সময়কার অস্ত্র ব্যবসায়ী নিজাম হাজারী। বিভিন্ন কায়দায় মামলা করে আদালতের মাধ্যমে তার অনুসারীদের লাইসেন্স করা অস্ত্রগুলো উদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি।
এদিকে র্যাব ৭ এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতাহুল হক বলেন, অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে থাকার কারণে বৈধ অস্ত্রগুলোও অবৈধ হয়ে যায়। এ গুলো বৈধ হবার কোন সুযোগ নেই।
কমিশন বাণিজ্য
রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্টসহ যে কোনো কাজ করার জন্য নিজাম হাজারীকে কমিশন দিতে হয়, না হলে কাউকেই কাজ করতে দেয়া হয় না। এ কমিশন বাণিজ্যে নিজাম হাজারীর সঙ্গে ভাগ বসান এক সময়কার জয়নাল হাজারী ফুলগাজী উপজেলার চেয়্যারম্যান একরামুল হক একরাম। আর এ কারণেই তাকে মরতে হয় বলে মনে করেন ফেনী জেলার তৃণমূলের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
শুধু রাস্তা-ঘাট আর ব্রিজ কালভার্ট নয়, ফেনী পৌরসভা নির্বাচনে নিজ দলীয় প্রার্থীদের বঞ্চিত করে জাতীয় পার্টির নেতা, এক সময়কার টাইগার আলাউদ্দিনকে সমর্থন দেয়া নিয়েও রয়েছে নিজাম হাজারীর কমিশন বাণিজ্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা বাংলানিউজকে জানান, হাজী আলাউদ্দিনকে সমর্থন দিয়ে নিজাম হাজারী ২ কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন। যার ফলে আওয়ামী লীগের যোগ্য নেতারা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
নিজাম হাজারীর এমন বেপোরোয়া রাজনীতির কারণে জেলা আওয়ামী লীগের তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে বলে দাবি দলীয় সূত্রের।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৫
জেডএম