বৈশাখ : গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতিক আশ্রয়

স্বকৃত নোমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৮:৫৮, এপ্রিল ১৩, ২০১২

পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষকে ঘিরে একটা আতিশয্য লক্ষ্য করার মতো। পহেলা বৈশাখের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শহুরে মধ্যবিত্ত অনেকের মুখে শোনা যায় : ‘বাংলা নববর্ষ আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য, এ উৎসব একান্ত বাঙালির সংস্কৃতি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে কি তাই? পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির একার? নাকি চাকমা, মুরং, মগ, সাঁওতাল, ওরাঁও, লুসাই, মণিপুরী, কোল, মু, হাজং, মাল, নাগা, কোচ, টিপরা, গারো, খাসিয়াসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীও এর অংশীদার? দেখা যাক সুলুক সন্ধান করে।

বঙ্গাব্দের বয়স কিন্তু ‘হাজার বছর’ নয়, মাত্র সাড়ে তিন শ বছর। একই সঙ্গে এই অব্দটি মরুসংস্কৃতিজাতও। অর্থাৎ এর জন্ম হিজরি সনের উদর থেকে। মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে খাজনা আদায় করা হতো শস্যের বিনিময়ে। নতুন শস্য ঘরে উঠলে রাজ-কর্মচারীরা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাজনা আদায় করে আনতো। তারা যেত হিজরি সনের একটি নির্দিষ্ট তারিখে। বিপত্তিটা বাঁধলো ওখানেই। প্রতি বছর হিজরি সন সৌরবর্ষ থেকে এগারো দিন বেড়ে যায়। এ ক’দিনের ব্যবধানে অনেক কৃষকের ফসল ঘরে উঠতো না। ফলে খালি হাতে ফিরে যেতে হতো খাজনা আদায়কারীদের। এতে খাজনা আদায়ে দেখা দেয় দারুণ বিশৃঙ্খলা। চিন্তিত হয়ে পড়লেন সম্রাট আকবর। কী করা যায়? ডাকা হলো ইরানের সিরাজ নগরীর জ্যোতির্বিদ আমীর ফতেহ্উল্লাহ্ সিরাজীকে। বিচক্ষণ জ্যোতির্বিদ ৯৬৩ হিজরী সনের পাশাপাশি প্রণয়ন করলেন একটি সৌর সন, ৯৬৩ বঙ্গাব্দ। খ্রিস্টাব্দ হিসেবে হিজরি সনের ভিত্তি ৬২২ অর্থাৎ মুসলমানদের নবী মুহাম্মদ (দ.) যেদিন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন, আর বঙ্গাব্দের ভিত্তি ধরা হলো ৬২৮। তাই বলে হিজরি ও বঙ্গাব্দের মধ্যে তফাৎ যে নেই তা কিন্তু নয়। প্রতি ৩৩ বছরে হিজরি সাল এক বছর করে বঙ্গাব্দের চেয়ে এগিয়ে আসে আর বঙ্গাব্দ পিছিয়ে যায় এক বছর। পেছাতে পেছাতে বর্তমানে (১৪১৮) বঙ্গাব্দ পেছালো প্রায় ষোল বছর। সুতরাং হিজরি জঠরজাত হলেও চান্দ্র ও সৌর সনের মধ্যে প্রভেদ রয়েছে।

তো বিশাল মোঘল সাম্রাজ্যের অধিবাসী কেবল বাঙালিরাই ছিল না, ছিল অন্য জাতিগোষ্ঠীও। সম্রাট আকবর কেবল বাঙালি, বাংলাদেশ কিংবা বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য এ বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করেননি, করেছেন অভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য। সুতরাং বাংলা নববর্ষ কিংবা বঙ্গাব্দকে জবরদস্তিমূলকভাবে ‘একান্ত বাঙালির সংস্কৃতি’ বা ‘বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য’ বা ‘বাংলা সন’ বলাটা হাস্যকার। অতিমাত্রায় ঐতিহ্যপ্রীতি দেখাতে গিয়ে অজ্ঞানতাবশত কেউ কেউ এসব ভুল করে থাকেন।

দুই.
হাজার বছরের না হলেও বাংলা নববর্ষ এখন আমাদের শত বছরের ঐতিহ্য। বিপত্তিজনিত কারণে হলেও সম্রাট আকবর এই অব্দটি প্রবর্তন করে আমাদের ঋণী করেছেন। তিনি এ কাজটি না করলে বছর গণনার জন্য আমাদের কোনো অব্দ থাকতো না। যেমন নেই পাকিস্তানের। ওরা ধার করা অব্দ দিয়ে বছর গণনা করে থাকে। বঙ্গাব্দ এখন সমগ্র বাংলার বিশাল জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। গুটিকয়েক পাকিস্তানমুখী ও আরবীয় সংস্কৃতিমুখী ব্যক্তি ছাড়া সকল জাতিগোষ্ঠীর কাছে পহেলা বৈশাখ একটি বিশেষ দিন হিসেবে বিবেচিত। জামিদারী আমলে জমিদারগণ পহেলা বৈশাখে খাজনা আদায়ের সূচনা করতেন ‘পুন্যাহ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বর্তমানে এ দিনে গ্রাম ও নগর বাংলায় আয়োজিত হয় নানা উৎসব-অনুষ্ঠানের। ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা আয়োজন করেন হালখাতা উৎসবের। সারা বছর যেসব খদ্দেরের কাছে বাকিতে সদাই বিক্রি করেছে, তাদের প্রত্যেককে চিঠি দিয়ে মিষ্টি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। উদ্দেশ্য একটাই, পাওনা উসুল করা। আগে এ আমন্ত্রণ জানানো হতো মুখে, মুদ্রণযন্ত্র আসার পর জানানো হয় ছাপানো পত্রে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, নিমন্ত্রণপত্রের কোথাও লেখা থাকে না যে, ‘আসার সময় পাওনা টাকা নিয়ে আসবেন’। লেখা থাকে : ‘এ হালখাতা উৎসবে আপনি/আপনারা সবান্ধব/স্বপরিবারে আমন্ত্রিত।’ তুচ্ছ টাকার জন্য স্বাভাবিক সৌজন্য নষ্ট করা হয় না। এখানেই বাংলার সামাজিক বৈশিষ্ট্য টের পাওয়া যায়। স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ, সামাজিক সম্প্রীতি এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

পহেলা বৈশাখের বিশেষ দিনে বিগত বছরটির সব হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে নির্ঝ্ঞাট সুন্দর একটি বছর শুরু করতে চায় সবাই। কিষাণ কৃষাণী, কামার, কুমোর, জেলে-তাঁতী, দোকানি সবাই। এ দিনে ব্যবসায়ীগণ বাকিতে সদাই বিক্রি করে না। তাদের প্রথাগত বিশ্বাস, বছরের প্রথম দিনে বাকিতে বিক্রি করলে সারা বছরই বাকিতে বিক্রি করতে হবে। একই বিশ্বাসে এ দিনে কেউ কারো সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে না। একইভাবে বাড়ির বৌ-ঝিরাও রান্না করে ভালো মানের খাবার-দাবার। বছরের প্রথম দিনে খারাপ খেলে সারা বছরই খারাপ খেতে হবে যে!

অপরদিকে, পহেলা বৈশাখে তিতা শাক খেলে কোনো রোগ-বালাই হয় না- এ বিশ্বাসে কোনো কোনো এলাকায় তিতা শাক খাওয়ার প্রচলনও রয়েছে। রয়েছে কাঁচা হলুদ ও নিমপাতা বেটে সারা শরীরে মাখিয়ে রাখার নিয়ম। আরো রয়েছে বাসি কিছু না খাওয়ার নিয়ম। আবার কোথাও কীর্তনের আয়োজনও হয়ে থাকে। কীর্তনিয়ারা প্রতি বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রাসাদ মাগে। গৃহস্থ বৌ-ঝিরা চাল-ডাল ইত্যাদি তুলে দেয় তাদের হাতে। তা দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রান্না হয় খিচুড়ি।

