
বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে: আগামী শনিবারের মধ্যে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালককে পরিবারের হাতে তুলে না দিলে রোববার থেকে কঠোর কর্মসূচি দেবে বিএনপি।
দেশব্যাপী হরতালের তৃতীয় দিন শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হওয়া সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ ঘোষণা দেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ইলিয়াস আলী জনপ্রিয় নেতা। তাই তাকে গুম করা হয়েছে। আমরা আশা করি, তিনি ফিরে আসবেন।’
তার গুলশানের কার্যালয়ে শুরু হওয়া সংবাদ সম্মেলনে খালেদা বলেন, ‘আমরা অনেক ধৈর্য ধরেছি। অনেক নেতাকর্মী হারিয়েছি, অনেক জীবন অকালে ঝরে গেছে, আর নয়। আগামী ২৮ এপ্রিল শনিবারের মধ্যে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালককে পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে। তা না হলে ২৯ এপ্রিল রোববার থেকে আবারো কঠোর কর্মসূচি শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘তার আগে আগামী ২৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। এরপর ২৮ এপ্রিল শনিবার দেশব্যাপী সব উপজেলা সদরে হবে বিক্ষোভ মিছিল। সেদিন কেন্দ্র থেকে পরবর্তী কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি এখনো আশা করি, সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে।’
- হরতালে ফখরুলের পাশে নেই সিনিয়র নেতা ও জোট
- সরকার চাইলেই ইলিয়াস সমস্যার সমাধান: কাদের সিদ্দিকী
- মির্জাপুরে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে সাবেক এমপি-পুলিশসহ আহত ২০
- রানীশংকৈলে আ.লীগ-বিএনপির সংঘর্ষে আহত ৫
- খুলনায় আ.লীগ-বিএনপি সংঘর্ষে আহত ৬
- ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শান্তিপূর্ণ হরতাল চলছে, ছাত্রলীগের হরতাল বিরোধী মিছিল
- মহাখালীতে ককটেল বিস্ফোরণে পথচারী আহত
- আমার ছেলেদের গ্রেফতার করা হয়েছে, চা খেতে চাই না- কাদের সিদ্দিকী
- মুন্সীগঞ্জে হরতালের বিপক্ষে ছাত্রলীগের সভা
- দিনাজপুরে ঢিলেঢালা হরতাল
- হরতাল: নারায়ণগঞ্জে কার্যালয় ছেড়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা মহল্লায়
- মহাখালীতে বাস-স্কুটার ভাঙচুর
- আশুলিয়ায় ৪ পিকেটার আটক
- সুনামগঞ্জে থেমে থেমে বিক্ষোভ মিছিল চলছে
- বিশ্বনাথে ৮ হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ৪২ জন আটক
- হরতালে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁকা
- বাসে অগ্নিসংযোগের দায়ে মিরপুরে আটক ৪
- রাজধানীর টিকাটুলিতে ককটেল বিস্ফোরণ
- খুলনা প্রেসক্লাব থেকে ককটেল উদ্ধার
- পাবনায় চলছে তৃতীয়দিনের হরতাল, আটক ১০
- রাজধানীর গুলশানে ২টি ককটেল বিস্ফোরণ
- সিলেটে পুলিশি বাধার মুখে বিএনপি
‘সারা দেশে আতঙ্ক বিরাজ করছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে নাগরিক সমাজ। ৭ দিন হয়ে গেল, ইলিয়াস আলী নিখোঁজ রয়েছেন। তার পরিবার, স্বজনেরা, আমরা, রাজনৈতিক সহকর্মীরা, এলাকাবাসী এবং দেশের মানুষ তার সন্ধান পাচ্ছেন না। বাসায় ফেরার পথে গত ১৭ এপ্রিল দিবাগত রাতে তাকে এবং তার গাড়িচালক আনসার আলীকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। বাসার কাছেই তার গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।’
বিএনপি প্রধান বলেন, ‘আমরা সবাই দাবি করেছি, ইলিয়াস আলীকে মুক্তি দেওয়া হোক। গাড়িচালক আনসার আলীসহ তাকে সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থায় পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হোক। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে মামলা হতে পারে। আইন অনুযায়ী গ্রেফতারও করতে পারে সরকার। কিন্তু এভাবে গায়েব করে রাখা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং এই অধিকার কারো নেই।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা কোনো অযৌক্তিক কথা বলিনি। বিএনপির নেতারা আমাদের দাবি নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে কথা বলেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। আমরা আশা করেছিলাম, সরকার দ্রুত বিষয়টির আইনসম্মত ফয়সালা করবে। সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটবে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়- সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে পুরো বিষয়টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দিলেন। তিনি বললেন- আন্দোলনের ইস্যু তৈরির জন্য আমরাই নাকি ইলিয়াস আলীকে লুকিয়ে রেখেছি।’
একই সঙ্গে তিনি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের দিকে ইঙ্গিত করে আমাদের হুমকি দিলেন- আপনাদের তৈরি করা বাহিনীই আপনাদের খাবে।’
বিএনপি প্রধান বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের প্রধান নির্বাহীর এ ধরনের বক্তব্যের নিন্দা করার ভাষা আমার জানা নেই। এই দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্য ও হুমকির কারণেই প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মনোভাব পুরোপুরি পাল্টে যায়। তারা ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালককে জনগণের সামনে হাজির করার বদলে নানা ধরনের নাটক সাজানো ও কাহিনী তৈরিতে উৎসাহী হয়ে ওঠে।’
তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তাই বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের ডাক দেয়। আমরা এই হরতালের পক্ষে দেশবাসী, নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সংগঠন ও সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থন চাই। তারা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু সরকার ও সরকারি দল আমাদের এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বিরুদ্ধে রাস্তায় লোক নামায়। বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালায়। কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু করে। আমাদের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি অফিস পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসী দিয়ে অবরোধ করে রাখা হয়। আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঠেকাতে তারা সংঘর্ষ ও বল প্রয়োগের পথ বেছে নেয়। বিরোধী দলের কর্মসূচি দমনে পুলিশের পাশাপাশি তারা র্যাবকেও ব্যবহার করে।’
‘সরকারি দলের লোকজন পুলিশ ও র্যাবের পাহারায় বিভিন্ন জায়গায় মিছিল করেছে, বিরোধী দলের মিছিলে ও অফিসে হামলা করছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘অথচ আমাদের নেতাকর্মীরা হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করতে গেলেই হামলা করা হয়েছে। এতো কিছু সত্ত্বেও পিকেটিং ছাড়াই সারা দেশে পরপর তিন দিন স্বতঃষ্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়েছে। জনগণ ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছেন। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘হরতালে মানুষের কষ্টের কথা আমরা জানি ও বুঝি। কিন্তু সরকার দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সকলের নিরাপত্তা কেড়ে নিয়েছে। প্রত্যেকটি নাগরিককে উদ্বিগ্ন করে ফেলেছে। এ থেকে মুক্তির জন্য আমাদের সকলকে কঠোর প্রতিবাদ ও ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।’
তিনি বলেন, ‘জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনায় নিয়েই হরতাল কর্মসূচি যতদূর সম্ভব এড়িয়ে বিরোধী দল গণসংযোগ, রোডমার্চ, মহাসমাবেশসহ বিভিন্ন বিকল্প ও সৃজনশীল কর্মসূচি পালন করে আসছিল। এতে সর্বস্তরের জনগণও বিপুলভাবে সাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ এসব কর্মসূচিতেও বাধা দিতে শুরু করেছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১২ মার্চ আমাদের ঢাকা মহাসমাবেশ ভণ্ডুল করতে সরকার কি ধরনের জঘণ্য পন্থা অবলম্বন করেছে, তা আপনারা সবাই দেখেছেন। তারপরও আমরা দেশবাসীর ন্যায়সঙ্গত দাবি মানার ব্যাপারে সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এরপরও যদি ইলিয়াস আলীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে এভাবে সন্ত্রাসী কায়দায় ধরে নিয়ে গিয়ে গায়েব করে রাখা হয়, তখন অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরেই কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া ছাড়া বিরোধী দলের আর কোনো উপায় থাকে না। অর্থাৎ সরকারই আমাদেরকে হরতাল ডাকতে বাধ্য করেছে। শুধু তাই নয়, আমাদের কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ। সরকার ও সরকারি দলই উস্কানি সৃষ্টি ও হরতাল-বিরোধী কর্মসূচি দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে।’
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘তাদের সৃষ্ট সহিংস পরিবেশের কারণেই হরতাল শুরুর প্রাক্কালে ও হরতাল চলাকালে দু’জন গাড়িচালককে করুণ মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। প্রতিটি জীবনই খুব মূল্যবান। এই প্রাণহানির ঘটনায় আমি গভীরভাবে মর্মাহত। নিহত দুই গাড়ি চালকের স্বজনদের প্রতি আমি সমবেদনা জানাচ্ছি। তবে এর দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। কেননা, সহিংস পরিবেশ তারাই ডেকে এনেছে। বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দমনে তারাই দলীয় সন্ত্রাসীদের মাঠে নামিয়েছে। সন্ত্রাসীদের খোলা ছাড়পত্র দিলে তারা যে-কোনো ধরনের নাশকতাই করে থাকতে পারে।’
বিএনপি প্রধান বলেন, ‘আমরা প্রথমে একদিনের হরতাল ডেকেছিলাম। পরে সরকারের আচরণেই তা বাড়াতে বাধ্য হই। আমরা বলেছিলাম, ইলিয়াস ও তার গাড়িচালক আনসার আলীকে ছেড়ে দিলে আমরা হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করবো। সরকার আমাদের দাবি মানেনি। বরং সারা দেশে হরতাল বিরোধিতার নামে তারা পুলিশ, র্যাব ও দলীয় সন্ত্রাসী দিয়ে বিরোধী দলের ওপর হামলা করেছে। আমাদের দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমানসহ নারী নেত্রীদের, ঢাকা মহানগর নেতা আবুল বাশারসহ সিনিয়র নেতা ও কর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন চালিয়েছে। আমাদের অফিস অবরোধ করেছে। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি অফিস ভাঙচুর ও লুট করেছে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘পুলিশ শান্তিপূর্ণ অবস্থানে গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে, লাঠিচার্জ করেছে। রাস্তায় নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করেছে। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের পর্যন্ত গলাধাক্কা দিয়েছে পুলিশ। জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের গায়ে হাত তুলেছে, তাদের অসম্মান করেছে। গভীর রাতে আমাদের দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহর বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালাতে গেছে। পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত করে সকলকে উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখেছে। খুলনায় ছাত্রদল নেতা মাহমুদুল হক টিটো ও মুন্নাকে মিছিল করার দায়ে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে পৈশাচিক কায়দায় বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ইলিয়াস আলীর নিজের এলাকা সিলেটের বিশ্বনাথে প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশ ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা যৌথ হামলা চালিয়েছে। তারা গুলি করে দু’জনকে হত্যা করেছে। এখনও সেখানে সরকারি বাহিনী সীমাহীন অত্যাচার চালাচ্ছে। ঘরে ঘরে তল্লাশি চলছে। প্রায় একশ’ লোককে তারা ধরে নিয়ে গেছে। ভয়ে গ্রামগুলো পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। এই বিভৎস তাণ্ডব অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, জুলুম-নির্যাতন করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। হরতালকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের প্রায় দেড় হাজার নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার নেতাকর্মী। তাদেরকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। না হলে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আরো দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। সেই আন্দোলনের মাত্রা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের কারণেই আমাদের হরতাল কর্মসূচিকে তিন দিন পর্যন্ত বাড়াতে হয়েছে। আজও ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালককে জনসমক্ষে আনা হয়নি। কাজেই আমাদের আন্দোলন থামানোরও কোনো সুযোগ নেই।’
বিএনপি প্রধান বলেন, ‘সরকারের সমর্থক কিছু ব্যবসায়ী নেতা ও ব্যক্তি হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। আমি তাদের বলবো- সরকারের সঙ্গে তো আপনাদের নিয়মিত দেন-দরবার হয়। আপনারা তাদেরকে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালককে ছেড়ে দিতে বলুন। সন্ত্রাস, হত্যা, গুম, অপহরণ বন্ধ করতে বলুন। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলুন। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট নিরসন করতে বলুন। শেয়ারবাজার লুটের টাকা ফেরত দিতে বলুন। দুর্নীতি বন্ধ করতে বলুন। ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ঋণ নিয়ে সরকার চালাতে নিষেধ করুন। নির্যাতন বন্ধ করে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বলুন। সংসদকে কার্যকর করতে বলুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করতে বলুন। সীমান্তে হত্যা বন্ধ করতে বলুন। জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে বলুন। আমরা হরতাল ডাকবো না। আন্দোলনও আমরা করবো না। সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণই রায় দেবে, দেশ পরিচালনার ভার কাদের হাতে থাকবে।’
‘পুরো দেশটাকে আজ মগের মুল্লুকে পরিণত করা হয়েছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কোথাও কোনো আইনের শাসন নেই। বিচার বিভাগ এখন প্রায় ন্যায়বিচার শূন্য। দলবাজ কিছু লোকের চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্যে রাজনৈতিক মতলব হাসিলের ক্রীড়নকে পরিণত করা হচ্ছে বিচার ব্যবস্থাকে। প্রশাসন স্থবির। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আইনসম্মত পন্থায় চলতে দেওয়া হচ্ছে না। দুর্নীতি, অনিয়ম, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।’
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘রেলওয়ের দুর্নীতি ও ঘুষের টাকা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পৌঁছে দিতে যাবার পথে হাতে-নাতে ধরা পড়ার ন্যক্কারজনক ঘটনায় সারা দেশে ধিক্কার ওঠার পর তিনি পদত্যাগ করলেন। প্রধানমন্ত্রী সংবিধান লঙ্ঘন করে শপথ ছাড়াই তাকে মন্ত্রী পদে বহাল রেখে দুর্নীতিকে পুরস্কৃত করেছেন। প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে সোহেল তাজ পদত্যাগ করার পরও একইভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাকে বেতন-ভাতা দিয়ে গেছেন। অবশেষে তিনি বিবেকের তাড়নায় নিজের সম্মান রক্ষার্থে সংসদ সদস্য পদেও ইস্তফা দিয়েছেন। এর জন্য সোহেল তাজকে ধন্যবাদ জানাই।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এবং এই সরকারের সঙ্গে এখনো যারা আছেন, তাদের মধ্যে সামান্য আত্মমর্যাদা বোধ ও দেশপ্রেম যাদের আছে, আমি তাদেরকেও একই পথ অনুসরণের আহ্বান জানাই। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর একদলীয় শাসন জারি করেছিল। এবার দেশে কায়েম হয়েছে এক ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারী শাসন। সামান্যতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, পরমতের প্রতি একটু শ্রদ্ধাবোধও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেই। কারো কথায় তিনি কর্ণপাত করেন না। নিজের খামখেয়ালিপনা ও স্বেচ্ছাচারিতায় যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তিনি ডেকে এনেছেন, এর পুরো দায়-দায়িত্ব তার একার।’
তিনি বলেন, ‘যারা এসবের দায়-দায়িত্ব বহন করতে চান না, আমি সময় থাকতে তাদের জনগণের কাতারে শামিল হবার আহ্বান জানাচ্ছি। দেশ, জাতি, রাষ্ট্র ও জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পরিণাম কখনো শুভ হতে পারে না।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ দিশেহারা। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংবিধানিক, প্রশাসনিক, বিচারিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক নানা সমস্যার আবর্তে দেশ আজ তলিয়ে যেতে বসেছে সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতায়। এরা এতো লজ্জাহীন ও প্রবঞ্চক যে বিভিন্ন ব্যর্থতাকেও সাফল্য হিসেবে জাহির করতে তাদের বিবেকে বাধে না। এদের ভাষা অশ্লীল, আচরণ উদ্ধত, ভঙ্গি অসংযত, মন সংকীর্ণ, যোগ্যতা ও দক্ষতা সামান্য, প্রচারণায় উচ্চকণ্ঠ। গণতন্ত্র ও সুশাসনের সঙ্গে এরা অপরিচিত। দেশ পরিচালনার বিরাট দায়িত্ব পালনের কোনো যোগ্যতা এদের নেই।’
