ঢাকা: ঢাকা-১৮ আসনের উপ-নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর পাশে গুটিকয়েক নেতা মাঠে থাকলেও দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির অধিকাংশ সদস্যই মাঠে নেই। ৩৭ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির বেশিরভাগ নেতা এখন ভার্চ্যুয়ালি দিকনির্দেশনা দিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।
তাদের দেখাদেখি স্থানীয় নেতারাও কৌশলে নির্বাচনী গণসংযোগ থেকে নিজেদের বিরত রাখছেন। ফলে উত্তরার বাইরে থেকে কিছু নেতাকর্মীকে এনে মাঠে রয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থী এসএম জাহাঙ্গীর। দলীয় কোন্দলে গণসংযোগে ধারাবাহিকভাবে হামলা হলেও সরকারি দলের ওপরে দোষ চাপাচ্ছেন বরাবরের মতোই।
দলীয় সূত্র জানায়, এই আসনের প্রার্থিতা নিয়ে শুরু থেকেই জটিলতায় ছিল বিএনপি। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকারের দিন বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দু’পক্ষের হামলার ঘটনায় দলের ১৭ জন নেতাকর্মী আহত হন। সেই সময় সাতজন মনোনয়ন প্রত্যাশী এসএম জাহাঙ্গীরকে দোষারোপ করে লিখিত অভিযোগ দেন দলটির কাছে। সেই ঘটনায় কাউকে শাস্তি না দিয়ে প্রার্থী ঘোষণা করায় বিক্ষুব্ধরা দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসায় ডিম ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
এ ঘটনায় মহানগর উত্তর বিএনপির ১৭ জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে দলটি। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ওই আসনের নেতাকর্মীরা। বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করলে দলের প্রার্থীকেও প্রতিরোধ করবেন বলে ঘোষণা দেন তারা। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে এসএম জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল, কুশপুত্তলিকা দাহ, কালো পতাকা প্রদর্শন, জাহাঙ্গীরের পক্ষের ছয় নেতার বাসায় ডিম হামলা করেন বিক্ষুব্ধরা। এছাড়া আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আরও কঠিন কর্মসূচি পালন করবেন বলে বহিষ্কৃত নেতারা জানিয়েছেন।
বহিষ্কৃত নেতারা বলেছেন, স্থানীয় নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ও বহিরাগতদের দিয়ে নির্বাচনী শোডাউন করছেন এসএম জাহাঙ্গীর। নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর থেকে প্রথম দুইদিন বড় শোডাউন করতে পারলেও এখন প্রার্থীর প্রধান কার্যালয়ের আশপাশেই থাকতে হচ্ছে প্রার্থীকে।
ওই আসনের নেতাকর্মীরা জানান, গত শুক্রবার নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর দিন দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে এসব নেতারা বিভিন্ন অজুহাতে গণসংযোগ ও প্রচারণায় আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এরমধ্যে কারও করোনা ভাইরাস সংক্রমণ, কেউ করোনা আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক ছাড়াও এই আসনের বিক্ষুব্ধ নেতাদের রোষানলে পড়ার শঙ্কায় গণসংযোগ কর্মসূচি এড়িয়ে চলছেন।
অনেক কেন্দ্রীয় নেতা ওয়ার্ডভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টনের আগে সেই ওয়ার্ডের বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আপস করার চেষ্টা করছেন। নিরাপদ দূরত্বে দায়িত্ব পালনের জন্য অনেকে কম সংঘাতপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব নিতে চাইছেন। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল, যুবদলের নেতাকর্মীরাই তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন। তারা প্রতিদিন রুটিন করে উত্তরার নির্বাচনী প্রচারণায় আসছেন। আবার রাতে বাসায় ফিরছেন।
একাধিক স্থানীয় নেতা জানান, প্রচারণার শুরুর দিন গত ২৩ অক্টোবর কমিটিতে থাকা সব নেতাই ছিলেন। এর পরদিন নির্ধারিত কর্মসূচি পালন করা সম্ভব হলেও পরিচালনা কমিটির সবাই ছিলেন না। আর তৃতীয় দিন থেকে প্রধান সমন্বয়কারী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান প্রতিদিনই কার্যালয়ে আসছেন। কিন্তু বাইরের কোনো প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন না। এছাড়া সমন্বয়কারী আবদুস সালাম ২৬ অক্টোবর একটি ঝটিকা মিছিলে ছিলেন। সদস্য সচিব ফজলুল হক মিলন, সদস্য আব্দুস সালাম, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সুলতানা আহমেদ করোনায় আক্রান্ত।
ফরহাদ হালিম ডোনার মেডিক্যাল এইড কমিটি ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল লিগ্যাল এইড কমিটি নিয়ে কাজ করছেন। খায়রুল কবির খোকন নিরাপত্তার কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ৪৮নং ওয়ার্ডের পরিবর্তে ৪৩নং বেছে নিয়েছেন। এ পর্যন্ত সেখানেও যাননি। হাবিব-উন নবী খান সোহেল ঢাকা-৫ আসনের নির্বাচনে সরব উপস্থিতি থাকলেও সেই তুলনায় ১৮ তে নীরব আছেন।
শামা ওবায়েদ একদিন ৪৭নং ওয়ার্ডে গিয়ে এক নেতার বাসায় ঘরোয়া বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু সেই কর্মসূচি বাতিল হয়। আজিজুল বারী হেলালকে দেখা যায়নি কোনো কার্যক্রমে। এবিএম মোশারফ হোসেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়ার্ডে কাজ করার চেষ্টা করছেন, এখনও সফল হননি। মীর সরাফত আলী সপু দুইদিন কার্যালয়ে গেছেন। আরেকদিন স্থানীয় সেচ্ছাসেবক দলের নেতার বাসায় সময় কাটিয়ে চলে যান।
বজলুল বাসিত আন্জু, সাইফুল আলম নীরব কার্যালয়ে উপস্থিতির মধ্যেই নিজেদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছেন। একমাত্র আফরোজা আব্বাসই তার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়ার্ডে প্রচারণা চালাতে সক্ষম হয়েছেন। এর বাইরে আব্দুল আলীম নকী, আকরামুল হাসান, হাবিবুর রশীদ হাবিব, রাজীব আহসান, ফজলুর রহমান খোকন, ইকবাল হোসেন শ্যামল প্রায় সব কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করছেন।
বাফুফের নির্বাচনের কারণে আগেই তাবিথ আউয়াল জানিয়েছিলেন, আগামী ১ নভেম্বর থেকে সক্রিয় হবেন। ইশরাক হোসেনকে প্রথম কয়েকদিন দেখা গেছে। এর বাইরে হাবিবুর রহমান হাবিব, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, আমিরুল ইসলাম খান আলীম, মোস্তাফিজুর রহমান, নাজিম উদ্দিন আলম, আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, আনোয়ার হোসেন, নেছারুল হক, হেলাল খান, হাসান জাফির তুহিন উল্লেখ করার মতো কর্মকাণ্ডে ছিলেন না।
কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি এই আসনের বিএনপির থানা পর্যায়ের নেতারাও শুরুর দিকে সক্রিয় থাকলেও এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয়। তবে খিলক্ষেত থানা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও উত্তরা পশ্চিম থানার সাধারণ সম্পাদক সক্রিয়। খিলক্ষেত থানা কমিটি গঠনের পরই সভাপতি (মহাসচিবের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত) আফাজ উদ্দিন অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। একইসঙ্গে বাকি ছয় থানার কোনো শীর্ষ নেতাকেও নির্বাচনী কার্যক্রমে দেখা যায়নি।
দক্ষিণখান থানা বিএনপির সভাপতি শাহাবুদ্দিন সাগর একদিনও প্রচারণায় যাননি। এই থানার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর নির্বাচনী প্রচারণার শুরুর দিন থাকলেও বিক্ষুব্ধ নেতাদের তাড়া খেয়ে আর যাননি। বিমানবন্দর থানার সভাপতি জুলহাস মোল্লা একদিন প্রচারণায় ছিলেন। উত্তরা পূর্ব থানার সভাপতি সালাম সরকার নির্বাচনী প্রচারণার শুরুর দিনই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট চন্দন নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। তুরাগ থানা সভাপতি আমানউল্লাহ আমান নিষ্ক্রিয়, সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ খোকাকে একদিন মাঠে দেখা গেছে। করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন থানা যুবদলের সভাপতি আলমাস হোসেন। উত্তরখান থানা বিএনপির সভাপতি আহসান হাবীবকে গত সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কার্যালয়ে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ বুকে নিয়ে কাজ করতে দেখা গেছে। কিন্তু এবারের সংসদীয় নির্বাচনে তাকে কোথাও দেখা যায়নি বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের।
জানতে চাইলে বিএনপির প্রার্থী এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা সবাই আমার সঙ্গে কাজ করছেন। দুই একটা সমস্যা আছে, তা ঠিক হয়ে যাবে।
পাঁচ থেকে ছয় থানার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এখনও সেভাবে মাঠে নামেননি এ বিষয়ে জানতে চাইলে, জাহাঙ্গীর বলেন, পাঁচ থেকে ছয়টা না, দুই থেকে তিনটা থানায় সমস্যা আছে। তাও ঠিক হয়ে যাবে। বহিষ্কৃত ১৭ নেতার সঙ্গেও সমঝোতার চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২০
এমএইচ/টিএ