নববর্ষের আয়োজন শুরু হয় মূলত বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির দিন থেকেই। গ্রাম বাংলায় পহেলা বৈশাখের মতো চৈত্রসংক্রান্তিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মূল আয়োজন শুরু হয় এ দিন থেকেই। অঞ্চলভেদে আলাদা আলাদা রেওয়াজ চালু আছে। সাধারণত এ দিনে সকাল থেকেই ঘোরদোর ঝাড়মোছ শুরু হয়। দুপুরের পর চৌদ্দ রকমের শাক সংগ্রহ করে একসঙ্গে রান্না করে খাওয়া হয়; যাকে বলা হয় কিনা ‘পাঁচন’। মাছ-মাংস খাওয়া হয় না এদিনে। কোনো কোনো এলাকায় চৈত্র সংক্রান্তির সন্ধ্যায় মদনদ্বীপও জ্বালানো হয়ে থাকে।

চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে অনেক এলাকায় চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়ায় এখনো এ পূজার প্রচলন রয়েছে। সকাল থেকে চড়কগাছ বসাবার আয়োজন শুরু হয়। বিকেলে বের হয় শোভাযাত্রা। দুজনকে শিব-পার্বতীর বেশে সাজানো হয়। তারা শোভাযাত্রার সামনে থাকে। ঢাক-ঢোল-মৃদঙ্গ-করতাল-ঘন্টা ও শঙ্খের শব্দের তালে তালে সুরে সুরে নাচতে নাচতে চড়ক তলায় এসে উপস্থিত হয় সবাই। গোধূলীতে শুরু হয় চড়ক ঘুরানোর পালা। উলুধ্বনি দিতে দিতে মাঠময় ছিটানো হয় গজা-নকুলদানা ইত্যাদি।

অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীরা পালন করে বৈশাবী উৎসব। বহুবৈচিত্র্যপূর্ণ থাকে তাদের সেই আয়োজন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে তাদের মধ্যে প্রচলিত আছে আলাদা প্রথা। অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এক এক জেলায় রয়েছে এক এক প্রথার প্রচলন। একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। এসবই হচ্ছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য।

কিন্তু এখানে একটা জটিলতা টের পাওয়া যায়। চৈত্রসংক্রান্তি কিংবা পহেলা বৈশাখকে ঘিরে এই যে এত সব আচার-অনুষ্ঠানÑ এগুলো কতদিন ধরে প্রচলিত? বঙ্গাব্দ প্রচলনের আগেও কি এসব আচার ছিল, নাকি ছিল না? ছিল না যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ বৈশাখ কিন্তু শুরুতে বছরের প্রথম মাস ছিল না, শুরুর মাস ছিল অগ্রহায়ণ। পরবর্তীকালে এ স্থান দখল করে নিলো বৈশাখ। অর্থাৎ ঐতিহ্যের হেররফের ঘটেছে। সময়ের সঙ্গে  ঐতিহ্যেরও পরিবর্তন ঘটে। আসলে চিরন্তন বলে যে কিছু নেই! তাহলে পহেলা বৈশাখ বা চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে এসব প্রথার প্রচলন থাকবে কেন? সুতরাং ‘হাজার বছরের সংস্কৃতি’ বলাটা আতিশয্য ছাড়া আর কী?

তিন.
অতি প্রাচীন না হলেও পহেলা বৈশাখ এখন আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। এখন পহেলা বৈশাখ মানেই নববর্ষ। এ বিশেষ দিন উপলক্ষে গ্রাম বাংলায় মেলা বসে। সেসব মেলায় গরম জিলাপি, গজা, নকুলদানা, বাদাম, খই, বাতাসাসহ নানা রকমের খাবার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র আর নানা রকমের খেলনা ওঠে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে ঘোরে নাগরদোলা, চলে পুতুলনাচ। আয়োজন হয় বলিখেলার, আমানী খাওয়া, গম্ভীরা, লাঠিখেলা কিংবা বায়স্কোপ, যাদুমন্ত্র, বাঁদরনাচ, সাপখেলাসহ আরো কত আয়োজন...।

যারা নগরে বাস করেন, নববর্ষ শব্দটি শোনা মাত্রই তাদের অনেকের মনের ভেতর শৈশব উঁকিঝুঁকি দিয়ে যায়। চঞ্চল হয়ে ওঠে মন। বড় ইচ্ছে করে ছায়া সুনিবিড় আম্রতলের কাদামাটির পুতুল কিংবা গোল্লাছুট খেলায় মেতে উঠতে। নববর্ষ এলে মনে পড়ে যায় ফেলে আসা অসংখ্য এলোমেলো স্মৃতি। সেই স্মৃতির খানিকটা উজ্জ্বল, খানিকটা আবছা। নববর্ষ এলে ইচ্ছে হয় ভোরে সবাই ঘুম থেকে জাগার আগে চুপিচুপি বনে গিয়ে আম কুড়াতে। নববর্ষ এলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বজ্রের চোখ ঝলসানো আলো আর বাতাসের শাঁই শাঁই শব্দ। নববর্ষের বিজন দুপুরে গলাফাটা চিৎকার করে কাকে যেন ডাকতে ইচ্ছে হয়।

নববর্ষে নগরবাসীর মনে এই যে এত কথা, এত স্মৃতি জেগে ওঠে এর পেছনে কারণ একটাই, তাদের শরীরে যে লেগে আছে ঐতিহ্যের অবলেশ! নাগরিক জীবনে আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির ঘেরাটোপে পড়ে থাকতে থাকতে যদিও তারা সেই চিহ্নের কথা ভুলে যায়, কিন্তু বছরের একটা বিশেষ দিনে তা তাদের মনের মণিকোঠায় উদয় হয়। জানান দিয়ে যায়, তাদেরও যে ঐতিহ্য বলে একটা কিছু আছে।

হালে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন শহরে আয়োজন করা হয় বৈশাখী উৎসবের। ঢাকার রমনা-শাহবাগ-টিএসসি এলাকায় ধুম পড়ে যায় পান্তা-ইলিশ খাওয়ার। মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রথাটা আসলে কোন দেশের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য তা আমাদের বোধগম্য নয়। কে কবে কোথায় এ নিয়ম চালু করেছিল তা গবেষণার বিষয়। এর সঙ্গে এ দেশীয় ঐতিহ্যের কোনো সাযূজ্য নেই। গ্রাম বাংলার মানুষরা পহেলা বৈশাখের দিনে যে বাসি খাবার বা পান্তা-ইলিশ খায় না, তা আগেই বলা হয়েছে।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে গ্রাম বাংলায় মেলা জমে আর শহরে জমানো হয়। শহরের এসব মেলা জমায় বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি। তাদের পৃষ্টপোষকতায় মেলা জমানো হয়। ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে এ ধরণের ঐতিহ্যচর্চার মধ্যে ঐতিহ্যপ্রীতি যে নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুখের কথা হচ্ছে, পহেলা বৈাশাখ উপলক্ষে গ্রাম বাংলার মেলাগুলো এসব স্পন্সর বা পৃষ্ঠপোষকতার ধার ধারে না। কে মেলায় এল আর গেল তাতে কারো কোনো মাথাব্যথা থাকে না। প্রতিবছর স্বাভাবিকভাবেই মেলা জমে যায়, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় মেলা জমাতে হয় না। প্রাণের টানে, নাড়ির টানে, মাটিলগ্ন বিনোদনের টানে মানুষ ছুটে আসে সেসব মেলায়।

তিন.
নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রাম বাংলায় প্রচলিত উল্লিখিত সংস্কারকে নগর কিংবা উপ-নগরবাসী কতিপয় ‘শিক্ষিত’ ব্যক্তি নিছক ‘কুসংস্কার’ বলে উড়িয়ে দিতে চান, ঘৃণায় নাক সিঁটকান, উপহাসের হাসি হাসেন। একইভাবে গ্রামের যারা তথাকথিত ওই শিক্ষিত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন, তারাও এগুলোকে কুসংস্কার বলে তিরস্কার করেন। এ ছাড়া ধর্ম নিয়ে যারা বাণিজ্যে লিপ্ত, তারা তো এসবকে বহু আগেই ‘নাযায়েজ’ বলে আখ্যা দিয়ে রেখেছেন। তাদের কথা বাদই দিলাম। তারা প্রকাশ্যেই দেশীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে না, মরুসংস্কৃতিই তাদের কাছে প্রধান। ফলে তারা আলোচনার বিষয় হতে পারে না। কারণ তারা স্বঘোষিত উন্মূল। কিন্তু যারা প্রকাশ্যে নিজেদের বাঙালি বলে দাবি করেন, অথচ আচার-আচরণে অবাঙালিভাব দেখান, তারা যে এসবকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেন, এর পেছনে একটা বড় কারণ আছে। তারা এসব সংস্কারকে বাঙালির চোখে দেখেন না, দেখেন তথাকথিত আধুনিকতাবাদী, সাম্রাজ্যবাদী বা আধিপত্যবাদী চোখে। সাম্রাজ্যবাদ ‘আধুনিকতা’ নাম দিয়ে তাদের চোখে একটা চশমা পরিয়ে দিয়েছে। সেটির কল্যাণে (!) তাদের কাছে ঐতিহ্যগত এসব সংস্কার ‘কুসংস্কার’ বলে দৃষ্ট হয়। তাদের দৃষ্টিতে এসব ‘কুসংস্কার’ আর থার্টিফাস্ট নাইট ‘সুসংস্কার’। তারা রাধাকৃষ্ণের প্রেম ঠাহর করতে পারে না, কিন্তু ঠিকই মহাআড়ম্বরে উদযাপন করে ভেলেন্টাইন ডে।

আবার যারা সরাসরি বাংলার এসব সংস্কৃতিকে কুসংস্কার বলতে দ্বিধাবোধ করে, তারা এসবকে ‘লোক সংস্কৃতি’ হিসেবে আখ্যা দেয়। ‘লোক’ মানেটা কী, তা আমাদের বোধগম্য নয়। একটা অনুমান করতে পারি যে, যারা কৃষক, পনের কোটি মানুষের জন্য যারা খাদ্য উৎপাদন করেন, যারা এখনো স্বদেশীয় সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতি ও শক্তি জ্ঞান করেন, যারা এখনো ‘অলৌকিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেননি তারাই হচ্ছেন ‘লোক’। অপরদিকে, যারা এ শ্রেণীর মানুষদের ‘লোক’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন, তারা ‘লোক’ নন, তারা হচ্ছে ‘ম্যান’। বাড়িয়ে বললে যাকে ‘জেন্টলম্যান’ বলা যেতে পারে। সহজভাবে বলতে গেলে তারা লোকদের বাইরের কেউ একজন। তারা নিজেদেরকে জেন্টেলম্যান ভাবলেও তাদের প্রকৃত পরিচয় কী, সে বিষয়ে তারাও অবগত নন। ঔপনিবেশিক শিক্ষা তাদেরকে শিখিয়েছে, তুমি যে শিক্ষায় শিক্ষিত তা ‘লোকদে’র শিক্ষা নয়। লোকদের শিক্ষা ভিন্ন। যেহেতু তুমি লোক-বহির্ভূত একটি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছ, তাই তুমি আর লোক নও। তোমার পরিচয় অন্য কিছু। কিন্তু কী সেই পরিচয়, তা তার শিক্ষা বলে না। সচেতনতার সঙ্গে তা গোপন করে রাখা হয়।

বিশাল বাংলার সংস্কৃতিকে খাটো করে দেখার উপযোগী আরো কিছু শব্দ এখনো বহাল দেখা যায়। যেমন ‘ফোকলোর’। আমাদের বাংলা একাডেমীতে ‘ফোকলোর’ নামে আলাদা একটি বিভাগও রয়েছে। তামাশা আর কাকে বলে! হালে আরো একটি ইংরেজি অভিধা শোনা যায়- subaltern বা নিম্নবর্গ। পশ্চিম থেকে ধার করা একটি ‘উচ্চবর্গীয়’ শব্দ। যা এদেশীয় সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চর্চা করে, লালন করে তা কিনা নিম্নবর্গের সংস্কৃতি! তবে উচ্চবর্গ কারা? এসব উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের ওজনদণ্ড কী? নিম্নবর্গরা যদি কথিত উচ্চবর্গদের বলে তোমরাই নিম্নবর্গ, কারণ তোমরা সংখ্যায় কম, তবে এ যুক্তি খণ্ডানোর উপায় কী? এসব ‘লোক সংস্কৃতি’, ‘ফোকলোর’ বা ‘সাবঅলটার্ন’ ধরণের আধিপত্যবাদীমূলক শব্দগুলো দিয়ে এ ইঙ্গিতই করা হয় যে, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিটাই হচ্ছে এ দেশের মূলধারার সংস্কৃতি আর বিশাল বাংলার সংস্কৃতি হচ্ছে পদানত বা দ্বিতীয় শ্রেণীর সংস্কৃতি। এ যেন মাতৃক্রোড়ে বসে মাকেই অস্বীকার!

এই লোক-বহির্ভূত অলৌকিক জেন্টলম্যানরা যাদের শিখিয়ে দেয়া বুলি আওড়ান, তারাও কিন্তু এসব জেন্টলম্যানদেরকে তাদের স্বগোত্রীয় বলে স্বীকার করে নেয় না। উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক প্রভু ও গোলামের। যদিও কথিত এসব ভদ্রলোকরা ভাবেন যে, তারা মুনিবদেরই একজন। ফলে তাদের অবস্থান হয়ে পড়ে মাঝামাঝি একটা জায়গায়; যারা কিনা উদ্বাস্তু, শেকড়হীন, উন্মুল। এই উন্মূল শ্রেণী ঐতিহ্যপ্রীতি দেখাতে গিয়ে স্পন্সর নিয়ে আয়োজন করে বৈশাখী মেলার, মেতে উঠে পান্তা-ইলিশ ভোজন উৎসবে। দুই নৌকায় তাদের পা। কাক ময়ূরের নাচ শিখতে গিয়ে যেমন নিজেরটাই ভুলে গেছে ঠিক তাই।  

তারা এ দেশীয় ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির বিভিন্ন রীতিনীতিকে ‘কুসংস্কার’, ‘লোক সংস্কৃতি’, ‘ফোকলোর’ বা ‘সাবঅলটার্ন’ বলে প্রচার করে গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিকে উচ্ছেদ করে দিতে চায়। চায় বটে, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না। গ্রাম বাংলার মানুষ এসব অভিধার ধার ধারে না। তারা তাদের জায়গায় স্থির। তারা তাদের সংস্কৃতিকে ছাড়তে নারাজ। ছেড়ে কী হবে? গ্রহণ করবে কোনটা? ওই গোলামি সংস্কৃতি? তা তো কিছুতেই হবে না। আবার কোনো আচার-অনুষ্ঠান পালন না করে কাটখোট্টা যান্ত্রিক জীবন যাপন করতে রাজী নয় তারা। সম্ভবত তাদের শক্তিটা এখানেই। এ শক্তিতে আস্থা না রাখলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকটের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সমাজে অন্তর্দ্বন্ধ তো লেগেই আছে। কোনো জাতিগোষ্ঠী যখন সমাজবদ্ধ হয়ে এক রীতি-প্রথা মেনে সংঘবদ্ধ থাকে তখন তারা টিকে যায়, অন্য সমাজ বা সংস্কৃতি তাদেরকে সহজে গ্রাস করতে পারে না। সুতরাং চৈত্রসংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখের এসব অনুষঙ্গ আমাদের সাংস্কৃতিক আশ্রয়। এই আশ্রয়ে থাকলে খুব সহজে আমাদেরকে অস্তিত্বের সংকটে পড়তে হবে না। দেশীয় সংস্কৃতির ভীত মজবুত থাকলে আগ্রাসী সংস্কৃতি খুব সহজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

পহেলা বৈশাখকে ঘিরে এই যে এতসব আয়োজন তাও কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। সংস্কৃতিরও পরিবর্তন আছে। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হয়। চিরন্তন বলে কিছু নেই। তবে সেই পরিবর্তন নিশ্চয়ই উল্লম্ফন হবে না। ঐতিহ্যের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে সংস্কৃতি তার নিজ পথ আবিষ্কার করে নেবে।

swakrito-nomanস্বকৃত নোমান
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক


সম্পাদক : লুৎফর রহমান হিমেল

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান