
স্বর্ণের দোকানে প্রচণ্ড ব্যস্ততা। উচ্চবিত্ত সুন্দরী রমণীদের বেশ উপস্থিতি। এরইমধ্যে কিভাবে দোকানের ভেতরে যাবে গুলবাহার। হাতে ভিক্ষের ঝুলি, ময়লা কাপড় পরিহিতা এই বৃদ্ধাকে দেখেই হয়তো চেঁচিয়ে উঠবেন জুয়েলার্সের মালিক অন্নদা বণিক। কিন্তু আজ তাকে যেতেই হবে।
ক্ষুধায় পেটটা ছমছম করছে। গতরাত থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত তার খাওয়া হয় নি কিছু। এই শহরে ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রচুর হলেও খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা হয় না। সারাদিনে কম-বেশ যা জুটে যায় তা খারাপ না। কিন্তু গুলবাহারের সমস্যাটা অন্যরকম। বারবার গুলবাহারের চোখে ভেসে উঠছে তার মেঝো মেয়ের মুখ। যেন শ্রাবণের আকাশ। কালো মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে। অথচ মেয়েটা কতো সুশ্রী। এখন চোখের জলই তার সঙ্গী। মেয়ের জামাই কৃষক। এবার ফসল ভালো হয়নি। খরায় নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যবসা করতে চায় সে। শ্বাশুড়ি একা মানুষ। ভিটেমাটির কী দরকার। তাই ভিটেমাটি বিক্রি করে ব্যবসার জন্য টাকা নিতে চায় জামাই। গুলবাহারের মেয়ে সেলিনা এককথায় অসম্মতি জানিয়েছে। বলেছে, এটা কোনোদিনও হবে না।
এজন্য মেয়ের জামাই খুব ক্ষিপ্ত। কারণে-অকারণে বেদম প্রহার করে সেলিনাকে। কিন্তু গুলবাহারকে তা জানায়নি সেলিনা। মেয়েরজামাই বাড়ির প্রতিবেশিরাই এ খবর জানিয়েছে তাকে। খবরটি পাবার পর থেকে গুলবাহারের মুখ দিয়ে কোনো খাবার যাচ্ছে না। যে মেয়েকে কোনোদিন মারধর করেনি গুলবাহার আর তার স্বামী রমিজ আলী। সেই মেয়েকে পেটাচ্ছে অন্য বাপের পুত। এটি কী করে সহ্য করবে গুলবাহার। গুলবাহারের স্বামী রমিজ আলী বেঁচে নেই। রমিজ আলী বেঁচে থাকলে কি এটা সহ্য করতে পারতো? তাই গুলবাহার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার স্বর্ণের আংটি বিক্রি করে যে টাকা পাবে তা মেয়ের জামাইকে দিয়ে দেবে। তাতেও যদি মেয়ের জামাই খুশি না হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত ভিটেটা বিক্রি করতে হবে। তবে এ বিষয়টি গুলবাহারের অন্য মেয়েরা কিভাবে নেবে তা একবারের জন্যও তার মাথায় আসেনি। গুলবাহারের তিন কন্যা। এরমধ্যে সেলিনা হচ্ছে মেঝো।
যাই হোক আপাতত আংটি বিক্রি করতে হবে। এর আগে অনেকবার এ আংটিটি সে বিক্রি করতে চেয়েছিলো কিন্তু পারেনি। আংটির মাঝে অদৃশ্য এক ক্ষমতা রয়েছে। যে কারণে সে চাইলেই তা বিক্রি করতে পারে না। এই আংটির মাঝে একটি জীবন খুঁজে পায় গুলবাহার। বিক্রি করতে চাইলেই এ জীবন কাঁদে। প্রতিবাদ করে। কিছুতেই গুলবাহারের হাতছাড়া হতে চায় না এটি। অনেকবার স্বর্ণের দোকোনে আংটি ওজন করে দরদাম প্রায় ঠিক করার পরও তা বিক্রি করেনি গুলবাহার। অবশ্য এ আংটির কারণে এ পর্যন্ত অনেক ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে তাঁকে।
এইতো সেদিন মহল্লার এক বাসায় ভিক্ষা করার পরে বাসার এক রমণী তাকে খেতে দিলো। তখন দুপুর। বাসার কর্তাবাবু সবেমাত্র দুপুরের খাবারের জন্য বাসায় এসেছেন। গুলবাহার বাসার সদর দরজার একপাশে ইটের উপর বসে ভাত খাচ্ছিলো। মাংসের তরকারি আর ভাত একসাথে, একই প্লেটে দেওয়া হয়েছে তাকে। অনেকদিন পর মাংস দেখে জিহবায় জল আসে গুলবাহারের। খুশিতে আলতো একটা মিষ্টি হাসির আভা তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। খাবার প্রায় শেষ পর্যায়ে, ঠিক তখন একটা অন্যরকম গন্ধ পায় সে। গন্ধটা কোত্থেকে আসে তা বুঝতে বেশি সময় লাগে নি। গুলবাহার বুঝতে পারে বাসি মাংসের তরকারি দিয়ে তাকে খাওয়ানো হয়েছে।
এটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রায়ই এ রকম ঘটে। অভ্যস্ত হয়ে গেছে এইসব। প্রথম প্রথম বমি বমি ভাব করতো। এখন আর তা করে না। এখন একদম খাটি ভিক্ষুক সে। ভিক্ষুকদের আবার পঁচা-বাসি কী? যা পাবে তাই খাবে। একটু জোরে শব্দ করে ‘শুকুর আলহামদুল্লিলাহ’ বলে প্লেটটি ধুয়ে দেয় সে। ঘরের বাইরের ট্যাপ ছেড়ে পানি দিয়ে প্লেট ধোয়ার সময় তার ঝুলি থেকে পড়ে যায় আংটিটি। একটা শব্দ হয়। গুলবাহার বুঝতে পারলো এটি তার আংটি পড়ার শব্দ। কিন্তু কোথায় পড়লো, চোখে পড়ছে না। তার দু’চোখ বেশ দ্রুতগতিতে খুঁজতে থাকে। বিষয়টি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসার কর্তার দৃষ্টি এড়াতে পারে না।
এই বুড়ি কি খোঁজো?
আংডি।
চমকে উঠেন কর্তা। আংটি! কিসের আংটি, কার আংটি?
স্বর্ণের আংডি। আমার আংডি।
বেশ চটে যান কর্তা। দ্রুত ছুটে যান। দেখি কোথায়...
এনো পড়ছে।
এদিক-ওদিক দৃষ্টি মেলে তাকান কর্তা। তারপর গুলবাহারের দিকে। সন্দেহমূলক দৃষ্টিতে তাকান তিনি। বলেন, তুমি এটি কোথায় পেলে?
ততক্ষণে গুলবাহার ড্রেনের এপাশে পড়ে থাকা তার আংটি হাতে নিতে নিতে বলে, এইডা আমার স্বামীর দেয়া আংডি।
গুলবাহারের কথা শুনে মুখের ভাষা বদলে যায় কর্তার। বললেন, স্বামীর দেওয়া আংটি... না? সত্যি কথা বল, এটি কোত্থেকে চুরি করেছিস?
কথা শুনে চেঁচিয়ে ওঠে গুলবাহার। ফহির দেখলেই কি চোর মনে অয়? আমরা গরীব মানুষ। ভিক্ষা কইরা খাই, চুরি করি না।
এরকম কথাগুলো এই শ্রেণির লোকদের একদম মুখস্থ কথা। বাসার কর্তা তা ভালো করেই বোঝেন। তিনি বললেন, দাঁড়া তোকে পুলিশে দেবো। তখন ঠিকই বলবি কোত্থেকে চুরি করেছিস।
স্বামীর চিৎকার আর ভিক্ষুক মহিলার কান্নার শব্দ শুনে বাইরে বের হন ওই কর্তার স্ত্রী। নির্বাক তাকিয়ে থাকেন তিনি। বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে গুলবাহার তাকে আম্মা আম্মা বলে নালিশ করে।
স্বামীকে থামিয়ে দেন তিনি। বলেন, থামোতো তুমি। স্বর্ণের আংটি ওর থাকতেই পারে। মানুষ কি ভিক্ষুক হয়ে জন্মায় নাকি।
