
ঢাকা: ফুটবলে বিশাল এক ঐহিত্য নওশেরদের। সাত ভাইয়ের পাঁচজনই খেলেছেন ঢাকা লিগে। দুই ভাই জাতীয় দলের ফুটবলার। এমন ক্রীড়ানুরাগী পরিবার দেশের জন্য গর্বেরও।
চাঁদপুর মতলব থানার বদপুর ওসমান পরিবারের অহংকার এ.কে.এম নওশেরুজ্জামান ফুটবল খেলে যথেষ্ট সুখ্যাতি পেয়েছেন। ’৬০ ও ’৭০ এর দশকের ফুটবল দর্শকদের দৃষ্টিতে নওশের একজন দক্ষ ফরোয়ার্ড, যিনি গোল করায় দারুণ পারদর্শী। ক্রিকেট তাঁর ধ্যানজ্ঞান হলেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ফুটবলে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করেছে ব্লু দিয়ে। এটাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হিসেবেই দেখেন নওশের,‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্লু পেয়েছি, এরচেয়ে সম্মানের কী আছে। ফুটবল খেলে এরচেয়ে ভালো কিছু পাইনি জীবনে।’পূর্বপুরুষের ঠিকানা চাঁদপুরে হলেও মুন্সিগঞ্জে বড় হয়েছেন নওশের। এডভোকেট মো. জুলফিকার আলীর চতুর্থ সন্তান ছোট বেলায় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। মুন্সিগঞ্জ হাই-স্কুল ক্রিকেট দলের প্রাণ হয়ে উঠলেও জাতীয় পর্যায়ে ক্রিকেটার পরিচয় সেভাবে ফোটেনি নওশেরের। যদিও প্রথম জীবনে ক্রিকেটার হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন,‘ফুটবলার হব কোনোদিন চিন্তাও করিনি। ক্রিকেটার হব এটাই ছিল লক্ষ্য। ক্রিকেটে জাতীয় দলে খেলার মতো সামর্থ্য ছিল। কিন্তু ক্রিকেট কর্মকর্তারা ফুটবলার হওয়াতে পাত্তাই দিত না। তারা বলতো নওশের ফুটবলার। অথচ আমি ১৭ বছর প্রথম বিভাগে ক্রিকেট খেলেছি। রেকর্ড আছে ঢাকা মাঠে। রকিবুলের সঙ্গে ওপেন করতে নেমে শেষপর্যন্ত অপরাজিত থেকে ৬৯ রান করেছি। ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে বহু ম্যাচ আমি জিতিয়েছি। মোহামেডানের হয়ে আমি ফুটবল এবং ক্রিকেটে লিগ শিরোপা জিতেছি।’
১৯৬৬ সালে পূর্ব-পাকিস্তান যুব দলে সুযোগ পাওয়ার পর থেকে ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান নওশের। রেলওয়ে, ওয়ারী, ফায়ারসার্ভিস, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ওয়াপদা, মোহামেডান স্পোর্টিং ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে দাপটের সাথে খেলেছেন। ১৯৭৩ থেকে ’৭৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন জাতীয় দলের স্ট্রাইকার। সালাউদ্দিন, এনায়েত ছিলেন জাতীয় দলের সঙ্গী। ১৯৭৫ সালে রেকর্ড ২২ গোল করেছিলেন মোহামেডানের এ স্ট্রাইকার। মোহামেডানে খেলাটাই ছিল তাঁর জীবনের স্বপ্ন,‘নিঃসন্দেহে মোহামেডান ক্লাবে খেলা উপভোগ করেছি। পাকিস্তান আমলে এই দলে কী সব খেলোয়াড় খেলেছে, তোরাব আলী, আলী নেওয়াজ, আব্দুল্লাহ রাহি, মুসা, আব্দুল গফুর, কাদের বক্স এসব নামকরা পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা খেলেছে। সেই দলে খেলতে পেরে সত্যিই গর্বিত হয়েছি।’স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়ও ছিলেন নওশের। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং তহবিল গড়ে তোলার লক্ষ্যে ফুটবল খেলে স্বীকৃতি পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। অনেক প্রাপ্তির মাঝেও কিছু অপূর্ণতা রয়ে গেছে তাঁর জীবনে। এখনও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাননি। একবার পেতে পেতেও গলায় উঠেনি পদক। আক্ষেপ করছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের নীতিনির্ধারকদের বিমাতাসুলভ আচরণ দেখে,‘মাঝে মাঝে অবাক হই, পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো ফুটবল দল স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে আমরা যেটা করেছি সেই দলটাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিকভাবে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। একবার আমার জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার কথা, কিন্তু একদিনের ব্যবধানে দেখি নাম নেই। সত্যিই বিস্ময়কর এদেশের নিয়মনীতি।’
কিছু প্রশ্নের উত্তর এভাবে দিয়েছেন নওশেরুজ্জামান:
প্রশ্ন: আপনাদের সময়ে মাঠে দর্শক আসতো, এখন কেন ফুটবল প্রাণহীন?
নওশের: তখন ফুটবলে ব্যক্তিগত নৈপূণ্য ছিল। যেটা এখন নেই, যেজন্য খেলা ভালো লাগে না। এমনও দেখা গেছে একদিন এনায়েত ভালো খেলছে না কিন্তু বাকিরা তার ঘাটতি পুষিয়ে দিচ্ছে। এখন খেলায় কোনো মান নেই।
প্রশ্ন: এনায়েত এবং সালাউদ্দিনের সঙ্গে আপনি জাতীয় দলে খেলেছেন। এই দুজনের মধ্যে কার খেলা আপনার ভালো লেগেছে?
নওশের: সালাউদ্দিন স্টাইলিশ, এনায়েত স্কিল প্লেয়ার। দুজনের খেলায় ভিন্নতা রয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এনায়েত অনেক বড় ফুটবলার।
প্রশ্ন: স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যোগ দেওয়ার ঘটনা বলবেন?নওশের: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ঘোষণা শুনে মে মাসে আগরতলা যাই। সেখানে ফুটবল খেলেছি। এরপর কলকাতায় গেলাম। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল হলো। বিভিন্ন জায়গায় খেললাম।
প্রশ্ন: এককালের তারকাকে এখন কেউ চেনে না, এটা ভাবলে কেমন লাগে?
নওশের: যারা চেনে এখনও তারা সম্মান করে। সেজন্য গর্ববোধ করি। এখন বয়স হয়ে গেছে নতুন প্রজন্ম আমাদের চিনবে না এটাই স্বাভাবিক। অনেক খেলোয়াড়ও আছে যারা আমাদের সম্পর্কে জানে না। প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোনো ছবিই হয়তো ফেডারেশনে নেই। সেটা থাকা দরকার ছিল না। খেলোয়াড়রা আমাদের কী করে চিনবে, যেদেশে পূর্বসুরীদের নামধাম কিছু থাকে না।
প্রশ্ন: আপনি তো প্রাণীবিদ্যা বিভাগে পড়তেন, সেখানেও খেলাধুলা হতো?
নওশের: হতো মানে। তখন খেলাধুলাই ছিল প্রাণ। খেলোয়াড়রা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরো। বিভাগে তাদের কদরই ছিল আলাদা রকম।
প্রশ্ন: ছোট ভাই এ.কে.এম শরীফুজ্জামানের সঙ্গে খেলতে কেমল লাগতো?
নওশের: খুবই ভালো লাগতো। ও বুঝতে পারতো আমি কোথায় বল চাই। খুবই ভালো লিঙ্ক ম্যান ছিল। আমার দেখা সেরা। জাতীয় দল এবং মোহামেডানে একসাথে খেলেছি আমরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৬ ঘণ্টা, ১৭ এপ্রিল ২০১৩
এসএ/এফএইচএম