
ঢাকা: মিসরে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে হোসনি মোবারকের দীর্ঘ তিন দশকের স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। এরপর সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথম গণতান্ত্রিক পার্লামেন্ট গঠিত হলেও সুপ্রিমকোর্টের আদেশে পরে তা ভেঙে দেয় সামরিক বাহিনী। তারপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়েও ভোট জালিয়াতির অজুহাতে টালবাহানা করে তারা। তবে নির্ধারিত সময়ের দু’দিন পর হলেও গত ২৪ জুন রোববার মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী ড. মোহাম্মদ মুরসিকে বিজয়ী ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
মিসরের পার্লামেন্ট নির্বাচনেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল ব্রাদারহুড। অর্থাৎ মোবারক পরবর্তী মিসরে ইসলামপন্থি ব্রাদারহুডের অবস্থান কতটা শক্ত তা সবার কাছে স্পষ্ট। আর সে কারণেই আরব বিশ্বের ভবিষ্যৎ সংশ্লিষ্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রসঙ্গ সামনে চলে এসেছে। এর মধ্যে আছে আগামী দিনগুলিতে মিসরের আঞ্চলিক ও বৈদেশিক নীতি কেমন হবে আর আরব বিশ্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ব্যাপারে মুরসি কী ভাবছেন?
এসব বিষয়কে আলোচ্য সূচিতে রেখে ইরানের ফার্স বার্তাসংখ্যা মুরসির একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছে। গত ২৪ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি এ সাক্ষাৎকারটি দেন। বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির সংক্ষিপ্তরূপ এখানে উপস্থাপন করা হল-
আলাপচারিতায় মুরসি ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের চুক্তির বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন আছে বলে মত দিয়েছেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের বিষয়গুলো আরো বাস্তবসম্মত করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বিশেষ করে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিটি পুনর্বিবেচনা বা পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন।
এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মুরসি বলেন, “ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের কৌশল হলো সমতাভিত্তিক কারণ আমরা কোনো ক্ষেত্রেই তাদের চেয়ে দুর্বল নই। আর আমরা ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবো-- কারণ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
সাক্ষাৎকারে মুরসি বলেন, “আমরা ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিটি পুনর্বিবেচনা করব।” তবে এসব বিষয় গভর্নমেন্ট বডি এবং মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারেই বাস্তবায়িত হওয়া উচিৎ। কারণ আমি নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেব না।”
মিসরের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের আক্রমণের ব্যাপারে সেনা বাহিনী কীভাবে সাড়া দেবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা শুধু মিলিটারি কাউন্সিলের থাকবে এমন বিধান রেখে সংবিধান সংশোধন করা এবং সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, এ ইস্যুতে সুপ্রিম কাউন্সিল অব দ্য আর্মড ফোর্সেস (এসসিএএফ) ইসরায়েলকে যথাযথ নিশ্চয়তা দিয়েছে- এ প্রশ্নে মুরসি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো হামলার কথা যদি আপনি বলেন তাহলে আমার বিশ্বাস কোনোভাবেই এটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”
তিনি বলেন, “বিভিন্ন ইস্যুকে সংবাদ মাধ্যমগুলো একটু অতিরঞ্জিত করার চেষ্টা করছে যা জনগণকে আমার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ব্যাপারে সন্ত্রস্ত্র করে তোলার একটা চেষ্টা মাত্র। কিন্তু মাত্র একজনের পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই আসে না এবং মজলিস আল শা’বকে (সংসদ) এ ব্যাপারে একমত হতে হয়; বর্তমানে যুদ্ধের ব্যাপারে মিলিটারি কাউন্সিলের সম্মতি প্রয়োজন আর এতে কোনো সমস্যা নেই কারণ তারা সামরিক বাহিনীর ভাল-মন্দের ব্যাপারে অনেক সচেতন।”
“তবে অবশ্যই এর মানে এ নয় যে, আমি সংবিধানের ওই সংশোধনীর ব্যাপারে একমত পোষণ করি। কিন্তু আমি তো কোনোভাবেই একা সিদ্ধান্ত নেব না। আর আমি বহুবার এ বিষয়টি জোর দিয়ে বলেছি যে, মিসরীয় সেনা বাহিনীর সঙ্গে আমার বিরোধ নেই। কারণ সেনাবাহিনী জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এবং আমি ওই নিশ্চয়তার (ইসরায়েলকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা) ব্যাপারে এভাবে বলতে চাই না যে, এসসিএএফ ইসরায়েলকে এমন নিশ্চয়তা দিয়েছে। কারণ আমরা কারো দেশপ্রেমের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করি না।
এবং আমি বিশ্বাস করি কিছুটা ভুল-ভ্রান্তি থাকলেও এসসিএএফ আমাদের মাতৃভূমিকে নিলামে তুলবে না।”- বক্তব্যের সঙ্গে যোগ করেন ড. মুরসি।
প্রসঙ্গত, মিসরের অনেক রাজনৈতিক নেতা মনে করেন, ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি মিসরের সম্মান এবং মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। তারা দীর্ঘদিন যাবত এ চুক্তির ব্যাপারে নতুন করে ভাবার জন্য সাবেক মোবারক সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে এসেছেন।
প্রসঙ্গত এর আগে ফিলিস্তিনে মিসরের সাবেক রাষ্ট্রদূত গামাল মাজলুম ইরানি সংবাদ সংস্থা ফার্সকে বলেছিলেন, সিনাই মরুভূমিতে আরো বেশি সেনা মোতায়েনের জন্য মিসরের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। একই সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিটি সংশোধন এবং পরিবর্তনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানানো উচিৎ।
গত অক্টোবরে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত বলেন, “যেহেতু জায়নবাদীরা (ইহুদি জাতীয়তাবাদী) ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি কয়েকবার ভঙ্গ করেছে সেহেতু মিসরের উচিৎ ক্ষমতা প্রয়োগ করা এবং ইসরায়েল এ চুক্তি পরিবর্তন করতে অস্বীকৃতি জানালে সিনাই মরুভূমিতে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো।”
এদিকে, মিসরের মিলিটারি সুপ্রিম কাউন্সিল প্রেসিডেন্টের পদের মেয়াদ কমিয়ে এক বছর করার চিন্তা-ভাবনা করছে এমন খবর উড়িয়ে দিয়েছেন মুরসি।
এ প্রসঙ্গে মুরসি বলেন, “এরকম ধারণা সঠিক নয়, কারণ নতুন সংবিধানের সংকলন করবে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি যা সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে সংসদ ভেঙে দেওয়ার একদিন আগে গঠিত হয়েছে। এবং কেউই কখনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাতিল করতে পারবে না।”
তবে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ায় সুপ্রিম কাউন্সিলের তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি।
জোরপূর্বক পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন ইসলামপন্থি প্রার্থীকে ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই এমনটি করা হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “মজলিস-ই-শা’ব (সংসদ) ভেঙে দেওয়া হয়েছে আমাকে লক্ষ্য করেই। জেনারেলরা যখন বুঝতে পারলেন আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি তখন তারা নিজেদের স্বার্থে নির্দিষ্ট কিছু কর্তৃপক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।”
একই সঙ্গে সংবিধানে একটি সম্পূরক সংযোজন করার ব্যাপারে এসসিএএফ’র সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেছেন মুরসি। তিনি বলেছেন, “মিলিটারি কাউন্সিল সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত নয়। আর আমরা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা খর্ব করে দেওয়া সাংবিধানিক ঘোষণাকেও প্রত্যাখ্যান করছি।”
অপরদিকে, ইরানের সঙ্গে মিসরের সম্পর্ক আরো মজবুত করার প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি। তিনি বলেন, “কায়রো এবং তেহরানের মধ্যকার সম্পর্ক এ অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করবে।”