গুলবাহারকে তিনি যেতে বলেন। ওই দিন রাতে গুলবাহার বেশ কেঁদেছে। খেয়ে না খেয়ে আংটিটি রেখেছে সে। আর সেই আংটির জন্য আজ তাকে চোর বলে সন্দেহ করা হলো। এসব ভাবতে ভাবতে রাত বেশ গভীর হয়। শেষ রাতে ঘুম আসে গুলবাহারের। পরদিন সকালেই মনস্থির করে আংটিটি সে বিক্রি করে দেবে।
আংটি বিক্রির সিদ্ধান্তের পর থেকেই বিমর্ষ হয়ে গেছে গুলবাহার। যেন প্রাণহীন দেহ। আংটির উপর দৃষ্টি পড়লেই চোখে জল টলমল করে। এই আংটিটি যেন নীরবে গুলবাহারের সাথে কথা বলে। তাকে আবেগতাড়িত করে। সিদ্ধান্তনুসারে যথারীতি একটি জুয়েলার্সের দোকানে যায় সে। কিন্তু বিক্রি করা হয় না। আংটির এক অদৃশ্য ক্ষমতার কাছে হার মানে পেটের ক্ষুধা আর মিথ্যা অপবাদ।
কিন্তু এভাবে বেশি দিন যায়নি। সেলিনার নির্যাতিত মুখ। মেয়ের উপর তার জামাইয়ের বেদম প্রহারের খবর শুনে আংটিটি বিক্রি করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় গুলবাহার। দ্রুত ছুটে যায় সে অন্নদা বণিকের স্বর্ণের দোকানে। অভিজাত জুয়েলার্সে সুশ্রী রমণীদের ভীড়ে তাকে ভীষণ বেমানান লাগছিলো। তারপরও এগিয়ে যায়। আজ এটি বিক্রি করতেই হবে। চোখে ভাসে সেলিনার করুণ মুখ। আবার কখনো প্রিয়তম রমিজের মুখ।
অন্নদা প্রথমেই জানতে চাইলেন, কোথায় পেয়েছেন এটি?
থমকে যায় সে। এ আবার কেমন কথা। কতো মানুষইতো এরকম কতো স্বর্ণ-গহনা বিক্রি করে, তাদেরকে কি এভাবে জিজ্ঞাসা করা হয়? সবই কপাল! অকালে স্বামী মারা না গলে তার কি এই অবস্থা হতো। স্বামীর রোজগারতো ভালোই ছিলো। বেশ স্বাচ্ছন্দে ছিলো তাদের পরিবার। যাই হোক দোকানিকে সে বললো, এইডা অনেক দিন আগে আমার এক বিদেশী ভাইয়ে দিছিলো।
অন্নদা মাথা ঝাঁকিয়ে আংটিটি মাপতে মাপতে বললোন, দাম বেশি পাবে না। এইটায় স্বর্ণ বেশি নাই। দাম সাত হাজার টাকা।
অনেক টাকা। গুলবাহার ভেবেছিলো কতো আর হবে চার বা পাঁচ হাজার। কিন্তু আংটিটি বিক্রি করা হয়নি। রমিজের মায়া মায়া মুখ তাকে সিদ্ধান্তহীনতায় পৌঁছে দেয়। তখন কেন যেন বুকটা তার খালি খালি লাগছিলো। মনকে সান্ত্বনা দিতে ব্যর্থ হলো গুলবাহার। সে বাড়ি ফিরে যায়।
আংটির দিকে তাকালেই গুলবাহারের প্রিয়তম রমিজের কথা মনে আসে। গুলবাহারকে ভীষণ ভালোবাসতো রমিজ। একটি সিকিউরিটি কোম্পানিতে প্রহরী হিসেবে কাজ করতো সে। মাস শেষ হলেই চকচকে নতুন নোট। চার হাজার টাকা। বেশ ভালোভাবেই চলছিলো তাদের জীবন। তিন কন্যার কতো আবদার মেটাতে হতো রমিজকে। রমিজের সব স্যারেরাই ‘ম্যারিজ ডে’ পালন করে। এরকম দু’একটি অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়ে অফিসের স্টাফদের সাথে সেও গিয়েছিলো। কি মধুর দৃশ্য! স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে কেক মুখে তুলে খাওয়ায়। সাথে প্রিয় মানুষেরাও। সবার সাথে রমিজও সেদিন করতালি দিয়েছিলো। ভীষণ মজার।
এসব অনুষ্ঠানে রমিজের স্যারেরা তাদের স্ত্রীদের দামি-দামি গিফট প্রদান করে। রমিজ তা দেখে আর ভাবে সব শখ, সব সুখ, সব স্বপ্ন যেনো বড়লোকদের জন্য। রমিজ এ সুখ থেকে তার বউকে বঞ্চিত করতে চায় না। তাই ঈদ উপলক্ষে স্যারদের বখশিশ নিয়ে গুলবাহারের জন্য একটি স্বর্ণের আংটি ক্রয় করে রমিজ। রমিজের বিয়ের তারিখটা মনে নেই। গরীব মানুষের জন্ম, বিয়ের তারিখ সাধারণত মনে থাকে না। পেটের জ্বালায় সব ভুলে যায় তারা। তবে রমিজের এতটুকু মনে আছে শ্রাবণ মাসের এক শুক্রবারে বিয়ে হয়েছিলো রমিজ ও গুলবাহারের। গ্রামের এক মসজিদে কয়েকজন লোকের সামনে ইসলাম ধর্মের নিয়মে বিয়ে হয়েছিলো তাদের।
ভেবে ভেবে মাথার চুল না টেনে শ্রাবণ মাসের এক শুক্রবারের রাতে গুলবাহারকে ওই আংটিটি গিফট করে রমিজ। আহ! সে রাতে কী আনন্দ। গুলবাহারতো খুশিতে টলমল। মায়া মায়া হাসি দিয়ে বলেছিলো, এতো ট্যাকা তুমি খরচ করলা।
রমিজ বলেছিলো, হু করলাম। আমার সোনা বউয়ের লাইগা করুম নাতো কার লাইগা করুম। এইডা অইলো আমার ভালোবাসার একটা চিহ্নমাত্র। পারলেতো তোমারে আর কতো কিছুই দিতাম।
গুলবাহার মিটি মিটি হাসে।
এ হাসি আর বেশিদিন স্থায়ী হয় নি গুলবাহারের। হঠাৎ একদিন মাঝ রাতে দরজায় নক করে রমিজের সহকর্মী রহিম। কী হইছে? জানতে চায় গুলবাহার। রমিজের বুকে প্রচণ্ড ব্যথা। এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
বুকটা কেঁপে ওঠে গুলবাহারের। বড় মেয়েটাকে সাথে নিয়ে দ্রুত পা বাড়ায়। না। শেষ রক্ষা হয়নি। পথিমধ্যেই প্রচণ্ড ব্যথায় রমিজ চলে যায় না ফেরার দেশে। আকাশ-বাতাস যেন তখন স্তব্ধ গুলবাহারের কান্নায়।
এসবই এখন স্মৃতি। সূর্য তখন মাথার উপর তা দিচ্ছে। গুলবাহার আজ ভিক্ষে করতে যায়নি। মনটা ভালো নেই। আংটির জন্য। যে মেয়ের সুখের জন্য আংটি বিক্রি করবে তার জন্যও বুকের ভেতর চাপা একটা কষ্ট অনুভব করছে গুলবাহার। মনে হচ্ছে তাঁর মেয়ের কোনো বিপদ। এরইমধ্যে বাইরে থেকে পাশের বাড়ির মধু ডাকে... কী গো বুড়ি বাইতে আছোনি?
বাঁশ দিয়ে আটকানো টিনের দরজার খুলতে খুলতে গুলবাহার জানতে চায়, কী রে মধু ডাকলি ক্যা?
মধুর মুখে খবরটা শুনে থমকে যায় গুলবাহার। না। সে কাঁদে না। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে ভাসে সেলিনাকে পেটাচ্ছে তার স্বামী। সে ব্যবসা করবে। তাই গুলবাহারের বসত ভিটে বিক্রি করে টাকা নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলো। সেলিনা অসম্মতি জানায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বাকবিতণ্ডতার এক পর্যায়ে সেলিনাকে বেদম প্রহার করছিলো তার স্বামী। সেলিনা এখন হাসপাতালে। হঠাৎ যেন ভূকম্পের মতো পৃথিবী কাঁপায় গুলবাহার।
মাইয়ারে তুর সুখের লাইগা জান কুরবান দিয়াম। তুর বাপের দেয়া আংডি, এই বাড়ি সব বিক্রি কইরা দিয়াম...।
বাংলাদেশ সময় : ১৭১৬ ঘণ্টা, ১৩ জানুয়ারি ২০১৩
দ্য-টিকে, এনআরএ