
মানবসভ্যতার উদ্ভব এবং বিকাশধারায় কৃষিজ-উৎপাদন ব্যবস্থা আর প্রাকৃতিক ফল-মূলাদির প্রসঙ্গ জড়িত অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণে। চিন্তা-স্বপ্ন-কথা সভ্যতানির্মাণে এই তিন অনুষঙ্গ নিশ্চয় এসেছে উৎপাদন-পদ্ধতি আবিষ্কারের অনেক পরে।
জীবনধারণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন খাদ্য আর খাদ্যের প্রধান প্রধান সরবরাহকেন্দ্র— ভূমি, জলাশয়, লতাপাতা এবং বৃক্ষরাজি। যেহেতু বাঁচবার প্রসঙ্গ আসে সবার আগে, তাই খাদ্য সংগ্রহ ও গ্রহণ সভ্যতানির্মিতিপথে প্রথম আলোকবর্তিকা। বিস্ময়কর হলেও সত্য এবং আনন্দ-প্রকাশক খবর হলো— বাংলা সালের উদ্ভব এই চিরায়ত উৎপাদন-প্রক্রিয়ার অনুকূলে।
বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে এদেশের মানুষের জীবনধারা এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের নিরিখে। প্রধানত ফসলের মৌসুম চিহ্নিতকরণ এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা পঞ্জিকার প্রবর্তন করা হলেও এটি মিশে গিয়েছে সমগ্র জাতির অস্থিমজ্জায়। চৈত্রে রবিশস্য, বৈশাখে বোরো, জ্যৈষ্ঠে পাকা আম-কাঁঠাল, আষাঢ়-শ্রাবণে ঘনঘোর বরিষণ, নদী জলছলোচ্ছল, শরতে কাশবনে বাতাসের দোলা, অঘ্রাণে নবান্নের উৎসব, পৌষে পিঠাপুলি, মাঘে কনকনে শীত-- এসবই আবহমান লোকজীবনের অতি পরিচিত অনুষঙ্গ। বৈশাখ এখানে আসে কালবৈশাখীর আশংকা সাথে নিয়ে। কিন্তু বাঙালিজীবনে বৈশাখ আসে জীবন সংগ্রামের অফুরান প্রেরণা সঞ্চারিত করে, জীর্ণ-পুরাতনকে ভাসিয়ে দিয়ে নিয়ে আসে নবতর জীবন সংগ্রামের আহবান।
বিশাখা নক্ষত্রের নামে বৈশাখ মাসের নামকরণ হয়েছে। বিশাখা স্বয়ং বাংলার পথে-প্রান্তরে নদ-নদীতে বন-বীথিকায় আগুনের হল্কা ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় গ্রীষ্মকালজুড়ে। তার আগমনী যতই রুদ্র-কঠোর হোক তবু তা আশা জাগানিয়া, তবু তা মোহনীয় এবং প্রেরণাদায়ী। কারণ, গ্রীষ্মে তাপিত চরাচর কাঠিন্যের বাতাবরণে অবরুদ্ধ থাকলেও এর অন্তর থাকে বাংলার কোমল রসধারায় পূর্ণ। ফলে বৈশাখের আকাশে দৈত্য সৈন্যের মতো যে কৃষ্ণ মেঘমালা ধেয়ে আসে তা তার অজস্র ঘট থেকে শান্তির বারিধারা বর্ষণ করায় বৈশাখ নিয়ে আসে এক অপরূপ স্নিগ্ধতা। তাই হয়তো এই দিনটির গভীর ব্যঞ্জনাময় প্রকাশধ্বনির ফলে তথাকথিত ইংরেজ বা ফিরিঙ্গী মানসিকতাসম্পন্ন বাঙালির হৃদয় বলে ওঠে ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’।
নববর্ষের তাৎপর্য প্রধানত বাঙালির শেকড়ের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্কের মধ্যে নিহিত। বাঙালির সুখ, দুঃখানুভূতি, আনন্দ-বেদনা, চিন্তা-চেতনা, আশা-নিরাশা, চাওয়া-পাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, নিজেকে প্রকাশের ব্যাকুলতা সবকিছুই নববর্ষের অনুষ্ঠানাদির মধ্যে প্রকাশমান। গান-নৃত্য-বাদ্য-পোশাক-পরিচ্ছদ-খাদ্য-খাবার সবকিছুই বাঙালিকে এদিন এক নতুন রূপ এনে দেয়। নববর্ষ আমাদের সংস্কৃতিকে, আমাদের সভ্যতাকে, আমাদের ভেতরকার সত্যিকারের মানুষটিকে তথা মনুষ্যত্বকেই সকলের সামনে উঁচু করে মেলে ধরে। এর মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্বময় জানান দিতে পারি যে, আমরা মনুষ্যধর্মের প্রতি আস্থাশীল, আমরা সত্য-ন্যায়-কল্যাণ ও মানবিক যা কিছু, সেসবের প্রতি সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত ও সমর্পিত। মানববিজ্ঞানের সেই মূল প্রেরণা, যা কি-না মধ্যযুগে বাংলার কবি চণ্ডীদাসের মধ্য দিয়ে বাঙ্ময় রূপ পেয়েছে— ‘শুনহে মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই’— এই হচ্ছে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির মূল মর্ম।
