
দুর্বৃত্তপনা আর কবিতা লেখা- দুটি দুই রকমের কাজ। ব্যক্তির দুর্বৃত্তপনা আছে কিন্তু কবিতার কোনো দুর্বৃত্তপনা নাই। ব্যক্তি-কবি একজন দুর্বৃত্ত হতে পারে কিন্তু তার লেখা কবিতা দুবৃর্ত্তপনা ধরে রাখে না। দুর্বৃত্তপনা একটি ঈভল ট্যাম্পারমেন্ট, সেটি একটি অপকর্ম সাধন করে- যার সাথে বেনিফিশিয়ারির রুটি রোজগার, আসন বাসন, মান সম্মান ইত্যাদি জড়িত। কবিতা-প্রতিভা এখানে নাই। তার মানে এর সাথে ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াশীলতা আছে। আছে একটি সিস্টেমেটিক ব্যবহার, প্রচার আর বিস্তার। কিন্তু কবিতা সরাসরি কোনো রকমের সামাজিক বা রাষ্ট্রিক ক্ষমতায়নের সাথে যুক্ত নয় বলে এটি দুর্বৃত্তপনার বাইরে। এটির সাথে জড়িত দুইজনের (দুর্বৃত্ত আর কবি) মনোসমীক্ষণ যাচাই করলে বলা যায় যে কবিতা লেখে, সে কতগুলি নেগেটিভ জীব আচরণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, আবার কিছু জীব আচরণ সে পায় তার পরিবার আর সমাজ থেকে। তার মন আর শরীরে এই জীব আচরণ সর্বকালীন বজায় থাকে, কিন্তু রচনাটি কবিতা হয়ে উঠলে কবি ব্যক্তির সেই নীচ আচরণ থেকে সে মুক্ত। তখন এটির কোনো ঈভল উদ্দেশ্য থাকে না বলে এটি কাউকে জড়িত করে না বা পারে না। এটিকে আমারা যখাযথ মূল্য দিই আর না দিই তাতে এটির কোনো কিছু যায় আসে না। কিন্তু যখনই তাকে কেউ স্বভাবের কষ্টিপাথর দিয়ে তার মূল্যবিচার করে, একটি সামাজিক স্থানে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তখনই এর কর্তা এর ভেতরে নিজের একটি ড্যুয়াল পারসোনালিটি তৈরি করে। তখন এর কর্তা নিজেই দুষ্ট বিচারক হয়ে এটির গুণবর্ধন বা গুণবিনাশ করে।
একটি কবিতার মুক্তপাঠে এক সময় এর ভালো মন্দ, শক্তি, দুর্বলতা নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু কখনই এর কর্তার সামাজিক বা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনার মনোবাসনাটি পাওয়া সম্ভব হয় না। যেহেতু কবিতা অনেকাংশেই কবি-ব্যক্তির একটি মাস্ক এবং এটি অনেকাংশেই স্বয়ংপ্রকাশ, সেহেতু এটি কবি-ব্যক্তির কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে পারে না। কিন্তু এই কবি-ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত লাভ লোকশানের জন্য এই দুর্বৃত্তপনায় জড়িয়ে পড়ে একসময়। কবিতা-সাহিত্যে একদল দুবৃত্ত সর্বকালে, সর্বদেশেই ছিল, আছে এবং থাকবে। কারণ কবিতার সাথে অনাবশ্যকভাবে জড়িয়ে আছে কবি-ব্যক্তিটির জীব অস্তিত্ব (‘অহং’ যার নাম)আর কপোর্রেট দানব শাসিত সমাজে মনোপলি করার বৈশ্য মানসিকতা। এই দুটি কু-মন্ত্রণা থেকে যে অবস্থা তৈরি হয় সেখান থেকেই বাজারি কবি আত্মার এই অসুস্থ আত্মবিস্তারের কূট-কৌশল বজায় রাখে। আজ বাংলাদেশের কবিতা সাহিত্যে এই দুর্বৃত্তপনার এতোই সাফল্য মণ্ডিত বিস্তার যে আমাদের জাতীয় চরিত্রের মতোই এটি কবিতা-সাহিত্যের একটি সিস্টেম লসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সিস্টেম লসের কারণে কবিতা পাঠকেরা ভালো কবিতা আর মন্দ কবিতার চরিত্র নিধার্রণ করতে অপারগ, কবি আর অকবির মধ্যে ফারাক করতে অক্ষম।
বাংলাদেশে এই ধরণের দুর্বৃত্ত আক্রান্ত সাহিত্যিক পরিবেশ আগেই ছিল। কারণ শিল্প সাহিত্যের প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিকতা নিজে নিজে গজায় না, এর একটা বাহক থাকে, কারিগর থাকে। সাধারণত যারা ভাব ও ভাষায়, চিন্তা আর কল্পনায়, উদ্ভাবন আর আবিষ্কারে কমজোর তারা এই চক্রে পা দেয়। তারা সেই দুর্বৃত্তপরায়ন ‘অহং’ তাড়িত হয়ে আত্ম-প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু আজকাল যে পরিমাণ চক্ষু লজ্জাহীন দুর্বৃত্তপনার পরিচয় পাওয়া যায় তা আগেকার— ভালো লেখার কারণে ‘বন্ধুহিংসা’ সুলভ নিরাপদ দুর্বৃত্তপনা থেকে অনেক অনেক দূরে। আজকের এই দুর্বৃত্তপনা বেশি অর্গানাইজড বেশি মিলিট্যান্ট। বলা যায় বাংলাদেশে আশির দশক থেকেই কবিতায় এক ধরণের অর্গানাইজড, ব্রাক্ষণ্যবাদী চিন্তা ধারার বীজ রোপিত হয়েছে। তখন কয়েকটি ছোট কাগজ ঘেঁষা কিছু কবি ভারতের পশ্চিম বঙ্গের ৭০/৮০ দশকের কিছু কবির জীবন ও কবিতার অনুকরণ করে, কখনো তাদের যোগসাজসে নিজেদের একটি ক্ষুদ্র, কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালি দল তৈরি করে আস্তে আস্তে মিডিয়ার বিভিন্ন শাখায় নিজেদেরকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, একরকমের কপোর্রেট শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয়। ওদের কেউ কেউ প্রতিভাহীন হওয়ার কারণে অচিরেই কলমরহিত হয়েছে বা একটি বদ্ধ পুকুরে আটকা পড়েছে বটে, কিন্তু নিজস্ব লিগ্যাসিকে ধরে রাখার খায়েশে, একটি স্ব-নির্মিত খলিফাপ্রথা শুরু করে দিয়ে যায়। আজ সেটি বহু শাখা প্রশাখায় বিস্তার লাভ করে আরো বেশি ডাইনামিক, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খেলাফতি শক্তি বিস্তারে আরো বেশি তৎপর। বাংলাদেশের কবিতা- সাহিত্যে আজ কেন এই দুযোর্গের ঘনঘটা, কেন এমনটি হচ্ছে তার উত্তর আমার কাছে নাই। তবে আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করে যে সব সূত্র আবিষ্কার করলাম- তাই পাঠকের উদ্দেশে শেয়ার করতে চাই।
• তিন তিনবার দুর্নীতির শীর্ষে থাকার কারণেই যে এই দেশে জন্ম লাভকারী প্রতিটি কবি- ব্যক্তি দুর্বৃত্ত কবিতে রূপান্তরিত হবেন এমন ভাবার কোনো কারণ নাই। অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা ব্যক্তির ব্যালান্সড মানসিক বিকাশে অন্তরায় হতে পারে কিন্তু এটি প্রতিটি কবির শুভ বোধকে বিনাশ করতে পারে না। অস্ট্রেলিয়ার একজন কবি-ব্যক্তিও দুর্বৃত্ত হতে পারেন (ইগো নির্ভর), কিন্তু যে কারণে বাংলা মুলুকের একজন কবি দুর্বৃত্ত হবেন তিনি সে কারণেই হবেন না এটি নিশ্চত। আমি মনে করি বৃহৎ অর্থে বিষয়টির সাথে একটি জনগোষ্ঠীর জাতিগত স্বভাব চরিত্রটি জড়িত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, নৃতাত্তিক তথ্যাদি যাচাই করে বাঙালি জাতির উৎপত্তি, স্বভাব চরিত্র খেয়াল করলে বাঙালি জাতির চরিত্রে রক্তাক্ত, আত্মঘাতি ডাইকোটমির চিহ্ন বেশি পাওয়া যায়। বাঙালি যেমন বীরপ্রসু, স্বাধীনচেতা, আবেগপ্রবণ ও অতিথিপরায়ন জাতি ঠিক একইভাবে তারা প্রায় একটি দস্যু, আত্মকেন্দ্রীক, কপট, পরচর্চাকারী, পরধনলোভী, অলস স্বভাবের জাতি। তাই আশা করা যায় এই ডাইকোটমি কবি-ব্যক্তির মনে, স্বভাব চরিত্রে লুক্কায়িত বা কখনো প্রকাশিত অবস্থায় থাকবে।
• সুস্থ সমালোচানার অভাব আর একটি কারণ। দীর্ঘদিন গোলামির অধীনে থাকার কারণে, একটি ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় শিক্ষা গ্রহণের কারণে, কবি-ব্যক্তির ভাষায় আর মননে ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিস এর স্বভাব গড়ে ওঠেনি, গড়ে ওঠেনি বস্তুবাচক সমালোচনা করার চিন্তা পদ্ধতি। সুস্থ সমালোচনার অভাবে আমরা পাঠকেরা বুঝে উঠতে অক্ষম যে কোনটা ভালো কবিতা কোনটা মন্দ কবিতা, কোনজন দুর্বৃত্ত কবি আর কোনজন শিষ্ট কবি। সমালোচক আছে কিন্তু অধিকাংশই সেই দুষ্ট দুর্বত্তয়ানের ভেতরেই বাস করেন বলে কবিতার সমালোচনা পক্ষপাতদুষ্ট, খলিফার মেজাজ মর্জি জাত। যদি একটি নিরপেক্ষ সমালোচনা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যেত তাহলে এই পাঠক, কবি ও কবি যশোপ্রার্থীরা একটি স্বাধীন চিন্তা-পথ আবিষ্কার করতে
• ভারতীয় চিন্তাপদ্ধতি বীরপূজা ধারক। আমরা যা কিছুই ভাবি না কেন একজন বীর আমরা সব সময় চাই। তাই এই বীরপুজা মানসিকতার কারণে, অন্য একটি সম্ভাবনাকে দমন করার ঈভল ইচ্ছা পোষণ করি। আবার এই একই মানসিকতার কারণে বাঙালির মানসে গণতন্ত্র চর্চার কোনো অনুশীলন নাই। তাই জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে অফিস আদালত, ঘরে বাইরে, পরিবার পরিজনে, সাহিত্য পরিমণ্ডলে এই দুর্বীনিত, দুষ্ট, দস্যু মানসিকতা বজায় আছে। গণতন্ত্রে একটি কথা আছে— আমি তোমাকে ঘৃণা করি তা সত্য কিন্তু তুমি যা বলতে চাও তা আমি মৃত্যু দিয়েও প্রমাণ করব। এটির চর্চা নাই বলে দল আর বল নিয়ে সবাই সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠার সহজ, সরাসরি পথে নামে।
• অনেকদিন ধরে ( ১৯৪৭ সনের ভারত বিভাগের সময় থেকেই) বাংলাদেশের মানুষ একটি আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগছে- যা কিনা আমাদের জাতীয় মননে ও পরিচয়ে একটি গোপন অদৃশ্য চিন্তা-ভেদের দেয়াল তৈরির বড় কারণ। এটি একটি জাতীয় ব্যাধি। বাঙালি/বাংলাদেশী মুসলমান/বাঙালি মুসলমান এমনতরো ছেলেমানুষি কূটতর্ক, ভাগ বিভাজনের নানান অন্ধ কানাগলি ধরে কাব্য-সাহিত্য মহলেও পরিচয় ভাগাভাগির চোরাবালিতে কবিরা পড়ছে। কবি-ব্যক্তি থেকে শুরু করে কবি সংঘ, কবিচক্র, মিডিয়ার কবিতাগিরি ভাগ হয়ে পড়ছে। সেখানে ছোট, বড় খলিফাগণের সুশীতল ছায়াতলে বয়স্ক কবি, ভবঘুরে কবি, বেকার কবি থেকে শুরু করে শিশু কবিটি পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে মাথা ঠুকে আছে। ভারি চিন্তামুক্ত এই অবস্থান!
• মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতার প্রধান আকর্ষণ পদ দখল এবং পদলেহন। বাংলাদেশ একটি মধ্যবিত্ত/ নব্য উচ্চ মধ্যবিত্ত শাসিত সমাজ। এদের অধিকাংশেরই কোনো মূল্যবোধ, স্বাধীন বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। তাদের কোনো ইমান নাই- না ধর্মে না সামাজিক নৈতিকতায়। ফলে তারা যে পদ সে পায় তা সহজে ছাড়তে চায় না, একটি বানানো মিথ্যা লোক লজ্জার ইতিহাসে বাস করে। তাই কবি-ব্যক্তিটি তার বানানো পদটির মর্যাদা আমৃত্যু ধরে রাখার চেষ্টায় কপটতা করেন। শাদাকে কালো, কালোকে শাদা বলেন।
• তরুণদের বিরাট একটি অংশ বেকার, সেখানে কবিখ্যাতির পেছনে ছোটা কবি-তরুণ আরো বেশি বেকার বা ছদ্মবেকার। তাদের সামনে যে দরোজাটি একটু খোলা সেটি হল- নিউজপেপার, ম্যাগাজিন বা আজকের অনলাইন মিডিয়ায় ঢুকে যাওয়া। প্রতিভাবান তরুণ কবি নিজের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা অনুসারে তৈরি খেলাফতের দিকে আগায়, তার বিচার বিশ্লেষণ যাচাই বাছাইয়ের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সেই দুষ্ট দুর্বৃত্তচক্রে পড়ে যায়। তার আপাত কোনো মুক্তি নাই। তার চক্রের বাইরে সে আর কিছু দেখে না।
• ব্যক্তি কুসংস্কারাচ্ছন্ন থাকার কারণে, অপর পক্ষকে বোঝা জানার ক্ষমতা হারায়। আত্মশক্তি জাগ্রত করার জায়গায় কাজ করে ভয়। এই ভয়ের কোনো সংজ্ঞা নাই, কারণ সেটি আসে একটি অন্ধকার থেকে। সেই ভয় থেকে আসে নিজের আশে পাশে একটি নিরাপদ দূর্গ তৈরি করা, আর কাউকে সেই দূর্গে ঢুকতে না দেওয়া।
• বাংলাদেশে কোনো কোনো কবি সাম্প্রতিক ধারার কবিতাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে- ‘অবক্ষয়ী আধুনিক’ নাম দিয়ে চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে কবিয়ালি-সাহিত্য গোছের কবিতার চর্চা করে- বাংলা কবিতার আবহমান ধারাটির পুনর্জন্ম চান। কবি ও কবিতার মধ্যে ফ্যাসাদ তৈরি করতে চান। আমাদের বুঝতে হবে যে আধুনিকতাবাদী ধারণা সময়, সমাজ তথা মানুষের চিন্তা চেতনা বিকাশের স্বাভাবিক একটি ধারা। পৃথিবীর ঘূর্ণন আর বিস্তার যদি স্বাভাবিক হয়ে থাকে তাহলে, মানুষের চিন্তা কল্পনা আর সভ্যতা তো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। পরিবর্তন আসবে সব জায়গাতে। দরজা জানালা বন্ধ করেই তো আর আমরা পৃথিবীর হাওয়া বাতাস থকে পালাতে পারব না। এই যুগপরিবর্তনকারী দীক্ষা থেকে গুরু বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ মাইকেলও বাদ পড়ে নাই, পড়ে নাই শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ বা ফরহাদ মজহারও। আজ আমরা যে ‘দুষ্ট’ আধুনিকতার পাঠ করি তা মূলত খণ্ডিত ও একপেশে। সত্যি যে আধুনিকতাবাদের দ্বিতীয় ধারাটি(আল্ট্রা প্রগ্রেসিভ)- মানুষকে কিছুটা ব্যক্তি-ভজনার দর্শন দিয়েছে, তাকে দলবদ্ধতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, তার যৌক্তিক অবকাঠামো দুর্বল করে তাকে দানবে, পাগলে রূপান্তরিত করেছে। কিন্তু তার হাত ধরেই মানুষের মননে আর চিন্তায় এসেছে প্রশ্ন ও সন্দেহ করার, গ্রহণ আর বর্জনের দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। তার হাত ধরেই পরে পোস্ট মর্ডানিজমের সিন্থিসিস কনসেপ্ট কার্যকর হয়েছে— যেখানে আমরা বর্তমান আর ভবিষ্যতের হাইটেক ফাইবার গ্লাস সুপারসনিক ই-টেক জর্জড়িত সভ্যতা আর সংস্কৃতির সাথে মানুষের অতীত, মানুষের ঐতিহ্য আর ব্যক্তিগত বিশ্বাস, রাজনীতি, লোকাচার ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে এক জায়গায় আনতে পারার সুযোগ পেয়েছি। আমরা আধুনিকতার সৃষ্ট সবকিছুই নেব, তার হাওয়া বাতাস খাব কিন্তু তা স্পৃষ্ঠ কোনো লেখালেখি করব না, তাতো হতে পারে না। আর যে দল কবিয়ালি-সাহিত্য টাইপের কবিতা লিখে বাংলাদেশের কবিতাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা চিন্তা করেন, যারা ভাবেন যে কবিদেরকে প্রান্তিক মানুষজনের কাছে, তথা হাটে ঘাটে গ্রামে গঞ্জে ফিরে যেতে হবে, তাদের কথা লিখতে হবে- তাদের কাছে আমার প্রশ্ন বাংলাদেশের কতজন মানুষ কবিতা পড়ে? গ্রামের কতজন আর শহরের কতজন? একটু চিন্তা করুন। কবিয়ালরা যা লেখেন সেগুলি তো গান বা গীত, সেগুলি সব সময় একটি বিশেষ চিন্তায় ক্লোজড হয়ে থাকে। সেগুলিতে ধর্মদর্শন, জীবনদর্শন বা সৃষ্টিকর্তার সাথে সৃষ্টির সর্ম্পককে জানার গোমর আছে কিন্তু কবিতার প্রাণ, কবিতার বহু ব্যঞ্জনাময় প্রকৃতি, কবিতার সেই মেজিক্যাল ইমাজিনেশন -সেখানে অনুপস্থিত।
• আমাদের দেশে ডাইনামিক পাঠক্ষমতাচক্র গড়ে ওঠেনি বলে আমরা কবি ও কবিতা নির্বাচনে আমাদের বন্ধু বা বন্ধু সমান কোনো এক আত্ম-স্বীকৃত নেতা কবির কাছে আমাদের নির্বাচন ছেড়ে দেই। তার ফলে বিচারের ভুল দুষ্ট দর্শনে আমরা পা দিই ও খন্ডিতকরণ বা বাক্সবন্দী করার দুষ্টবুদ্ধিতে মত্ত হই। আজকালের বেশির ভাগ তরুণই পৃথিবীর ছড়ানো ছিটানো কবিতাগুলি পড়ে না, ওরা নিজের কবিতার উপর বন্ধুদের লাইক আর ভালো লাগার স্পর্শ পেয়ে মনে করে তারা তরী ভিড়িয়ে ফেলেছে। তাদের আর কোনো কিছুর জানা আর পড়ার দরকার নাই, কোথাও যাওয়ার নাই। পড়াশোনা বা ক্রিটিক্যাল অন্যালাইসিস এর অভাব থাকাতে ওরা একটি কবিতার ভালো, মন্দ বিচারও করতে পারে না। আর যারা পারেন, তারা সেই আবহমান কালের কপট স্বভাবের কারণে, দলপতির ভয়ে চুপ করে থাকেন।
সবেশেষে বলব- প্রকৃত কবিদের— এই কবিতা-সাহিত্য দুর্বৃত্তপনা সম্পর্কে সচেতন থাকা ভালো, কিন্তু তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নাই। কারণ দুর্বৃত্তপনা একটি অন্ধকার, একটি সিস্টেম লস। যারা এই চক্রে আছেন তারা প্রাকৃতিক কারণেই নিজেরা একদিন স্তব্ধ হয়ে যাবেন বা খেলা থেকে ইস্তফা দেবেন। পাঠকের শিক্ষা দীক্ষা, দৈহিক ও মানসিক সাস্থ্যের উন্নতি ঘঠলে এসব অন্ধকার আর থাকবে না। তখন একটি লাইট হাউজ না হোক একটি মোমবাতি নিয়ে কেউ এসে হয়ত সামনে দাঁড়াবে। ততদিন পর্যন্ত একটি অপেক্ষা চলতে পারে।
বাংলাদেশ সময় : ১৫৪৩ ঘণ্টা, ০৯ জানুয়ারি ২০১৩
এমজেএফ/ [email protected]