তিনি বলেন, ‘তিন বছরের কুশাসন-দুঃশাসনে দেশটাকে এরা আবার মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে। সারা দেশে আজ বিভীষিকার রাজত্ব। মানুষের নিরাপত্তার জন্য যে রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনই আজ আতঙ্কের উৎসে পরিণত হয়েছে। হত্যা, অপহরণ, গুম, তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। আমাদের দলের ঢাকা মহানগরীর প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী আলমকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করে ফেলা হয়েছে। যশোরের নেতা নাজমুলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার লাশ পাওয়া গেছে। সিলেটের ছাত্রদল নেতা দিনার ও জুনেদকে ঢাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তুলে নেওয়ার পর আজও তাদের খোঁজ মেলেনি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন মেধাবী ছাত্রকে একইভাবে তুলে নেওয়ার পর হাইকোর্টের আদেশ সত্বেও তাদেরকে আদালতে হাজির করা হয়নি। এভাবে বর্তমান সরকারের আমলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসেবেই প্রায় সোয়াশ’ লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয়েছে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘এখন সারা দেশে বিরাজ করছে গুমের আতঙ্ক। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নৃশংসভাবে খুন হবার পর প্রধানমন্ত্রী বললেন- তিনি বেডরুমে কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। এরপর সউদি কূটনীতিক খালাফ আলী খুন হলেন রাস্তায়। এখন পথে-ঘাটে, বাসায়-অফিসে নানা জায়গায় প্রতিনিয়ত মানুষ খুন হচ্ছে, অপহরণ হচ্ছে। এমপি হোস্টেলের মতো সুরক্ষিত জায়গায় আজ তরুণীর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীর কাছে আশুলিয়া বেড়িবাঁধের পাশে অনেক মানুষকে খুন করে লাশ ফেলার প্রতিবেদন সংবাদ মাধ্যমে দেখে মানবতা শিউরে উঠেছে। কিন্তু সরকার নির্বিকার। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়িচালক আলী আজম ঘুষের টাকা ধরিয়ে দেওয়ার পর থেকে নিখোঁজ। সাংবাদিকরাও সত্য প্রকাশ করলে গুম কিংবা খুন হয়ে যান। এই অবস্থার অবসান হতেই হবে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘দৈনিক সমকাল পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক দু’জনই সরকার-সমর্থক বলে পরিচিত। সেই পত্রিকায় ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশের জন্য সম্পাদক গোলাম সারওয়ারকে হত্যা কিংবা গুম করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করতে বাধ্য হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, বেছে বেছে বিএনপির একশ’ নেতার তালিকা করা হয়েছে। তাদেরকে একে একে গুম কিংবা খুন করা হবে। সংবাদে বলা হচ্ছে, বিশেষ গুপ্তঘাতক বাহিনী গঠন করা হয়েছে। আমরা আতঙ্কিত। স্বাধীনতার পর এভাবেই রাষ্ট্র পরিচালিত গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী। আজকের শাসকেরাও সেই একই পথ বেছে নিয়েছেন। তাই এই রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট গুম-খুন-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমি দেশবাসীর প্রতি সেই আহ্বান জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘ইলিয়াস আলীকে গায়েব করে রাখার ঘটনায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বে ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যে বিবেকের সাড়া দেখতে পাচ্ছি তাতে আমরা সাহস পাই। আমরা আমাদের সংগ্রামে তাদের অব্যাহত সমর্থন কামনা করি।’
তিনি বলেন, ‘আমি সরকারকে বলবো- অবিলম্বে সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা ও গুম করার ঘৃণ্যপথ পরিহার করে শান্তি ও গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসুন। ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালকসহ যাদের গায়েব করে রাখা হয়েছে, তাদের ফিরিয়ে দিন। আমরা কোনো কঠোর কর্মসূচি দেব না। আমরা অনেক ধৈর্য ধরেছি, অনেক নেতাকর্মী হারিয়েছি, অনেক জীবন অকালে ঝরে গেছে, আর নয়।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আগামী ২৮ এপ্রিল শনিবারের মধ্যে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালককে পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে। তা না হলে ২৯ এপ্রিল রোববার থেকে আবারো কঠোর কর্মসূচি শুরু হবে। তার আগে আগামী ২৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। এরপর ২৮ এপ্রিল শনিবার দেশব্যাপী সকল থানা সদরে হবে বিক্ষোভ মিছিল। সেদিন কেন্দ্র থেকে পরবর্তী কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘আমি এখনো আশা করি, সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আমরা সর্বস্তরের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সমর্থন চাই। আমরা সংবাদ মাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থাগুলোসহ বিশ্ববিবেকের অব্যাহত সমর্থনও কামনা করি।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর মধ্যে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে কোনো বিদেশি সংস্থার সাহায্য নেবেন কি না? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘ইতিমধেই ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশ আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা এ ব্যাপারে নানা রকম খোঁজ খবর নিচ্ছেন।’
ইলিয়াস আলী এখন কি অবস্থায় আছেন, তিনি কি জীবিত আছেন? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত না। সরকারই এটা ভালো জানে। তবে আমি আশাবাদী, ইলিয়াস আলী আমাদের মাঝে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসবেন।
আপনি কি নিশ্চিত এ ঘটনায় সরকার জড়িত? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই নিশ্চিত যে, এটা সরকারেরই কাজ। সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গেছে। দেশের জনগণের কাছেও এটা এখন পরিষ্কার। আমাদের মতো তারাও মনে করেন, এ কাজ সরকারই করেছে।’
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর, বড় ছেলে আবরার ইলিয়াস, ছোট ছেলে নাবিল আরবার, মেয়ে সাইয়ান নাওয়ার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব.) হান্নান শাহ, লে. জেনারেল(অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খালেদা জিয়ার প্রেস সেক্রেটারি মারুফ কামাল খান প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময় : ২১৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১২
সম্পাদনা : আবু হাসান শাহীন, নিউজরুম এডিটর, জাকারিয়া মন্ডল ও অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।
শনিবারের মধ্যে ইলিয়াসকে না পেলে রোববার থেকে কঠোর কর্মসূচি
মান্নান মারুফ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় থেকে: আগামী শনিবারের মধ্যে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালককে পরিবারের হাতে তুলে না দিলে রোববার থেকে কঠোর কর্মসূচি দেবে বিএনপি।
দেশব্যাপী হরতালের তৃতীয় দিন শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হওয়া সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ ঘোষণা দেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ইলিয়াস আলী জনপ্রিয় নেতা। তাই তাকে গুম করা হয়েছে। আমরা আশা করি তিনি ফিরে আসবেন।’
তার গুলশানের কার্যালয়ে শুরু হওয়া সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, `আমরা অনেক ধৈর্য ধরেছি, অনেক নেতা-কর্মী হারিয়েছি, অনেক জীবন অকালে ঝরে গেছে, আর নয়। আগামী ২৮ এপ্রিল শনিবারের মধ্যে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালককে পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে। তা না হলে ২৯ এপ্রিল রোববার থেকে আবারো কঠোর কর্মসূচি শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘তার আগে আগামী ২৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। এরপর ২৮ এপ্রিল শনিবার দেশব্যাপী সব থানা সদরে হবে বিক্ষোভ মিছিল। সেদিন কেন্দ্র থেকে পরবর্তী কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি এখনো আশা করি, সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে।’
‘সারা দেশে আতংকবিরাজ করছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘চরম অনিরাপত্তায় ভুগছে নাগরিক সমাজ। ৭ দিন হয়ে গেল ইলিয়াস আলী নিখোঁজ রয়েছেন। তার পরিবার, স্বজনেরা, আমরা, রাজনৈতিক সহকর্মীরা, এলাকাবাসী এবং দেশের মানুষ তার সন্ধান পাচ্ছে না। বাসায় ফেরার পথে গত ১৭ এপ্রিল দিবাগত রাতে তাকে এবং তার গাড়ি চালক আনসার আলীকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। বাসার কাছেই তার গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।’
বিএনপি প্রধান বলেন, ‘আমরা সবাই দাবি করেছি, ইলিয়াস আলীকে মুক্তি দেওয়া হোক। গাড়ি চালক আনসার আলীসহ তাকে সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থায় পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হোক। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে মামলা হতে পারে। আইন অনুযায়ী গ্রেফতারও করতে পারে সরকার। কিন্তু এভাবে গায়েব করে রাখা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং এই অধিকার কারো নেই।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা কোনো অযৌক্তিক কথা বলিনি। বিএনপি’র নেতারা আমাদের দাবি নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে কথা বলেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। আমরা আশা করেছিলাম, সরকার দ্রুত বিষয়টির আইনসম্মত ফয়সালা করবে। সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটবে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়- সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে পুরো বিষয়টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দিলেন। তিনি বললেন- আন্দোলনের ইস্যু তৈরির জন্য আমরাই নাকি ইলিয়াস আলীকে লুকিয়ে রেখেছি। একই সঙ্গে তিনি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাবের দিকে ইঙ্গিত করে আমাদের হুমকি দিলেন- আপনাদের তৈরি করা বাহিনীই আপনাদের খাবে।’
বিএনপি প্রধান বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের প্রধান নির্বাহীর এ ধরনের বক্তব্যের নিন্দা করার ভাষা আমার জানা নেই। এই দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্য ও হুমকির কারণেই প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর মনোভাব পুরোপুরি পাল্টে যায়। তারা ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালককে জনগণের সামনে হাজির করার বদলে নানান ধরনের নাটক সাজানো ও কাহিনী তৈরিতে উৎসাহী হয়ে ওঠে।’
তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তাই বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের ডাক দেয়। আমরা এই হরতালের পক্ষে দেশবাসী, নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সংগঠন ও সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থন চাই। তারা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু সরকার ও সরকারি দল আমাদের এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির বিরুদ্ধে রাস্তায় লোক নামায়। বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালায়। কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় শুরু করে। আমাদের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি অফিস পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসী দিয়ে অবরোধ করে রাখা হয়। আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঠেকাতে তারা সংঘর্ষ ও বল প্রয়োগের পথ বেছে নেয়। বিরোধী দলের কর্মসূচি দমনে পুলিশের পাশাপাশি তারা র্যাবকেও ব্যবহার করে।’
‘সরকারি দলের লোকজন পুলিশ ও র্যাবের পাহারায় বিভিন্ন জায়গায় মিছিল করেছে, বিরোধী দলের মিছিলে ও অফিসে হামলা করছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘অথচ আমাদের নেতা-কর্মীরা হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করতে গেলেই হামলা করা হয়েছে। এতো কিছু সত্ত্বেও পিকেটিং ছাড়াই সারা দেশে পরপর তিন দিন স্বতঃষ্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়েছে। জনগণ ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছেন। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘হরতালে মানুষের কষ্টের কথা আমরা জানি ও বুঝি। কিন্তু সরকার দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সকলের নিরাপত্তা কেড়ে নিয়েছে। প্রত্যেকটি নাগরিককে উদ্বিগ্ন করে ফেলেছে। এ থেকে মুক্তির জন্য আমাদের সকলকে কঠোর প্রতিবাদ ও ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে।’
তিনি বলেন, ‘জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনায় নিয়েই হরতাল কর্মসূচি যতদূর সম্ভব এড়িয়ে বিরোধী দল গণসংযোগ, রোডমার্চ, মহাসমাবেশসহ বিভিন্ন বিকল্প ও সৃজনশীল কর্মসূচি পালন করে আসছিল। এতে সর্বস্তরের জনগণও বিপুলভাবে সাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার আমাদের শান্তিপূর্ণ এসব কর্মসূচিতেও বাধা দিতে শুরু করেছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১২ মার্চ আমাদের ঢাকা মহাসমাবেশ ভণ্ডুল করতে সরকার কি ধরণের জঘণ্য পন্থা অবলম্বন করেছে তা আপনারা সবাই দেখেছেন। তারপরও আমরা দেশবাসীর ন্যায়সঙ্গত দাবি মানার ব্যাপারে সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এরপর যদি ইলিয়াস আলীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে এভাবে সন্ত্রাসী কায়দায় ধরে নিয়ে গিয়ে গায়েব করে রাখা হয়, তখন অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরেই কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া ছাড়া বিরোধী দলের আর কোনো উপায় থাকে না। অর্থাৎ সরকারই আমাদেরকে হরতাল ডাকতে বাধ্য করেছে। শুধু তাই নয়, আমাদের কর্মসূচি ছিল শান্তিপূর্ণ। সরকার ও সরকারি দলই উস্কানি সৃষ্টি ও হরতাল-বিরোধী কর্মসূচি দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘তাদের সৃষ্ট সহিংস পরিবেশের কারণেই হরতাল শুরুর প্রাক্কালে ও হরতাল চলাকালে দু’জন গাড়ি চালককে করুণ মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। প্রতিটি জীবনই খুব মূল্যবান। এই প্রাণহানির ঘটনায় আমি গভীরভাবে মর্মাহত। নিহত দুই গাড়ি চালকের স্বজনদের প্রতি আমি সমবেদনা জানাচ্ছি। তবে এর দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। কেননা সহিংস পরিবেশ তারাই ডেকে এনেছে। বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দমনে তারাই দলীয় সন্ত্রাসীদের মাঠে নামিয়েছে। সন্ত্রাসীদের খোলা ছাড়পত্র দিলে তারা যে-কোনো ধরনের নাশকতাই করে থাকতে পারে।’
বিএনপি প্রধান বলেন, ‘আমরা প্রথমে একদিনের হরতাল ডেকেছিলাম। পরে সরকারের আচরণেই তা বাড়াতে বাধ্য হই। আমরা বলেছিলাম, ইলিয়াস ও তার গাড়ি চালক আনসার আলীকে ছেড়ে দিলে আমরা হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করবো। সরকার আমাদের দাবি মানেনি। বরং সারা দেশে হরতাল বিরোধিতার নামে তারা পুলিশ, র্যাব ও দলীয় সন্ত্রাসী দিয়ে বিরোধী দলের ওপর হামলা করেছে। আমাদের দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমানসহ নারী নেত্রীদের, ঢাকা মহানগর নেতা আবুল বাশারসহ সিনিয়র নেতা ও কর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন চালিয়েছে। আমাদের অফিস অবরোধ করেছে। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি অফিস ভাঙচুর ও লুঠ করেছে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘পুলিশ শান্তিপূর্ণ অবস্থানে গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে, লাঠিচার্জ করেছে। রাস্তায় নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করেছে। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের পর্যন্ত গলাধাক্কা দিয়েছে পুলিশ। জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের গায়ে হাত তুলেছে, তাদের অসম্মান করেছে। গভীর রাতে আমাদের দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহর বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালাতে গেছে। পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত করে সকলকে উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখেছে। খুলনায় ছাত্রদল নেতা মাহমুদুল হক টিটো ও মুন্নাকে মিছিল করার দায়ে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে পৈশাচিক কায়দায় বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ইলিয়াস আলীর নিজের এলাকা সিলেটের বিশ্বনাথে প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশ ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা যৌথ হামলা চালিয়েছে। তারা গুলি করে দু’জনকে হত্যা করেছে। এখনও সেখানে সরকারি বাহিনী সীমাহীন অত্যাচার চালাচ্ছে। ঘরে ঘরে তল্লাশী চলছে। প্রায় একশ’ লোককে তারা ধরে নিয়ে গেছে। ভয়ে গ্রামগুলো পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। এই বিভৎস তাণ্ডব অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, জুলুম-নির্যাতন করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। হরতালকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের প্রায় দেড় হাজার নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার নেতা-কর্মী। তাদেরকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। না হলে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আরো দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলব। সেই আন্দোলনের মাত্রা ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতরো হবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের কারণেই আমাদের হরতাল কর্মসূচিকে তিন দিন পর্যন্ত বাড়াতে হয়েছে। আজও ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালককে জনসমক্ষে আনা হয়নি। কাজেই আমাদের আন্দোলন থামানোরও কোনো সুযোগ নেই।’
বিএনপি প্রধান বলেন, ‘সরকারের সমর্থক কিছু ব্যবসায়ী নেতা ও ব্যক্তি হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। আমি তাদের বলবো- সরকারের সঙ্গে তো আপনাদের নিয়মিত দেন-দরবার হয়। আপনারা তাদেরকে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালককে ছেড়ে দিতে বলুন। সন্ত্রাস, হত্যা, গুম, অপহরণ বন্ধ করতে বলুন। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলুন। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট নিরসন করতে বলুন। শেয়ার বাজার লুটের টাকা ফেরত দিতে বলুন। দুর্নীতি বন্ধ করতে বলুন। ব্যাংকগুলো দেওলিয়া করে ঋণ নিয়ে সরকার চালাতে নিষেধ করুন। নির্যাতন বন্ধ করে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বলুন। সংসদকে কার্যকর করতে বলুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করতে বলুন। সীমান্তে হত্যা বন্ধ করতে বলুন। জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে বলুন। আমরা হরতাল ডাকবো না। আন্দোলনও আমরা করবো না। সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণই রায় দেবে দেশ পরিচালনার ভার কাদের হাতে থাকবে।
‘পুরো দেশটাকে আজ মগের মুল্লুকে পরিণত করা হয়েছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কোথাও কোনো আইনের শাসন নেই। বিচার বিভাগ এখন প্রায় ন্যায়বিচার শূন্য। দলবাজ কিছু লোকের চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্যে রাজনৈতিক মতলব হাসিলের ক্রীড়নকে পরিণত করা হচ্ছে বিচার ব্যবস্থাকে। প্রশাসন স্থবির। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আইনসম্মত পন্থায় চলতে দেয়া হচ্ছে না। দুর্নীতি, অনিয়ম, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘রেলওয়ের দুর্নীতি ও ঘুষের টাকা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পৌঁছে দিতে যাবার পথে হাতে-নাতে ধরা পড়ার ন্যক্কারজনক ঘটনায় সারা দেশে ধিক্কার ওঠার পর তিনি পদত্যাগ করলেন। প্রধানমন্ত্রী সংবিধান লংঘন করে শপথ ছাড়াই তাকে মন্ত্রী পদে বহাল রেখে দুর্নীতিকে পুরস্কৃত করেছেন। প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে সোহেল তাজ পদত্যাগ করার পরও একইভাবে সংবিধান লংঘন করে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাকে বেতন-ভাতা দিয়ে গেছেন। অবশেষে তিনি বিবেকের তাড়নায় নিজের সম্মান রক্ষার্থে সংসদ সদস্য পদেও ইস্তফা দিয়েছেন। এর জন্য সোহেল তাজকে ধন্যবাদ জানাই।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এবং এই সরকারের সঙ্গে এখনো যারা আছেন, তাদের মধ্যে সামান্য আত্মমর্যাদা বোধ ও দেশপ্রেম যাদের আছে, আমি তাদেরকেও একই পথ অনুসরণের আহ্বান জানাই। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর একদলীয় শাসন জারী করেছিল। এবার দেশে কায়েম হয়েছে এক ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারী শাসন। সামান্যতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, পরমতের প্রতি একটু শ্রদ্ধাবোধও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেই। কারো কথায় তিনি কর্ণপাত করেন না। নিজের খামখেয়ালীপনা ও স্বেচ্ছাচারিতায় যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তিনি ডেকে এনেছেন এর পুরো দায়-দায়িত্ব তার একার।’
তিনি বলেন, ‘যারা এসবের দায়-দায়িত্ব বহন করতে চান না, আমি সময় থাকতে তাদের জনগণের কাতারে শামিল হবার আহ্বান জানাচ্ছি। দেশ, জাতি, রাষ্ট্র ও জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পরিণাম কখনো শুভ হতে পারে না।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ দিশেহারা। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংবিধানিক, প্রশাসনিক, বিচারিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক নানান সমস্যার আবর্তে দেশ আজ তলিয়ে যেতে বসেছে সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতায়। এরা এতো লজ্জাহীন ও প্রবঞ্চক যে বিভিন্ন ব্যর্থতাকেও সাফল্য হিসেবে জাহির করতে তাদের বিবেকে বাধে না। এদের ভাষা অশ্লীল, আচরণ উদ্ধত, ভঙ্গি অসংযত, মন সংকীর্ণ, যোগ্যতা ও দক্ষতা সামান্য, প্রচারণায় উচ্চকণ্ঠ। গণতন্ত্র ও সুশাসনের সঙ্গে এরা অপরিচিত। দেশ পরিচালনার বিরাট দায়িত্ব পালনের কোনো যোগ্যতা এদের নেই।’