আবহমান বাংলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই বাংলা নববর্ষ। যদিও দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশের মতো এখানেও নাগরিক জীবনের এবং সরকারি কার্যক্রমের সবকিছু চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী, তবুও বাঙালিমননের গভীরে ময়ূরাসন প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলা নববর্ষ। বাংলার কৃষক এই বাংলাদেশের প্রান্তজন-- বাংলা মাসের হিসাব ধরেই সে সবকিছু করে। বাংলা মাসের হিসাবেই এখানে আবর্তিত হয় ষড়ঋতু। যুগ যুগ ধরে এই দেশের চাষী, মজুর, কামার-কুমার, তাঁতী-জেলেসহ নানা পেশার মানুষ বাংলা নববর্ষকে বরণ করে আসছে উৎসব-আয়োজনের মধ্য দিয়ে। বাংলা নববর্ষে এখনও ব্যবসায়ীরা হিসাবের নতুন খাতা খুলে থাকেন, হালখাতা করেন। বৈশাখের প্রথম দিবসে কতশত বছর ধরে গ্রাম-গ্রামান্তরে, নদীপাড়ে, বটের তলায় মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। বৈশাখী মেলা বাঙালির প্রাণের মেলা। কত না বিচিত্র হাতের তৈরি দ্রব্যসম্ভার সেসব মেলায় বিক্রি হয়। সে সকল দ্রব্যসামগ্রীতে বাংলার মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনধারার একটা স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। এ সকল মেলা যেন গ্রাম-বাংলার মানুষেরই প্রতিচ্ছবি। তাদের জীবন যেন খণ্ড খণ্ড হয়ে ধরা পড়ে তাদের হাতের কারুকাজে। মাটির পুতুল, পাটের শিকা, তালপাতার পাখা, সোলার পাখি, বাঁশের বাঁশি, ঝিনুকের ঝাড়, পুঁতির মালা, মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়া-বাঘ-সিংহ কত যে অদ্ভুত সব সুন্দর জিনিসের সমাবেশ ঘটে সেই মেলায়, চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হয় না বাংলার মানুষের জীবন কত সমৃদ্ধশালী। মানুষ গরীব হতে পারে, দারিদ্র্য চিরসাথী হতে পারে, কিন্তু এসব জীবন জটিলতা তাদের মনকে আনন্দ খুশি থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। গানে-সঙ্গীতে তারা তাদের জীবনকে ভরিয়ে তোলে। এটি যেন তাদের শিকড় সংস্কৃতির উজ্জ্বল উদ্ভাস। এই একটি মাত্র উৎসব; হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং উপজাতি-গোষ্ঠী সকলেই যাহা উদযাপন করেন অনাবিল আনন্দ-আবাহনের মধ্য দিয়া। নববর্ষ-উদযাপন কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; আর পাঁচটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পার্বণের মতোই এটি একটি জাতীয় অনুষ্ঠান। কিন্তু অন্যসব আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত-সংলগ্নতার যে আপাত স্পষ্টতা, তা অনেকাংশে পরিহার করেছে নববর্ষ। তার চরিত্র বদলে গেছে; তার ভোক্তারা ভুলে গেছে এর পটভূমি আর জন্ম-ইতিহাস। লাগামছাড়া এই আনন্দে হয়তো তেমন অর্থে কোনো ক্ষতি নেই; কিন্তু বাস্তবত, যদি ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কিংবা ‘ষোলই ডিসেম্বর’ সরে যেতে থাকে তার প্রকৃত পটভূমি থেকে (এমনটি হোক, তা আমরা চাই না), তখন কি আমরা বলবো আনন্দকে তার মতো করে বাড়তে দেওয়া উচিত? অবশ্যই না। কৃষিনির্ভর বাঙালি যদি ঐতিহ্যিক প্রণোদনায় প্রাণ লাগাতো ভূমিজ-উৎপাদন আর ফল-মূলাদির পরিচর্যায়, নববর্ষের বাতাসে যদি যোগ হতো নতুন ফসলের পর্যায়ক্রমিক উন্নয়ন-বহর, নাগরিক নামের আড়ালে লালিত কিছু বিকৃত রুচি যদি ঝেড়ে ফেলতে পারতো নববর্ষের উদার আলোয়, তবে পহেলা বৈশাখ মজবুত পায়ে দাঁড়াতে পারতো তার আপন-অস্তিত্বে। আজকের প্রজন্মের কাছে তেমন প্রত্যাশা নিশ্চয় ‘বেশি-চাওয়া’ হবে না!
নগরজীবনের বাইরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে লোকধারা ও লোক-উৎসব স্বাভাবিকত্ব নিয়ে বহাল ছিল, হয়তো বাইরের চাপ ও প্রভাবে তার অবস্থান সঙ্কুচিত হয়েছে; কিন্তু তা কখনো বিলুপ্ত হয়নি, কেননা লোকজীবন তো নদীর মতোই প্রবহমান, ধারা ক্ষীণতোয়া হলেও প্রবাহের বিরাম নেই। এরকমই এক পটভূমিকায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গে এক নতুন ধারার সাংস্কৃতিক জাগরণ সূচিত হয় ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে, জাতীয় চেতনাবহ সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক স্ফূরণ বাঙালি সত্তাকে পরিপুষ্টি যুগিয়ে তাকে অন্যতর মাত্রা যোগায়। ফলে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া নিছক সঙ্গীতচর্চা হিসেবে গণ্য হয় না, নজরুলকে পরিপূর্ণভাবে পাওয়ার তাগিদ এক প্রতিবাদী চেতনার রূপ নেয়, জাতীয় উৎসবে নগরের অংশগ্রহণ অর্জন করে আরো বৃহত্তর মাত্রা। আর এভাবেই পহেলা বৈশাখের প্রভাতী আয়োজন নিছক ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠান না থেকে হয়ে ওঠে সর্বজনের অন্তরের আয়োজন, তাতে শরিক হয়তো সীমিত সংখ্যক মানুষ; কিন্তু তাতে অংশীদারিত্ব গোটা জাতির। এখানে আরো বিশেষ তাৎপর্যময় দিক ছিল, নগরের সঙ্গে লোকজীবনের বিচ্ছেদমোচনের প্রয়াস। কেননা পহেলা বৈশাখ তো গ্রামজীবনে নিরন্তর প্রবহমান ছিল, ফসলের সঙ্গে, অর্থনীতির সঙ্গে মিলেছিল শিল্পিতভাবে জীবনকে বরণ করবার তাগিদ। আর নগর তো বাঁধা আছে ভিন্ন অর্থনীতিতে, তার সঙ্গে ফসলের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ নেই; কিন্তু এই উৎসবে নগর যোগ দিল তার পরিশীলিত সংস্কৃতি-চর্চার সকল বৈভব নিয়ে। ফলে একদিকে ঘটছিল পুনরাবিষ্কার, অন্যদিকে পুনরুজ্জীবন। নগর ও লোকজীবন মিলে বাঙালির বৈশাখ পূর্ণতার অভিসারী হয়ে উঠতে পেরেছিল এবং তা যেমন নগরের সঙ্গে বৃহত্তর লোকায়ত জীবনসংস্কৃতির বিচ্ছেদ মোচনের উপায় হয়ে উঠেছিল, তেমনি ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিধারা, যা লোকজীবনে ক্ষীণতোয়া হয়ে প্রবাহিত ছিল, তার স্বীকৃতি মিললো নাগরিকজনের কাছ থেকে। বাঙালিসত্তায় এ-যেন বিযুক্তি-মোচন, রিটার্ন অব দ্য প্রডিগ্যাল সান্ এবং বৈশাখ দ্রুতই হয়ে উঠলো জাতিসত্তার জাগরণের প্রতীক, প্রতিরোধের আয়ুধ।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আনন্দ-আড়ম্বরের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আর এর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক দীর্ঘকালের। ইতিহাসের আদি পর্বের দিকে তাকালে দেখা যায় বাঙালি নামের জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল মুসলিম আমলে। প্রাক-মুসলিম আমলে ‘শশাঙ্ক থেকে পাল বা সেন রাজারা কেউ-ই এই অঞ্চলকে কোনো ঐক্যে বাঁধতে পারেননি।’ ফার্সি ভাষায় লিখিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর গড়ে ওঠার ইতিহাস হিন্দু ঐতিহাসিকরা প্রধানত ফার্সি না জানার কারণে আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলা ভাষা ও বাংলা অক্ষরমালা— যা বাঙালি জনগোষ্ঠীর ঐক্য ও স্বাতন্ত্র্যের ধারক, এ দুটো উপাদানের উদ্ভব ও বিকাশ যে মুসলিম শাসনামলে তা অনেক হিন্দু সাহিত্যিকও অকপটে স্বীকার করেছেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ভাষায় রূপ লাভ করেছিল পাঠান আমলে, মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায়। মোগল আমলে যখন এই অঞ্চল সর্বভারতীয় শাসনের অধীনে ছিল তখন এর নাম ছিল ‘সুবাবাংলা’। আদিতে এ অঞ্চল গৌড়, সমতট, রাঢ়, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, সুবর্ণবীথি, বঙ্গ প্রভৃতি নামে বিভক্ত ও পরিচিত ছিল।
হাতে-গোনা কয়েকটি দাতাসংস্থা এবং উন্নয়ন-অংশীদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে মুমূর্ষু ভাবলেও আসলে কিন্তু বাংলাদেশ মুমূর্ষু নয়। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা অমিত সম্ভাবনাময় একটি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, ভাষা, সংস্কৃতি বৈচিত্র্যে ভরপুর। বাংলাদেশের গরীব মানুষেরা পরিশ্রমী এবং তারা কাজ করতে ভালবাসে। কাজের মধ্যেই তারা জীবনের আনন্দ ও গৌরব খুঁজে পায়। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসনামলের তুলনায় স্বাধীন বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিশুমৃত্যুহার কমেছে, বেড়েছে গড় আয়ু, শিক্ষার হার এবং কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের পদচারণা। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। দু’তিনটি সরকারি এবং একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ প্রজন্মের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা অনেক স্মার্ট এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী। কর্মক্ষেত্রে এরা নেতৃত্ব দানের সুযোগ পেলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর হবে বলে আশা করা যায়।
এরই মধ্যে বাংলাদেশে নাগরিকদের জীবনযাপনে যে পরিবর্তন এসেছে তা আধুনিক শপিংমলগুলোতে ঢুকলে টের পাওয়া যায়। তবে এটাও ঠিক যে এই উন্নয়নের জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রকৃত সৌন্দর্যের আধার যে গ্রাম, সেই গ্রাম থেকে ছিন্নমূল মানুষের স্রোত এসে আঘাত হানছে শহরে। কাজের আশায়, বাঁচার জন্য এরা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছে। গ্রামে থাকতে এরা উৎপাদনী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং গ্রামে কাজের অভাব তাদেরকে ঘর ছাড়া করেছে। এদের কল্যাণে কোনো কর্মসূচি দেখা যায় না। এরা শহরে বস্তির বিস্তার ঘটাচ্ছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শহরে অভিবাসন এক কঠিন এবং দুঃখজনক ঘটনা হলেও একে উন্নয়নের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেখতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটাই সাধারণ চিত্র। ঊনিশ এবং বিশ শতকের শুরুতে ইউরোপ এবং আমেরিকাতেও এমনটি ঘটেছিল। ধনবাদী বিকাশের এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। মানবিক অনুভূতির কাছে এ দৃশ্য যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন অগণিত মানুষকে নিঃস্ব না করে সীমিতসংখ্যক মানুষের আনন্দ উৎসব কি বিদ্যমান ব্যবস্থায় কল্পনা করা যায়?
নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় কোনো জাতির ঐতিহ্যিক-সাংস্কৃতিক আভিজাত্য। বাংলাদেশেও গ্রামে-গঞ্জে মেলা ও নানান আনন্দ-আয়োজনের মাধ্যমে তার প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু, একসময়, ভারতবর্ষে নগরকেন্দ্রিক যে ‘কালচার্ড’ সভ্যতার বিকাশ, তার পথ-পরিক্রমায় আমরা আজকে যেমনতরো নাগরিক সমাজে পা রেখেছি, তা এক অর্থে, বাঙালির ঐতিহ্যিক আভিজাত্যে অপ্রতিরোধ্য অভিশাপ হিসেবে স্থিত। ভিনদেশি সংস্কৃতি— পোশাকে-আচরণে-চিন্তায়-বিচরণে এমনকি শিক্ষা ও খাদ্যগ্রহণে আমাদের চেতনায় আরোপিত ধারণার মতো ক্রিয়াশীল থাকায়, নববর্ষের আবাহনকেও আমরা, অনেকটাই, করে তুলেছি কদর্য। আমরা ঘরে বসে মায়ের হাতে তৈরি আলু ভাজা না খেয়ে বরং পার্কে কিংবা সংসদ ভবনের সামনে ভাম্যমাণ রোস্তোরাঁয় ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। হাফপ্যান্ট পড়ে হাঁটতে থাকি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সুপার মলের পথে। সকালে বেড-টি পান করে হাতড়াতে থাকি আমেরিকান ফ্রোজেন বেগুনভর্তা বা প্যাকেট-মোড়া মালয়েশিয়ান পরোটা। ডাবের পানি না খেয়ে অনায়াসে গিলি নরমাল কোল্ড ড্রিংকস। আমের পরিবর্তে খাই ফ্লেভার মেশানো রঙিন ম্যাঙ্গোজুস। ঘরে তৈরি নাস্তার চেয়ে আমাদেরকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে ঘরোয়া পরিবেশে পরিবেশিত ফাস্টফুড কিংবা চায়নিজ-থাই রকমারি খাবার। বাংলা ভাষার মর্যাদাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইংরেজি শেখার দৌড়ে পিছিয়ে পড়তে যেন আমাদের খুব আপত্তি। প্রসাধনীতেও দেখতে চাই ভিনদেশি লেবেল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায়-উম্মাদনা বা অনিয়ন্ত্রিত স্ফূর্তিযোগ জাতিকে, মানবমনকে প্রশ্নবিদ্ধও করে তুলছে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর আর লজ্জার ব্যাপার হলো— বাংলা নববর্ষের উৎসবাদির, এবং বলতে সংকোচ নেই, প্রচারমাধ্যমের অস্বাভাবিক বিস্তারের ফলে এ-কেন্দ্রিক গোলটেবিল-লম্বাটেবিল আলোচনার বহর বাড়লেও কমেছে কৃষিজ উৎপাদনের সাথে আমাদের— বাঙালির সম্পৃক্ততা। রমনা-অঞ্চলে বড় নোটে বাৎসরিক পান্তা-ইলিশের খানাদানা আর পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়, রঙ-বেরঙের আঁকায়-লেখায়-কথায় নতুন বছর বরণ হয়তো করা হয় ঠিকই; কিন্তু মঞ্চের অন্তরালে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত— যাদের জীবন-আবর্ত ঘিরেই আদল পেয়েছিল বাংলা বছর-পরিক্রমা-- সেই লাখো-কোটি প্রায়-অভুক্ত কিংবা অর্ধভুক্ত জনতা।
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছেন: ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি/আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।/তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল/তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।/...তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন/অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন/পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন/তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।’ অথচ কী দারুণ উৎসাহে গা ভাসিয়ে আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের পূর্বপুরুষ-পূর্বমহিলাদের কথা, হারাতে উদ্যত হয়েছি আমাদের বহু বছরের অর্জিত-লালিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অহমিকা! তথ্য আর তত্ত্ব’র দীনতায়, মোহ আর আবেগের আতিশয্যে, লোভ আর নগদপ্রাপ্তি নেশায় আজ আমরা দিশেহারা; শেকড়হীন আছড়ে-পড়া কোনো প্রাচীন বৃক্ষ যেন।
ড. ফজলুল হক সৈকত
বাংলাদেশ সময় : ১৮২৭, এপ্রিল ১২, ২০১২