
আজান গাজি বড়ো অস্থির। মসজিদ থেকে এসেই কেমন জানি করছে। মনে হচ্ছে ছইট উঠছে। বুকের ভিতর টিকটিক করা জিনিসটা একবার কমে একবার বাড়ে। ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে। গতরের পাঞ্জাবিটা খুলবে সে শক্তিও নেই।
-‘কি হইলো আপনের?’
আজান গাজির বউ সুফিয়া ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে স্বামীরে জিগায়। বউয়ের কণ্ঠ শুনে আজান গাজির শরীরে শক্তি আসে। এক ধমক দিয়া শোয়া থেকে খাড়াইয়া ওঠে।
-‘মাগি চুপ থাক!’
-‘কথায় কথায় বকেন ক্যান?’
-‘বকুম না তোরে চুমা দিমু?’
-‘ছি ছি আপনে কি পাগল হইয়া গেছেন। মুখের কোন ট্যাকশো নাই। দিন দিন পোলাপাইন হইতাছেন। যা মুখদা আইয়ে তাই কইয়া ফেলান। শরমের মাথা খাইছেন নাকি?’
-‘মাগি চুপ থাক। আমার ভালো লাগতাছে না। মেজাজ খারাপ করিস না। আমি মরলে তোরে কেউ আট আনা দিয়াও জিগাইবো না।’
-‘আপনে মরবেন কেন? আপনের শরীরটা খারাপ এইটাইতো জিগাইছি। আমারে আপনি শত্রু মনে করেন ক্যান। আমি না আপনের বউ। সোয়ামীর সুখ দুঃখ তো বউয়ের কাছেই কয় নাকি?’
আজান গাজি বিরবিরাই কি জানি কইতে থাকে। সুফিয়া স্পষ্টত কিছুই বুঝতাছে না। তবে স্বামীর জন্য দরদের কোন কমতি নাই। এর মধ্যেই শাহসাবের মাজারে মানোতও করে ফেলেছে। যদি মাবুদে তার স্বামীরে হায়াত দেয় তাহলে সুফিয়া শাহসাবের মাজারে পাঁচ সের চালের খিচুড়ি রান্না করে দিবে। তবে এ মানত সুফিয়ার মনে মনেই করে রাখছে। কারণ সুফিয়ার স্বামী আজান গাজি যদি মাজারে পাঁচ সের চালের খিচুড়ির কথা জানতে পারে তাহলে সুফিয়ার তক্তা ছুটাইয়া ফেলাইবে। আজান গাজি সুফিয়ার দিকে তাকাইয়া বালিশ থেকে মাথাটা একটু উঠানোর চেষ্টা করে। সুফিয়া এগিয়ে গিয়ে তার স্বামীর বালিশ ধরে মাথা উপরে ওঠাতে চায়। আজান গাজি ইশারা দিয়ে লাগবে না জানায় দেয়। বউয়েরে কাছে ডাকে। সুফিয়া ভয় পায়। আজানগাজি বউয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে আর বলে-
‘তোর বাপতো মইরা ভূত হইয়া গেছে। তোর বাপ আমার পিছু লাগছে ক্যান। তোর কি খাওন পিনদোনের কোন অভাব আছে?’
-‘কি কওন এইসব?’
-‘হু, এশারের নামায পইড়া আইবার সময় তোর বাপ আমার সামনে খাড়া। কইতাছে মাইয়াডারে জীবনভর অশান্তিতে রাখছিস। হাতের লাঠিটা উচাইয়া বলে আর যদি তোর গায়ে হাত দেই। তবে ঐ লাঠি দিয়া আমার মাথার খুলি ফাটাইয়া দিবে।’
-‘ও মা এইডা আবার কি কন? আমার বাপ মরছে হেই কবে। একবার যখন বড়ো বইন্যা হইলো। তখন বাজান মরছে।’
সুফিয়ার মনটা খারাপ হইয়া গেল। মরা বাপের কথা কওয়াতে সুফিয়ার দুইচোখ দিয়া কান্দন আইতাছে। আহারে বাজান, শনিবার, মঙ্গলবার আইলেই বাজান দুইজোড়া ইলিশ মাছ লইয়া সুফিয়ারে দেখতে আইতো। সুফিয়া এখন অন্য জগতের বাসিন্দা। বাপের স্মৃতি আওড়াতে গিয়া স্বামীর বেরামের কথা ভুলতে বসেছে।
এর মধ্যেই গ্রামে জানাজানি হইয়া গেছে।
-‘আজান গাজিরে ভূতে ধরছে। এইটাও কি বিশ্বাসের কথা!’
-‘এ গ্রামে ভূত আছে। এইডাতো মিছা না। এর আগেও তো ইরি ক্ষেতের স্কিমের ঢেরায় নুরু তালুকদাররে আলতায় ডাক পারছে।’
-‘কি কও মিয়া! ঐ তালুকদার এইটাও কি হাছা কথা?’
আজান গাজির উঠানে এখন ভূতের প্যাচাল চলছে। কার জীবনে কয়টা ভূত দেখছে হাছা মিছায় মিলাইয়া যে যার মতো বলছে। কিন্তু নুরু তালুকদারের ভুতের ব্যাপারটাতো আর এমনে এমনে ফ্যালাইনদেয়া যায়না। তালুকদারতো এহানে আছে। উনার মুখেই শুনি না। উনি আসলে কি দেখছে। এবার তালুকদার পাইছে…
-‘ঐ মিয়ারা শোন; আমগো পাড়ায় আলতায় মরছে কয় বছর হইবো? এই বছর দুয়েক বা তিন বছর। তো আলতায় মরছে কেমনে? বিষ খাইয়া তাই না? হ। শোন যারা আল্লার দেয়া জান হত্যা করে। তাগো রুহুগুলান আল্লায় আর ফেরত নেয় না। এই রুহুগুলাই নানান জায়গায় ঘুইরা বেড়ায়। বিশেষ করে আমাবইশ্যা রাতে এরা কাউরে একলা পাইলে তার রক্ষা নাই।’
-‘তালুকদার সাব আপনের কাহিনাটা কন।’
-‘মিয়ারা চুপ থাক কইতাছি। আর কাহিনী কি? এটাতো হাছা কথা। আমি এর ভুক্তভোগী। হেইবার যে কি ডরতাইনা পাইছিলাম আহা। তালুকদার মুখের থুথু বুকে মারে। এখনো মনে হইলে গা ঠাণ্ডা হইয়া যায়। আমি স্কিমের ঢেরাত ঘুমাইতেছিলাম। হেইদিন পোলারা কেউ যায় নাই। বড় পোলায় গেল বউ লইয়া হহুর বাইত বেড়াইতে। বাকি দুইটাতো ছোট ছোট। তোমার চাচি কয় ঢেরাত যাইয়া ঘুমাইতে। তোমার চাচির কথা মতো ঢেরাত গেলাম। মেশিন টা ছাইড়া, ড্রেনড্রোনগুলা ঠিকঠাক মতো ক্লিয়ার কইরা শুইছি। চোখটা লাইগা আইছে। এমন সময় কারেন্ট গেছেগা। উইঠা মেশিন বন্ধ কইরা। আবার শুইয়া পড়ি। এক লেচা ঘুম দিয়া সজাগ হই। না তখনো কারেন্ট আইয়ে নাই। আবারও শুইয়া পড়ি। চোখ দুইটা কেবল লাইগা আইছে। এমন সময় ঢেরার দরজা ধইরা ঝাঁকুনির আওয়াজ। চোখ মেলে জিগাইলাম- কেডা?’ ওঠেন কারেন্ট আইছে মেশিন ছাড়বেন না? হাতের টর্চ লাইটা মারি। না কই কারেন্টতো আইয়ে নাই। শরীরটা কেমন জানি ভারি হইয়া গেলো। একটু একটু ভয়ও লাগছে। কুলফু আল্লাহু সুরা পইড়া বুকে ফু দিয়া আবার কাই মারার মতো পইড়া থাকি। আধা ঘণ্টা পর আবার কেডা যেন আগের মতোই ঢেরার দরজা লাড়তাছে। এইবারও জিগাই। কেডা কেডা তুমি? যাও কারেন্ট আইলে মেশিন ছাইড়া তোমার ক্ষেতে পানি দিমুনে। ‘না মামা আমি আলতা’। কেডা তুমি? কয়- আলতা। আমি জিগাই- আলতা কেডা? ঐ যে মামা বিষ খাইয়া মরছিলাম! এ কথা হুইন্না আমার হাত পা শক্ত হইয়া গেলো। পুরা শরীর অবশ হইয়া গেল। চোখ মেলতে পারছিনা। তবে ঢেরার দরজা ঝাঁকুনির শব্দ পাইতাছি। মুখ দিয়া সুরা কেরাত কিছুই আইতাছেনা। মনে হইতাছে আজই আমার শেষ রাত। আলতায় যদি কোন রকমে ঢেরাত ঢুকতে পারে। তাইলে আমারে টাইন্না টুইন্না খালে নিয়া চুবাইয়া মারবে। পুরো শরীর ঘামে তইরবুরা। এর মধ্যে মসজিদের মাইকে আল্লাহু আকবার কইরা হুজুর আজান দিতাছে। মনে হইলো প্রাণটা ফিরা পাইলাম। ফজরের আজানের পর আর ভূতপেত থাকেনা। যের যার মতো চলে যায়। উঠে যে অজু করমু, হেই শক্তিটাও নাই। ক্যাংমরার মতো পইড়াই রইলাম। সকালে মাঝারো পোলায় যাওয়ার পর ঢেরা ছাড়ি।’
তালুকদারের এ গল্প শুনে উপস্থিত সকলের মনে আলতা ভীতি প্রবেশ করলো। কেউ কেউ আলতাগো বাড়ির চৌসীমানায় পা না দেয়ার শপথও ইতিমেধ্যে করে ফেলেছে। এদিকে আজান গাজির বাড়িতে লোক ঠাঁই দেওনের জায়গা নাই। আজান গাজিরে দেখতে এসে তালুকদারের গল্পেই লোকজন মুখরিত। সবায় মৌচাকের মতো তালুকদারকে ঘিরে রেখেছে। পাড়ার বউ ঝিয়েরাও তালুকদারের গল্পে ভীত হইয়া বাড়ি যাওনের লাইগা চিন্তিত হইয়া পড়ল। সুফিয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কানতাছে। বাড়ি ভর্তি লোক। খালি ভূতের কথা কইতাছে। সুফিয়ার আবার ভূতের ভয় বেশি। লোকজন যাওয়ার পর রাইতে বাইরে যাইবে ক্যামনে হেই চিন্তায় সুফিয়া অস্থির হয়ে ওঠে। শেষে না জানি পেট ফেটে মরণ লাগে।
কেউ কেউ আজান গাজির মরণের কথা কইতে লাগলো। মরলে কবর কোথায় দিবে এ নিয়াও দু‘চারজন কানাঘুষা করতেছিল।
আজান গাজি ঠেলা মাইরা বালিশ থেকে মাথা ওঠায়। নুরু তালুকদারসহ গ্রামের উপস্থিত সকলকে কাছে ডাকে। আজান গাজির কথা শুনার জন্য সবায় গড়হাজির। আজান গাজি বয়ান শুরু করবার আগে দু‘চারবার জাইরাকাইশা নেয়:
-‘শোন মিয়ারা, তালুকদার সাবও শুনেন। আপনারা আমারে দেখতে আইছেন এই লাইগা আমি বহুত খুশি। তবে আমারে ভূত টুতে ধরেনাই। ভূত আছে এইডা আমি বিশ্বাসও করি না। নামায পইড়া আইবার সময় শরীরটা অস্থির কইরা উঠলো। তবে আমি একটা কিছু দেখছি হেইডা তোমগোরে কইতে চাই না। তবে জিনিসটা খারাপ কিছু না। বহুত ভালো জিনিস। যার বরাত ভালো হেই দেখতে পায়।’
সভায় কানাঘুষা শুরু হইলো। আজান গাজির মতো পাজি মানুষ ভালো জিনিস দেখছে। এটা কারো বিশ্বাসই হচ্ছেনা। কারো কারো মনে সন্দেহ জাগল। নিশ্চয়ই আজান গাজি নতুন করে কুমতলব আটছে। যে যার মতো করে নিজেদের ভিতর প্রয়োজনীয় আলাপ সেড়ে নিচ্ছে। আজান গাজি আবার ও বলা শুরু করলো:
-‘আমি যেই জিনিস দেখছি, হেই জিনিস দেখার পর মানুষ এক বছরের বেশি বাঁচেনা। আমারও যাওয়ার সময় হইলো বুঝি। তোমগো লইয়াই সারাজীবন চললাম। চলার পথে ভুল ত্রুটি হলে মিয়ারা আমারে মাফ কইরা দিও।’
এই বলে আজান গাজির দু‘চোখে জল নামে। এবার সভার সকলের ভিতরটা হুহু করে কেঁদে ওঠে। কেউ কেউ চোখের কোণে নিজেদের হাত দিয়ে জল মোছার চেষ্টা করছে। আজান গাজি সকলের কাছে বিদায় চায়। আস্তে আস্তে বাড়িভর্তি লোকজন যেতে শুরু করলো। তালুকদারও উঠবে বলে আজান গাজির হাতে হাত রাখে। গাজি তালুকদারের কানে কানে বিরবির কইরা কি যেন কইলো। তালুকদার উঠার আগে বসে পড়লো। বাকিদের যেতে বললো তালুকদার। বাড়ি খালি। সুফিয়া স্বামীর সেবা করার জন্য গাজির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু গাজি সুফিয়ারে তার কাছে যাইতে বারণ করলো। আজান গাজি আর তালুকদার ছাড়া ঘরে কেউ নাই। কেউ যেন ঘরে না ঢুকে এটাও সুফিয়ারে সতর্ক করে দেয়া হলো। আজান গাজি বলে চলে:
‘তালুকদার, শোন কেন্দুয়া ভিটেটা আমার চাই। আব্দুল হাইয়ের পোলার নামে নাকি ভিটেটা লিখে দিয়েছে। তুমি কি জান তালুকদার?
তালুকদার থম মেরে যায়। আজান গাজিরে কেন্দুয়া ভিটে দিলে তালুকদারের কি লাভ? তালুকদারের মাথায় এ কথা বার বার ঘুরঘুর করছে। আজান গাজি বুঝতে পারছে তালুকদাররে বাগাতে হলে টোপ মারতে হবে।
-‘শোন তালুকদার কি এমন ভাবছো এর আগেওতো তুমি-আমি এমন কাম করছি তাই না? তাইলে অসুবিদা কোথায়। কাজে নেমে পড়। আমি জানি আব্দুল হাইয়ের পোলা তোমার কথা শুনবে।’
-‘হেইডা আমি বুঝলাম গাজি, কিন্তু?’
-‘আরে মিয়া কিন্তু কি?’
-‘হুম আমি আপনারে কেন্দুয়া ভিটে লইয়া দিমু। আমারে অর্ধেক ভাগ দিতে হবে।
-‘তালুকদার এইডা কি কও? ঐ মিয়া তুমি আমার সাথে দর কাষাকষি করতেছো?’
-‘আপনি মনে কিছু করবেন না, কারণ ভিটেটা কিন্তু আমার কাছে বন্ধক রাখা আছে। আমি বললেই যে আব্দুল হাইয়ের পোলা ভিটেটা দিয়ে দিবে এমন না বিষয়টা। চিপায় ফালাইতে হবে। আমি চাপ দিলে আব্দুল হাইয়ের পোলা আপনার কাছে আইবে। আর আপনি বন্ধক নিতে রাজি হবেন না। ব্যস, এ এলাকায় আমি আর আপনে ছাড়া কার এত বুকের পাডা, জায়গা বন্ধক রাখে?
তালুকদারের বুদ্ধিটা গাজির ভালোই লাগে।
-‘তালুকদার আমারও একটা বুদ্ধি আছে। হেইডা হইলো আব্দুল হাইয়ের পোলারে ডাইকা আনবো। তারপর স্বপ্নে তার বাপেরে দেখছি। একটা গল্প বানাইয়া বলবো।
আপনার জবাব নাই। আপনি অসুস্থ আবার এলাকার ব্যাপাক মানুষ জানে আপনি অলি আউলিয়ার দেখা পাইছেন। এখন যা বলবেন মাইনষে তাই বিশ্বাস করবে। তবে এই কিস্যাটা আপনি জুম্মার দিন মসজিদে বলবেন। তাইলে মাইনষে আরো বিশ্বাস করবে। কারণ কেউই মসজিদে দাঁড়াইয়া মিছা কথা কইবে না।’
-‘কি কও মিয়া মসজিদে খাড়াইয়া মিছা কথা কমু।’
-‘আরে গাজি পরে তওবা করে নিবেন। আল্লায় তওবাকারীকে মাফ কইরা দেন।’
গাজি কিছুটা বিমর্ষ। হারামি তালুকদার আমারে মসজিদ পর্যন্ত নিয়া যাইবে। আমি সব করুম। যা করছে আল্লায়। ভিটেটা আমার দরকার। তালুকদার চলে যাওয়ার পর সুফিয়া তার স্বামীর পায়ে পড়ে, আপনি দয়া কইরা মসজিদে গিয়া মিছা কথা কইয়া ভিটেটা নিয়েন না। আব্দুল হাইয়ের পোলার ঐ ভিটেটা ছাড়া আর কোন সম্পত্তি নাই। গরিব মানুষ বদলি গিয়া সংসার চালায়। আর আপনের শরীরটা এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না। শেষে আপনের কিছু হয়ে গেলে। আজান গাজি সুফিয়ার চুলের মুঠি ধরে:
-‘মাগি খাড়াই খাড়াইয়া কথা শুনস। আব্দুল হাইয়ের পোলা কি তোর হানগালাইয়া লাগে, সুপারিশ করতাছছ?’
সুফিয়ার চোখ দিয়া অঝোরে অশ্রু ঝরছে। কোনরকমে ছুটতে পারলেই বাঁচা যায়। গাজি সুফিয়ার গলার মধ্যে চিপা মারে আরে বলে:
-‘চুতমারানির ঝি যদি এ কথা গায়ের কেউ জানে তবে তোরে গলাত টিপ দিয়া মাইরা ফালামু।’
সুফিয়ারে ছাইড়া আজান গাজি মসজিদের দিকে রওনা দেয়। আছরের নামায পড়বে। শুক্রবারের ঘটনা কি ভাবে বর্ণনা করা যায় তার একটা রিহারসেলও মনে মনে দেয়া শুরু করে। আছরের নামায শেষে মসজিদের অনেককে সাথে আকারে ইঙ্গিতে তার স্বপ্নের কথা বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ভাইঙ্গা বলছে না। শুক্কুর আলি গাজিরে জিগায়:
-‘গাজি আপনে কি কইতে চান হেইডা ভাইঙ্গা কন। ভাইনগা না কইলে বুঝুম ক্যামনে?
-‘হু মিয়া ভাইনগাতো কমুই। হের লাইগা তো তোনগোরে শুক্রবার জুম্মার দিনে মসজিদে আইতে কইতাছি।’
‘আচ্ছা আমুনে’। এ কথা বলে শুক্কুর আলি বিদায় নেয়। আর তালুকদার ও গাজি দিন গুনতে থাকে, সোম-মঙ্গল-বুধ, বৃহস্পতি আর চারদিন পরই শুক্রবার। দুইজনে মিলে রিহার্সালের কাজটিও আয়ত্ব করে নেয়। এমন ভাবে বলতে হবে যাতে কারো মনে কোন সন্দেহ না থাকে। গাজির পারফরমেন্সে তালুকদার বেজায় খুশি। দিন গুনে গুনে শুক্রবার আসে। আজ গাজি আর তালুকদার আগে ভাগেই মসজিদে যায়। জুম্মার আযান গাজি দিবে। ভরাট কণ্ঠে আল্লাহু আকবার ধ্বনি শুনে গ্রামের বউ ঝিয়েরা গাজির প্রশংসা করে। আহারে বেচারা মরণের সময় হইছে তাই... কতো মাইয়া মাইনসেরে এ বেডাটা ডিস্টার্ব করছে হেইডা আল্লায় যেদিন ধরবে হেইদিন বুঝবে মজা। গুরজু দিয়া গুতাইয়া গুতাইয়া সব রস বাহির কইরা নিবে। গ্রামের বউ ঝিয়েদের এমন সমালোচনা গাজির কাছে নতুন কিছু না। কতো মাইয়াদের সাথে ছি.... এসবতো গাজির চরিত্রের গুন। আরে মিয়া পুরুষপোলার একটু আধটু এমন স্বভাব না থাকলে কি হয়। এমন এমন মন্তব্যও কোন কোন মাইয়াছিলা করছে। কথায় আছেনা শিং ওয়ালা গরু আর ...ওয়ালা পুরুষের কোন বিশ্বাস নাই।
মসজিদ কানায় কানায় ভর্তি। মসজিদের ভিতরও গাজির স্বাস্থের খোঁজ খবর চলতাছে। হুজুর খুতবা লইবে। সবাইকে চুপ থাকতে বলছে। কিন্তু তারপরও খুসখোসানি আলাপ আলোচনা চলছে। নামাযের চেয়ে সবার আগ্রহ গাজির স্বপ্নের দিকে।
-‘খুতবা শেষে ফরয নামাযের পর গাজি সাহেব আপনাগো লগে দুচার কথা কইবে। সবায় ধৈর্য্য ধইরা বসবেন। গাজি সাব অসুস্থ, আর অসুস্থ লোকের কথা শুনা বহুত ফায়দার কাজ।’
ইমাম সাহেব নামায শুরু করে। নামায আদায় করে সকলে মসজিদে গোল হয়ে বসে। মিম্বারের কাছে আজান গাজি গিয়া দাড়ায়। অসুস্থ শরীর তার উপর হাঁটু কাঁপানি শুরু হয়েছে। লোকটার এ অবস্থা দেখে ইমাম সাব সকলের কাছে অনুমতি নিয়া আজান গাজিকে বসে বলার জন্য অনুরোধ করে। আজান গাজি তার স্বপ্নের বয়ান শুরু করে:
-‘দেখেন আমরা এ এলাকারই সন্তান। আমি কারো চাচা কারো ভাই কারো...’
কথা শেষ না করেই আজান গাজি তার হাত দিয়ে চোখ মোছে।
-‘আমি আজ অসুস্থ আপনাদের কাছে দোয়া চাই। আর আপনারা আমারে মাফ কইরা দিয়েন। আমার ব্যবহারে যদি কারো মনে কষ্ট পেয়ে থাকেন মাফ কইরা দিবেন। আর আপনারা আমারে খারাপ মানুষ মনে করেন, আমি আসলেই খারাপ। তবুও আপনাগো কাছে মাফ চাই।’
উপস্থিত লোকজন আবেগ ধরে রাখতে পারলোনা। কেউ কেউ সাথে সাথে আজান গাজিরে মাফ কইরা দিছে। এইবার আজান গাজি বলতে শুরু করলো:
-‘দেখেন আপনারা, আল্লায় আমারে শাস্তি দিছে। এত অর্থ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমার কোন ছাওয়াল পাওয়াল নাই। আমার মনে হয় আমার যাওয়ার দিন ফুরাইয়া আইতাছে। তাই আমি আপনাগো লাইগা একটা গোরস্তান করবার চাই। এমন একটা জায়গা আপনারা আমারে দেন। না আমি কিনে নিব। উপযুক্ত দর দিয়াই কিনে নিব। যে জায়গাটা বর্ষাকালেও পানি উঠেনা। আমি গোরস্তানের সাথে একটা এতিমখানাও করুম। তবে জোর-জবস্তির কিছু নাই। আল্লার কামে জোর-জবস্তি করে হয়না। আমি গত তিন রাইত পর পর একটা স্বপ্ন দেখছি। বিষয়টা নিয়া মসজিদের ইমাম সাহেবের সহিতও কথা কইছি। প্রথমে ভাবছিলাম হয়তো স্বপ্নটা আমি এমনি এমনি দেখছি। হয়তো অসুস্থ শরীর তাই। কিন্তু তিন রাইত একই স্বপ্ন দেখাতে মনটা কেমন জানি করতাছে। ইমাম সাবেরে কইলাম। ইমাম সাবতো শুইনা খুশিতে আলহামদুলিল্লাহ বলেছেন। আল্লার কাম নাকি সবায় করতে পারেনা। আমার মতো পাপীরে দিয়ে আল্লায় করাইতে চাইছে। এই জন্য আল্লার দরবারে শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।
স্বপ্নটা কি? দুইচাইরজন কৌতুহলে জিগাইলে:
-‘ঐ মিয়ারা আল্লার ঘরে আইসা তাড়াহুড়া করলে কি হয়। আল্লার ঘরে একটা মুহূর্ত দুনিয়ার সমস্ত সম্পত্তির চাইতেও উত্তম। কি কন ইমাম সাব। সকলে একবার জোরেশোরে আলহামদুলিল্লাহ বলি। এইখানে কি আব্দুল হাইয়ের পোলা মনছু মিয়া আইছো?
মনছু মিয়া আওয়াজ দেয়:
-‘জ্বি গাজিসাব আমি আছি।’
-‘শোন তোমার বাবা মরছে কতো বছর হবে?
-‘এই ৫/৭ বছর।’
-‘গত তিনরাইত আমি তোমার বাবার সাথে স্বপ্নে কথা কইছি। আলহামদুলিল্লাহ তোমার বাবা বেশ ভালো আছে। ইয়া লম্বা লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি সাদা পাঞ্জাবি। মাশাল্লাহ, বহুত উত্তম অবস্থায় তোমার বাবায় আছে। আল্লায় যেন তোমার বাবার উছিলায় আমাদেরকেও মাফ কইরা দেন। সবাই জোরে আমিন বলি।’
মনছু মিয়ার মনটা খুশিতে ভইরা উঠে। আহা বাজানরে আল্লায় ভালোই রাখছে। এই জন্যই বাজান আমাগো লগে দেখা করেনা। কোনদিন স্বপ্নেও বাজানের দেখা পাইলাম না। মনছু মিয়া চোখ মোছে। আরে মিয়া কানদো কেন, এটা তো খুশির খবর। বাড়িতে গিয়া আজই ইমাম সাবেরে দাওয়াত দিয়া তোমার বাবার লাইগা দোয়া করাইবা। যদি টাকা পয়সা লাগে আমার কাছে কইবা। শরম পাইবা না। আমি এখন আর আগের গাজি নাই। আমারও যাওনের সময় হইয়া গেছে। মরণের আগে কিছু ভালা কাম কইরা যাইতে দাও। মনছু মিয়া শোন তোমার বাবায় আমারে কইছে আমি যেন একটা গোরস্তান আর গোরস্তানের লগে একটা ইতিমখানা কইরা দেই। আমি তোমার বাবারে কইলাম গোরস্তান করার মতো জায়গাতো নাই। আমার যে জমি জিরাত আছে তা সবই তো ফারাক ফারাক। একেকটা একেক জায়গায়। কোনটা উত্তরচকে কোনটা আবার দক্ষিণ চকে। তোমার বাবায় কইলো ঐ মিয়া তুমি চিন্তা করছো কেনো, মনছুরের কেন্দুয়া ভিটেয় করবা। আমার পোলায় কি আল্লার কামের লাইগা না করবে। আমার ঘুম ভাইঙ্গা যায়। আমি চিন্তিত হইয়া পড়ি। মনছু’র তো ভিটে ছাড়া আর কোন জায়গা জমি নাই। এইডা আমারে কি কইলো আব্দুল হাই। পরপর তিনদিন একই স্বপ্ন দেখলাম। তাই জুম্মার দিন মসজিদেই তোমাদের সকলকে জানাইলাম। এখন যদি মনছু মনে করে কেন্দুয়া ভিটে দিবে তবে আমি গোরস্তান করবো। আর না দিলে না করুম। জোর-জবস্তির কিছু নাই বাজান। এইডা তোমার ব্যাপার। তুমি যদি মনে কর ভিটে বেচবা তবে বাজারে যে দর আছে তার চেয়ে বেশিই দিমু। আর যদি মনে কর না ভিটের বদলে অন্যকোন জায়গায় জায়গা নিবা তবে হেইডা দিতেও আমি রাজি আছি। এখন যাও বাড়িত যাও বউয়ের লগে তোমার মা জীবিত আছে তোমার মা‘র লগে বুজো। তারপরই না হয় আমারে জানাইও।’
সবাই যার যার মতো করে বাড়িতে যায়। গাজির চালাকি কেউই বুঝেছে বলে মনে হয়না। সবায় গাজির মহৎ কাজের প্রশংসা করতাছে।
পাদটিকা: এভাবেই একদিন মনছু মিয়ার ভিটে গোরস্তানের নামে দখলে নেয় আজান গাজি। কথা ছিল জমি নিয়া জমি দিবে কিন্তু তাও দেয়নি মনছু মিয়ারে। উপরন্তু তালুকদারের কাছে ভিটে বন্ধকের কারণে মনছু মিয়াকে আজান গাজির কাছ থেকে কর্জ নিতে হয়। এবং সেই কর্জ শোধ করার জন্য পেটে ভাতে বিনে পয়সায় ছয়মাস মনছু মিয়াকে আজান গাজির কামলা খাটতে হয়েছে। এভাবে এদেশের বহুত জায়গা হাট বাজারের নামে গোরস্তানের নামে মসজিদ মাদ্রাসার নামে এতিম খানার নামে গরিবদের কাছ থেকে দখল করে নেয় সমাজের আজান গাজিরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর