
ঢাকা: রাজধানীর বনানীর সিলেট হাউসের বাসা থেকে ১৭ এপ্রিল রাতে বের হয়েছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী। সঙ্গে ছিলেন তার গাড়িচালক আনসার আলী।
ওই রাতেই নিখোঁজ হয়ে যান তারা। আজও সন্ধান মেলেনি তাদের।
তবে ইলিয়াসের সন্ধান না মিললেও সেদিন গভীর রাতে বনানীর ২ নম্বর রোডের সাউথ পয়েন্ট স্কুলের সামনে থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ইলিয়াসের গাড়িটি উদ্ধার করেছিল বনানী থানা পুলিশ।
মঙ্গলবার ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ৩ মাস পূর্তি হলো। কিন্তু আজও মেলেনি তার সন্ধান। ইলিয়াসের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন তার বৃদ্ধা মা সূর্যবান বিবি, স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা এবং তার সন্তানরা।
এমনকি সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইলিয়াস নিখোঁজের রহস্যও উদঘাটন করতে পারেনি। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোও প্রথম কয়েকদিন এ নিয়ে মাঠ গরম করলেও এখন কেমন যেন চুপ মেরে গেছে। ফলে উদ্বেগ, আতঙ্ক, হতাশা ও আশঙ্কা বাড়ছে নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর পরিবারের সদস্যদের মাঝে।
কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে সংশয় তার বেঁচে থাকা নিয়েই। অনেকের মনেই প্রশ্ন- সত্যি কি বেঁচে আছেন ইলিয়াস আলী? বেঁচে থাকলে কেন মিলছে না তার সন্ধান?
ইলিয়াসকে ফিরে পেতে আদালতে একটি রিট করা হয়। কিন্তু আদালতের নির্দেশের পরও ইলিয়াস আলীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ইলিয়াসের সন্ধানে র্যাব তার স্ত্রীকে নিয়ে গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে ও নানাভাবে অনুসন্ধান করেও ব্যর্থ হয়েছে।
ইলিয়াস আলীর সন্ধানে ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে বাসার সামনে বসানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। জাতিসংঘও বিষয়টি তদন্তে একটি টিম পাঠাচ্ছে বাংলাদেশে।
কিন্তু এতো কিছুতেও মিলছে না ইলিয়াস আলীর সন্ধান!
ইলিয়াসের নিখোঁজের খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর তার নিজ জেলা সিলেটসহ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সারা দেশ। সারা দেশে ৫ দিন এবং সিলেটে আরো ১ দিন হরতাল পালিত হয়। সিলেটে গঠন করা হয়েছে ‘ইলিয়াস মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’। বিশ্বনাথ উপজেলায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষে প্রাণ হারান ৩ জন।
ইলিয়াস ইস্যুতে গরম হয়ে ওঠে রাজনীতির মাঠ। সরকার এবং বিরোধী দল দোষারোপ করতে থাকে একে অপরকে। সরব হয়ে ওঠে দেশের সব সংবাদ মাধ্যমগুলো। প্রতিদিনই মানুষ চোখ রাখেন বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া, চ্যানেলের সংবাদ এবং পত্র-পত্রিকাগুলোতে। সংবাদ মাধ্যমগুলোকে সাক্ষাৎকার দিতে দিতে এক রকম ক্লান্ত হয়ে পড়েন ইলিয়াসের পরিবারের সদস্যরা।
বিএনপির জন্যও মুল ইস্যু হয়ে ওঠে ইলিয়াস নিখোঁজের ঘটনাটি। সেমিনার, গোলটেবিল, পোস্টারিংসহ দলটির যে কোনো সভা-সমাবেশে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠেন ইলিয়াস। যে কোনো মূল্যেই তারা ফিরে পেতে চান তাদের দলের এ নেতাকে।
ইলিয়াসের সন্ধান চেয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে বিশ্বনাথে বিএনপি-জামায়াত দলের সাত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ কয়েক হাজার নেতাকর্মী মামলার আসামি হন। মামলা মাথায় নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানরা ফেরার হওয়ায় সরকার তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে। যদিও আদালতের নির্দেশে চেয়ারম্যানরা আবারও দায়িত্ব ফিরে পান।
বিশ্বনাথের পাশাপাশি সিলেট নগরীতেও সন্ধান আন্দোলনকালে বিএনপির আরও কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। মামলার কারণে বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মী ফেরারি হলে একপর্যায়ে আন্দোলনে ভাটা পড়ে।
স্বামীকে ফিরে পেতে ইলিয়াসের স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর আবেদন জানিয়ে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া নিজে বাসায় গিয়ে সান্ত্বনা ও আশার বাণী দিয়ে আসেন তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতাশ হন তাহসিনা রুশদীর।
বর্তমানে দ্বিতীয়বারের মতো তিনি চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার। যদিও দেখা পাওয়ার ব্যাপারে প্রশাসন থেকে এখনও কিছু জানানো হয়নি।
সরকার ইলিয়াস আলীর সন্ধানে গঠন করেছে তদন্ত কমিটি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ দায়িত্ব। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিথিল হয়ে যাচ্ছে সব কার্যক্রম। দিন যতোই গড়াচ্ছে, ততোই হারিয়ে যাচ্ছে দু’দলের আগ্রাসী পদক্ষেপও। উৎসাহে ঘাটতি পড়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের। চায়ের আড্ডায় হারিয়ে যেতে বসেছে ইলিয়াস প্রসঙ্গ। আর সাধারণ মানুষতো এক রকম ধরেই নিয়েছেন, আর ফিরবেন না ইলিয়াস।
এ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর তাকে উদ্ধারের ব্যাপারে আদালতের নির্দেশে প্রতি ৪৮ ঘণ্টা পর পর অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিচ্ছেন। তবে প্রতিবেদনে কি অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন এ কর্মকর্তা। আর আদালতের নির্দেশনা থাকায় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করছে না ৠাবও।
তাহলে কি মাত্র তিন মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে আসছে ইলিয়াস কাহিনী?
এতো দিনেও ইলিয়াস আলীর সন্ধান না পাওয়ায় দেশের সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন প্রশ্নবিদ্ধ তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ দেশের প্রধান বিরোধী দলও। কারণ, নিজ স্বার্থ রক্ষায় প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে তাদের আন্দোলন ও প্রতিবাদের ইস্যু। আর নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষায় দেখা যাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন কোনো ভূমিকা।
শুধু ইলিয়াস আলীই নন, আজও সন্ধান মেলেনি বিএনপি নেতা ও ডিসিসির ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলার চৌধুরী আলমেরও। ২০১০ সালের ২৫ জুন রাতে রাজধানীর ইন্দিরা রোড থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী কয়েকজন লোক। পরদিন সকালে কারওয়ানবাজার ওয়াসা ভবনের সামনে গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
নিখোঁজ হওয়ার পর চৌধুরী আলমের ছেলে আবু সাইদ শেরেবাংলা নগর থানায় একটি জিডি ও পরে একটি মামলা করেন। পরে তিনি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দায়ের করেন। ওই আবেদনের শুনানি শেষে চৌধুরী আলমকে খুঁজে বের করতে নির্দেশ দেন আদালত। চৌধুরী আলমকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আটক করার পর আদালতে রিট করায় তাকে খুঁজে বের করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব, পুলিশের আইজি ও র্যাবের ডিজিকে নির্দেশ দিলে প্রথমদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুটা তত্পর হয়। কিন্তু কিছুদিন পরই পুলিশের তত্পরতা রহস্যজনকভাবে থেমে যায়। পরে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর হলেও তদন্তে অগ্রগতি নেই।
স্বাধীন দেশে বাস করেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দেশের মানুষ। নিখোঁজ হচ্ছেন ইলিয়াস আলী এবং চৌধুরী আলমের মতো অনেকেই। আর তাদের সন্ধান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। একপর্যায়ে দলও ভুলে যাচ্ছে তাদের হারিয়ে যাওয়া নেতাকর্মীদের কথা। যেখানে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির সন্ধান মেলে না ৯০ দিন বা দুই বছরেও, সেখানে সাধারণ মানুষের অবস্থান কোথায়- এ প্রশ্ন দেশের সাধারণ মানুষের।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১২
সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর