ঢাকা: রাশভারী দেখতে হলেও মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন আহমদ সদালাপী। গুছিয়ে কথা বলেন, শ্রোতার মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা প্রখর। এমন মোহময় গুণের অধিকারী বলেই (ভোলা তিন আসন) টানা ছয়বার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপির পানিসম্পদ মন্ত্রী হিসেবে সুখ্যাতি কুড়িয়েছেন। হাফিজের এই রাজনৈতিক পরিচয় সবারই কমবেশি জানা। এর বাইরেও যে সুবিশাল এবং গৌরবান্বিত একটি জগৎ রয়েছে তাঁর, সেটা এই প্রজন্মের কাছে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। প্রচারবিমুখতা এবং রাজনীতির ডামাঢোলে হারিয়ে যেতে বসেছে হাফিজের সোনালী অতীত। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গৌরবময় ভূমিকার কথা মানুষ কমবেশি জানে। কিন্তু ফুটবলার হাফিজ কিঞ্চিত অপরিচিত।
বরিশালে বালক বেলা থেকেই ফুটবলে নাম করেছিলেন হাফিজ। খেলা ছিল তাঁর নেশা। বইপত্র রাখতে যে গতিতে বাড়ি যেতেন সেই একই গতিতে ফিরতেন স্কুলে ফুটবলের টানে। ক্লান্তিহীন সেই দিনগুলো এখনও হাফিজের স্মৃতিপটে আঁকা,‘আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখন খেলা বলতে ফুটবলই ছিল। ক্রিকেট খেলতো পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা। গজনবী নামে মোহামেডানের একজন ফুটবলার ছিলেন। তিনি বরিশালের মানুষ। জেলা লিগে তাঁকে খেলতে দেখতাম। তাঁকে পত্রিকায় এবং বাস্তবে দেখে খেলার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। স্বপ্ন দেখতে থাকি আমিও একদিন তাদের মতো খেলোয়াড় হবো।’
’৫০ এবং ’৬০ এর দশকে বরিশালের বিখ্যাত খেলোয়াড় গজনবী (আমির জং চৌধুরী) ছিলেন ফুটবলে হাফিজের আদর্শ। বাঙ্গালীর পাঠানখ্যাত এই ডিফেন্ডারকে দেখেই বড় হয়েছেন। একসময় বরিশালের হয়ে গজনবীর সাথে ফুটবলও খেলেছেন। স্বপ্নের নায়কের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন বড় হওয়ার।
১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিক, ’৬১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন হাফিজ। খেলাধুলার দুয়ার খুলে যায় সেই থেকে। প্রশস্ত হতে থাকে স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছানোর পথ। স্মৃতিচারণ করতে হাফিজের মনে পড়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো,‘১৯৬১ সালে অনার্সে ভর্তি হই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব খেলাধুলা হতো। আন্তঃবিভাগ ফুটবলে আমি প্রথম দুটো ম্যাচে হ্যাট্রিক করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে বরিশাল থেকে একটা ছেলে এসেছে যে শুধু গোল করে! ঢাকা লিগের কর্মকর্তাদের কানেও কথাটা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচ ছিলেন সাহেব আলী। তিনি আমাকে ফায়ারসার্ভিসে নিয়ে গেলেন। ’৬২ সালে ফায়ারসার্ভিস দিয়ে খেলা শুরু করলাম। ওয়ান্ডারার্সে খেললাম ’৬৬ সালে। এরপর স্বপ্নের ক্লাব মোহামেডানে। গজনবী ভাই তখন মোহামেডানের কর্মকর্তা। তিনিই আমাকে নিয়ে আসেন মোহামেডানে। ’৬৭ সালে মোহামেডানে ঢোকার পর আর কোনদিন জার্সি বদলাইনি। ১৯৭৮ সালে এই ক্লাব থেকে অবসর নিয়েছি।’
১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলেও খেলেছেন হাফিজ। ’৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলের অধিনায়কও ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাও তুলে ধরলেন প্রাণবন্ত করে,‘১৯৬৭ সালে পাকিস্তান দলে দু’জন বাঙ্গালী আমি এবং প্রতাপ (প্রতাপ শংকর হাজরা) সুযোগ পাই। সৌদি আরব ফুটবল দলের বিপক্ষে ঢাকায় খেলি। একই বছর নভেম্বরে একমাত্র বাঙ্গালী হিসেবে এশিয়ান কাপ খেলতে যাই রেঙ্গুনে। ইরানে (তিনবার) এবং তুরস্কেও খেলেছি।’
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসিক সব অভিযানের জন্য বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত হয়েছেন মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন। এত প্রাপ্তির পরও একটি অপূর্ণতা আজও কষ্ট দেয় তাঁকে। এই ৬৯ বছর বয়সেও ভুলতে পারেননি একটি ঘটনা,‘যে দেশ স্বাধীন করলাম। যুদ্ধে আহত হলাম। সেই দেশের হয়ে আমাকে খেলতে দেয়নি। পাকিস্তান দলে একজন বাঙ্গালী থাকলে আমি থাকতাম, অথচ বাংলাদেশে ১৮ জনে রাখা হয়নি। বাংলাদেশ দল মারদেকা কাপে খেলতে গেল আমাকে ছাড়া। ’৭০ এ পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব করেছি, পাকিস্তানের পতাকা বহন করেছি। ৭৩ সালে মোহামেডানের অধিনায়কত্ব করেছি, সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছি। এরপরও ক্যাম্পে ডাকেনি। কারণ আমার বাবা ডাঃ আজহার উদ্দিন আহমদ ’৭৩ সালে ভোলা তিন আসনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে জাসদ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তিনবারের সাংসদকে ওইবার নির্বাচন করতে দেওয়া তো হয়ই-নি । এমনকি আমাকেও জাতীয় দলে ফুটবল খেলতে দেয়নি। তখন ফুটবল দল বানাতো শেখ কামাল। সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলাম বলে বিবৃতি দেওয়াও সম্ভব ছিল না।’
মোহামেডানের এই স্ট্রাইকার লিগে প্রথম ডাবল হ্যাট্রিক করেন। ১৯৭৩ সালে ফায়ারসার্ভিসের বিপক্ষে ৬-০ গোলে জিতেছিল মোহামেডান। সবগুলো গোলই করেছিলেন তিনি।
অ্যাথলেট হিসেবেও হাফিজের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ১৯৬৪, ’৬৫ এবং ’৬৬ এই তিন মৌসুম পূর্ব পাকিস্তানের দ্রুততম মানব ছিলেন। ১০০ ও ২০০ মিটারে রেকর্ড টাইমিংয়ে স্বর্ণ পদক জেতেন।
বাংলাদেশ সময়: ০১০৩ ঘণ্টা, ৪ এপ্রিল ২০১৩
এসএ/এএইচবি