প্রসঙ্গত, দীর্ঘ ৩০ বছরের সংঘাত শেষে ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় মিসর ও ইসায়েলের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে প্রেসিডেন্টের অবকাশ যাপন কেন্দ্র ক্যাম্প ডেভিডে টানা ৩০ দিনের গোপন বৈঠক শেষে ১৯৭৮ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর আরব-ইসরায়েল শান্তির ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তি হয় যার ফলশ্রুতিতে পরের বছর ইসরায়েল-মিসর শান্তিচুক্তি হয়। এটি ‘ক্যাম্প ডেভিড’ চুক্তি হিসেবে পরিচিত।
ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন।
এ চুক্তির দু’টি পরিকাঠামো (ফ্রেমওয়ার্ক) হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়। পরিকাঠামোর দ্বিতীয় অংশটি ১৯৭৯ সালের মার্চে মিসর-ইসরায়েল শান্তি চুক্তি হিসেবে কার্যকর হয়। এর ফলে দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসান ঘটে। এই ঐতিহাসিক চুক্তির সূত্রে ১৯৭৮ সালে সাদাত ও বেগিনকে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড সমঝোতার দু’টি অংশ রয়েছে। একটি হলো ‘মধ্যপ্রচ্যে শান্তির জন্য পরিকাঠামো’ আর অপরটি ‘মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তি’। দ্বিতীয় অংশটি ১৯৭৯ সালে চূড়ান্ত হয়।
প্রথম সমঝোতার তিনটি অংশের মধ্যে প্রথমটিতে আছে, ইসরায়েল, মিসর, জর্ডান এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলোচনা করে পশ্চিত তীর এবং গাজা উপত্যকা নিয়ে একটি স্বশাসিত প্রশাসন গঠিত হবে। চুক্তি অনুযায়ী এ দুই এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে সমঝোতা হয়। তবে এতে গোলান মালভূমি, সিরিয়া বা লেবাননের ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি যা আগের মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে আরব-ইসরায়েল নেতাদের শান্তি আলোচনার মূল সুরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এছাড়া সিনাই উপদ্বীপের ব্যাপারে এখানে উল্লেখিত বিষয়গুলোও পরিষ্কার নয়। আর এ কারণেই পরবর্তীতে মিসর, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তির ব্যাখ্যা যে যার মত দিয়েছে। সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো- ওই চুক্তিতে আদপে জেরুজালেমের ভাগ্য উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
দ্বিতীয় অংশে মিসর-ইসরায়েল সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আর তৃতীয় অংশে নির্ধারণ করা হয়েছে আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক।
দ্বিতীয় পরিকাঠামোটি চুক্তির ছয় মাস পর কার্যকর করার কথা বলা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, সিনাই উপদ্বীপ থেকে ইসরায়েল সেনা এবং বসতি স্থাপন করা সাড়ে চার হাজার বেসামরিক ইসরায়েলিকে সরিয়ে নিয়ে ওই ভূমি মিসরকে হস্তান্তরে সম্মত হয়। বিনিময়ে মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল রাখবে এবং সুয়েজ খালসহ পার্শ্ববর্তী অন্যান্য সমুদ্রপথে স্বাধীনভাবে চলাচলের অনুমতি দেবে। চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল পশ্চিম সিনাইয়ের দখলীকৃত আবু রুদেইস তেলক্ষেত্র মিসরকে ছেড়ে দেয়।
এ চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র উভয় রাষ্ট্রকে বাৎসরিক কয়েক বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিতে রাজি হয়। মার্কিন পণ্য কেনার বাধ্যবাধকতার ভিত্তিতে দুই দেশ এসব অর্থ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তার নামে অনুদান হিসেবে এখনো পেয়ে যাচ্ছে।
তবে চুক্তিটি মিসরকে লাভবান করলেও আরব বিশ্বের জন্য কিছুই দিতে পারেনি বলে অনেক আরব নেতা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। চুক্তির পর ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আরব লিগে মিসরের সদস্যপদ স্থগিত রাখা হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর জর্ডানের বাদশাহ হোসেইন একে আরবদের গালে চপেটাঘাত বলে অভিহিত করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২১ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১২
সম্পাদনা: জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর; আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর