ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

চারটি ধারায় বিভক্ত বাম দলগুলো

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯
চারটি ধারায় বিভক্ত বাম দলগুলো

ঢাকা: বাংলাদেশের বাম রাজনীতির ইতিহাস যেমন অনেক দিনের পুরনো, তেমনি দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য আর দ্বন্দ্বও নতুন কিছু নয়। মস্কোপন্থি ও পিকিংপন্থি- শুরু থেকেই এ দুই ধারায় বিভক্ত দেশের বাম রাজনীতিবিদরা। নেতৃত্ব ও আদর্শগত দ্বন্দ্বে বিভিন্ন সময়ে বাম দলগুলো ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়েছে। সমাজতন্ত্রের নীতি অনুসরণে সবার লক্ষ্য এক হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে এখন অন্তত চারটি ধারা দেখা যায়।

বামপন্থিদের মধ্যে বর্তমানে সরকারের সঙ্গে রয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), সাম্যবাদী দল (এমএল),  বাংলাদেশ জাসদ (শরিফ নুরুল আম্বিয়া), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও গণতন্ত্রী পার্টি।  

অপরদিকে, বিএনপির সঙ্গে রয়েছে জেএসডি (রব), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (সাঈদ আহমেদ)।

এছাড়া, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের বাইরে আটটি বামপন্থি দলের সমন্বয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোট নামেও একটি জোট রয়েছে। এতে আছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।

আরও কিছু বাম দল রয়েছে, যারা কোনো জোটের অন্তর্ভুক্ত নয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐক্য ন্যাপ (পঙ্কজ ভট্টাচার্য) ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর)।

বামপন্থিদের ঐক্য বিষয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান ও প্রেক্ষাপটে কী ধরনের আন্দোলন হবে, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য আছে। তবে, দ্রুত এসব মতপার্থক্য দূর করে ঐক্যবদ্ধ জায়গা তৈরির চেষ্টা করছি। জনগণের ঐক্যই আসল। এর জন্য গণতান্ত্রিক প্রগতিশীলদের যে ঐক্য করা প্রয়োজন, আমরা সে চেষ্টা করছি।  

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে বিএনপিতে নেতৃত্বের তীব্র সঙ্কট চলছে। দলীয় প্রধান দুর্নীতির দায়ে কারান্তরীণ, আরেক প্রধান পলাতক। এরশাদের মৃত্যু-পরবর্তী জাতীয় পার্টির অবস্থাও নাজুক। এ অবস্থায় দেশের সব প্রগতিশীল বাম দল নিজেদের বিভেদ ও মতপার্থক্য ভুলে যদি এক কাতারে এসে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলে, তাহলে তারা অন্তত সংসদে না হোক, রাজপথে মূল বিরোধীদলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবে।

বাম দলগুলোর মধ্যে এত বিভক্তি কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য বাংলানিউজকে বলেন, জনগণের জন্য কল্যাণকর রাজনীতি যখন ছিনতাই হয়ে যায়, তখন শুধু বাম রাজনীতিই নয়, কোনো প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক দল যথেষ্ট ক্রিয়াশীল থাকতে পারে না। সে কারণে সব ক্ষেত্রেই বিকল্পের শূন্যতা দেখা যাচ্ছে। যে বিকল্প শক্তি জনগণের কল্যাণে কাজ করবে, সে শূন্যতা সারাদেশে বিরাজ করছে। এ শূন্যতা পূরণে বামপন্থি দল, উদার গণতান্ত্রিক দল ও বিভিন্ন প্রগতিশীল সামাজিক সংগঠনগুলোর ঐক্য প্রয়োজন।

তিনি বলেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের জনগণের জন্য, দেশকে সঙ্কটমুক্ত করার জন্য আমাদের যে দায়িত্ব, তা সঠিকভাবে পালন করছি- এটা কেউ বলতে পারি না। এ ব্যর্থতা স্বীকার করেই বলছি, বিকল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া কোনো পথ নেই।

আওয়ামী লীগ জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বাম দলগুলোর ঐক্য না হওয়া প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, অনেক বাম দল ৫০ বছরে জাতীয় রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ধারণে একমত হতে পারেনি, জাতীয় রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ধারণেও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক বামপন্থি দল ’৭২ থেকে ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যারা বঙ্গবন্ধুর সমর্থক আর বিরোধী- উভয় পক্ষই মোস্তাক সরকার ও জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকারকে সরাসরি সমর্থন দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল।

তিনি বলেন, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ আমরা কয়েকটি দল জাতীয় কর্তব্যকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে বিরোধীদলের ভূমিকায় ছিলাম। খন্দকার মোস্তাক, জেনারেল জিয়া ও এরশাদের শাসনামলেও আমরা তীব্র বিরোধিতা করেছি। বামপন্থিদের মধ্যে কিছু দল জাতীয় কর্তব্য নির্ধারণে একমত হতে না পারার কারণে আমরা কিছু দল সরকারের সঙ্গে ঐক্যে আছি আর কিছু দল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান করছে। বাম দল হিসেবে জঙ্গি দমনে শেখ হাসিনাকে সমর্থন না দিয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে তারা বিএনপি-জামায়াতকেই সহযোগিতা করেছেন। এসব রাজনৈতিক ভূমিকা ও বিরোধের কারণেই বামপন্থিদের মধ্যে ঐক্য করা সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) অন্যতম সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বাংলানিউজকে বলেন, যারা লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে, তারা জনগণের মধ্যে ভয় ও লোভ ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ থেকে উত্তরণে সময় লাগবে। সে কারণে আমরা যারা প্রগতিশীল শক্তির দাবিদার, তাদেরকে আহবান জানাচ্ছি, কোনো শক্তির অপেক্ষা না করে মাঠে নামেন। রাজপথে লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে পরিচয় হবে। আমাদের লড়াইটা আওয়ামী লীগকে সরিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য নয়। আমাদেরটা হচ্ছে ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা বদলের রাজনীতি।
  
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে বাম দলগুলোর জন্য একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন পরিকল্পনা ও সাংগঠনিক তৎপরতা। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়, বাম দলগুলোর পরিকল্পনার অভাব আছে। সে সঙ্গে বর্তমানে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা বুঝতে তারা সমর্থ কি-না, সেটাও ভাবনার বিষয়।

বামপন্থি দলগুলোর এক প্লাটফর্মে আন্দোলন করার সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাম দলগুলোতে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ কারণে এতগুলো দল সৃষ্টি হয়েছে। আবার, মূল বামপন্থি দলগুলো একটার তুলনায় আরেকটা খুব বেশি শক্তিশালীও নয়। সুতরাং, কেউ কারও নেতৃত্ব মানতে চায় না। যদি কোনো একটি দল প্রধান ধারা হয়ে উঠতে পারতো, তাহলে সে দলকে অবলম্বন করে অন্যরাও একত্রিত হতে পারতো। সে কারণেই সব বাম দল এক প্লাটফর্মে আসতে পারে না। তবে, এখন সময়ের দাবি হচ্ছে, বামদের অন্তত ইসুভিত্তিক এক কাতারে এসে লড়াই-সংগ্রাম করা।
 
বামদলগুলোতে মতের ভিন্নতা থাকলেও লক্ষ্য একটাই- সংগ্রামের মাধ্যমে শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। যেহেতু লক্ষ্য এক, তাই নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত না করে এক কাতারের এসে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন গড়ে তোলাই তাদের জন্য উত্তম বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ সময়: ০০২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯
আরকেআর/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।