তিনি বলেন, ‘তিন বছরের কুশাসন-দুঃশাসনে দেশটাকে এরা আবার মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে। সারা দেশে আজ বিভীষিকার রাজত্ব। মানুষের নিরাপত্তার জন্য যে রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনই আজ আতঙ্কের উৎসে পরিণত হয়েছে। হত্যা, অপহরণ, গুম, তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে আইন-শৃংখলা রক্ষা বাহিনী। আমাদের দলের ঢাকা মহানগরীর প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী আলমকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করে ফেলা হয়েছে। যশোরের নেতা নাজমুলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার লাশ পাওয়া গেছে। সিলেটের ছাত্রদল নেতা দিনার ও জুনেদকে ঢাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তুলে নেয়ার পর আজও তাদের খোঁজ মেলেনি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন মেধাবী ছাত্রকে একইভাবে তুলে নেয়ার পর হাইকোর্টের আদেশ সত্বেও তাদেরকে আদালতে হাজির করা হয়নি। এভাবে বর্তমান সরকারের আমলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসেবেই প্রায় সোয়াশ’ লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয়েছে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘এখন সারা দেশে বিরাজ করছে গুমের আতঙ্ক। সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি নৃশংসভাবে খুন হবার পর প্রধানমন্ত্রী বললেন- তিনি বেডরুমে কাউকে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। এরপর সউদি কূটনীতিক খালাফ আলী খুন হলেন রাস্তায়। এখন পথে ঘাটে, বাসায়-অফিসে নানান জায়গায় প্রতিনিয়ত মানুষ খুন হচ্ছে, অপহরণ হচ্ছে। এমপি হোস্টেলের মতো সুরক্ষিত জায়গায় আজ তরুণীর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীর কাছে আশুলিয়া বেড়ি বাঁধের পাশে অনেক মানুষকে খুন করে লাশ ফেলার প্রতিবেদন সংবাদ মাধ্যমে দেখে মানবতা শিউরে উঠেছে। কিন্তু সরকার নির্বিকার। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়ি চালক আলী আজম ঘুষের টাকা ধরিয়ে দেয়ার পর থেকে নিখোঁজ। সাংবাদিকরাও সত্য প্রকাশ করলে গুম কিংবা খুন হয়ে যায়। এই অবস্থার অবসান হতেই হবে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘দৈনিক সমকাল পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক দু’জনই সরকার-সমর্থক বলে পরিচিত। সেই পত্রিকায় ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশের জন্য সম্পাদক গোলাম সারওয়ারকে হত্যা কিংবা গুম করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করতে বাধ্য হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, বেছে বেছে বিএনপি’র একশ’ নেতার তালিকা করা হয়েছে। তাদেরকে একে একে গুম কিংবা খুন করা হবে। সংবাদে বলা হচ্ছে, বিশেষ গুপ্তঘাতক বাহিনী গঠন করা হয়েছে। আমরা আতঙ্কিত। স্বাধীনতার পর এভাবেই রাষ্ট্র পরিচালিত গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী। আজকের শাসকেরাও সেই একই পথ বেছে নিয়েছে। তাই এই রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট গুম-খুন-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমি দেশবাসীর প্রতি সেই আহ্বান জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘ইলিয়াস আলীকে গায়েব করে রাখার ঘটনায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক বিশ্বে ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যে বিবেকের সাড়া দেখতে পাচ্ছি তাতে আমরা সাহস পাই। আমরা আমাদের সংগ্রামে তাদের অব্যাহত সমর্থন কামনা করি। আমি সরকারকে বলবো- অবিলম্বে সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা ও গুম করার ঘৃণ্যপথ পরিহার করে শান্তি ও গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসুন। ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালকসহ যাদের গায়েব করে রাখা হয়েছে, তাদের ফিরিয়ে দিন। আমরা কোনো কঠোর কর্মসূচি দেব না। আমরা অনেক ধৈর্য ধরেছি, অনেক নেতা-কর্মী হারিয়েছি, অনেক জীবন অকালে ঝরে গেছে, আর নয়।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আগামী ২৮ এপ্রিল শনিবারের মধ্যে ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালককে পরিবারের হাতে তুলে দিতে হবে। তা না হলে ২৯ এপ্রিল রোববার থেকে আবারো কঠোর কর্মসূচি শুরু হবে। তার আগে আগামী ২৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। এরপর ২৮ এপ্রিল শনিবার দেশব্যাপী সকল থানা সদরে হবে বিক্ষোভ মিছিল। সেদিন কেন্দ্র থেকে পরবর্তী কর্মসূচি দেয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘আমি এখনো আশা করি, সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আমরা সর্বস্তরের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সমর্থন চাই। আমরা সংবাদ মাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থাগুলোসহ বিশ্ববিবেকের অব্যাহত সমর্থনও কামনা করি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১২
সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর