দক্ষিণ বাংলার লোকসংস্কৃতি বা লোকঐতিহ্য

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৬:৪৬, মে ১৫, ২০১৩

লোক গর্ভজাত যে অজানা কাহিনী, কিংবদন্তি, লোককথা, উপকথা, রূপকথা, ধর্মকথা- যা লুক্কায়িত থাকে আলোর নিচে তা লোকায়িত সংস্কৃতি বা লোক ঐতিহ্য। এসব ঐতিহ্য মূলত লালিত পালিত হয় অঞ্চল বিশেষের অপজাত বা নিম্নবর্ণের মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কার দ্বারা। সভ্য ও শিক্ষিত মানুষের কাছে এইসব ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি কিছুটা অবজ্ঞেয় ও হাস্যকর। অথচ যে কোনো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি- এইসব কাহিনী, কিংবদন্তি ধর্মকথাকে উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ হতে পারে না। “সমগ্র জাতির ইতিহাস সমগ্র আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যকে নিয়েই সম্পূর্ণ। এ উপলব্ধি শুধু আমাদের দেশের নয়, পাশ্চাত্যীয়রাও উপলব্ধি করেছেন দেশের সংস্কৃতির ভিত্তি বা আদিনিকেতন লোকসংস্কৃতির মধ্যেই দেখা যাবে এবং দেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও।”১ প্রকৃত জনসমাজেরও যে ইতিহাস আছে, শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্ম-কর্ম আনন্দ-উৎসব আছে, সংস্কার-সংগীত আছে- যাকে রবীন্দ্রনাথ বলছেন,-“দেশের লোকসংস্কৃতির মধ্যে অতীত যুগের সংস্কৃতির এমন বহু নিদর্শনাদি সংগুপ্ত আছে যেগুলো আমাদের জাতির পুর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপকরণ হতে পারে।” অঞ্চল বিশেষের এই লোকায়ত ধারাগুলোর মিলিত প্রবাহেই সমুজ্জ্বল আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য।

বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। বিশেষত ধর্ম ও প্রেম বিষয়ে তার আবেগ আপোষহীনভাবে  শত উৎসারিত। তান্ত্রিক ও ধর্ম প্রভাবিত উত্তরবঙ্গের ‘মালঞ্চমালা’, ‘শংখমালা’, ‘কাঞ্চনমালা’, ‘পুষ্পমালা’ সহ ময়মনসিংহ গীতিকাগুলো তার উজ্জ্বল নিদর্শন। অনুরূপভাবে দক্ষিণবঙ্গেও রয়েছে লোকজীবনাশ্রিত সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল ঐতিহ্য - যার ইতিহাস প্রাগৈতিহাসিক যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। “প্রাকৃতিক ভৌগোলিক বিপর্যয়ে এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ভূগোল বারবার হয়েছে বিপর্যস্ত। নদীনালা ও অরণ্যের পটভূমিকায় এই অঞ্চলের জনজাতির ও জীবন ধারার যে বিশিষ্ট বিকাশ ও বিবর্তন ঘটেছে ইতিহাসের ধারায় তার বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক উপকরণের স্তরায়ণ প্রত্যক্ষ করা যায় ঐতিহ্য বাহিত লোকসংস্কৃতির প্রবাহে।”২ এই অঞ্চলের লৌকিক দেব-দেবী, পীর-মুর্শিদসহ লোকায়ত পালা-পাঁচালী-গীতিকা-আখ্যান-উপকথার রয়েছে এক বিশাল ঐতিহ্য। এর সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে শীতলা, লক্ষ্মী, নারায়ণী, মনসা, চণ্ডী, দুর্গা, ষষ্ঠী, বিশলাক্ষী, সন্তোষীমা ইত্যাদি দেবী পালায়; দক্ষিণরায়, চাষী মহাদেব, ধর্মঠাকুর, পঞ্চানন্দ, বসন্তরায়, বেনাকী, শনি ইত্যাদি দেব পালায়; বনবিবি, সাতবিবি, দরবারবিবি, ওলাবিবি, নয়বিবি, আসানবিবি, আওরজবিবি ইত্যাদি বিবিপালায় এবং মানিকপীর, মাদারপীর, বড়খাঁ গাজী, হযরত জাবের, বড় পীর সাহেব, পীরগোরাচাঁদ, দেওয়ান গাজী, সত্যপীর, মোবারক গাজী, রক্তানগাজী ইত্যাদি পীর ও গাজী পালায়। হিন্দু-মুসলমান মিলিত ধারার এইসব পালা-পাঁচালীর মধ্যে লুকিয়ে আছে দক্ষিণ বাংলার লোকায়ত ধারার এক অসম্প্রদায়িক ঐতিহ্য। যমুনা, ইছামতি, কালিন্দী, রায়মঙ্গল পরিবেশিষ্টত এবং সুন্দরবন বা ব্যাঘ্রতট খ্যাত এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলটি তাই সমগ্র বাংলার লোক ঐতিহ্যের এক উন্নত আলয়। যার লোককৃতি, লোকায়তকৃতি বাংলার লোক ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির রূপায়ব।

[দুই]

দক্ষিণ বাংলা বলতে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষত খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা জেলা ও সুন্দরবন কেন্দ্রিক মানুষের যে লোকজীবন তার লোকঐতিহ্য তুলে ধরাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য । এই অঞ্চলটি এক সময় যশোর, যশোহর বা যশোরেশ্বরীপুরী নামে পরিচিত ছিল। এটি যে গৌড় বঙ্গের একটি প্রসিদ্ধ অঞ্চল ছিলো তন্ত্রচূড়ামনি, কবিরামকৃত ‘দিগি¦জয়প্রকাশ’, ‘ভষ্যিপুরাণ’, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে তার প্রমাণ মেলে। মোটামুটি এর প্রাচীনত্ব মুসলমান অধিকারের পূর্ব থেকেই বর্তমান। বিক্রমাদিত্য, প্রতাপাদিত্য, বসন্তরায়, মানসিংহ, রাজা মনোহর রায়, মুড়লী (১৭৭২) সাহেবের প্রভাবে ও ঐশ্বর্যে অঞ্চলটির ইতিহাস রীতিমত সমৃদ্ধ। খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা নামের উৎপত্তির নানা কিংবদন্তি থাকলেও ইংরেজ আমল থেকে এই নামের প্রচলন হয়। অনুরূপভাবে চন্দ্রদ্বীপ, চন্দ্রদ্বীপবন যেখান থেকেই সুন্দরবন নামের উৎপত্তি হোক না কেন সুন্দরবন নামটি আধুনিক কালের সৃষ্টি। তবে “সুন্দরবন চিরকাল আছে। ......... গঙ্গানীতা পলিমাটি ও সুমিষ্ট জলের সহিত সমুদ্রের সর্বশান্ত জলের সংযোগে কতকগুলি বিশেষ বিশেষ বৃক্ষগুল্মোর সমুদ্ভব হয়। উহাই সুন্দরবনের বিশেষত্ব।”৩ সুন্দরবনের অনেক বিশেষত্ব। এর গভীর গম্ভীর জঙ্গল, অতলস্পর্শী অবনমন, সমুদ্রের অবিরাম শব্দ, ভয়ংকর বাঘ ও সরীসৃপের আতংক, হরিণ ও পাখ-পাখালির সৌন্দর্য, ঝড় জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডব, দুর্গমতার কারণে মগ ফিরিঙ্গিদের অত্যাচার চোর-ডাকাতের উপদ্রব, শিকারীর উৎপাত, বাউয়াল-মৌয়াল মৎস্যজীবীদের উপদ্রুত জীবন, মুনি-ঋষি-দরবেশদের ধ্যানের আলয়, অপদেবতাদের আবাস - সব মিলে সুন্দরবন এক রহস্যপুরি এবং বিপজ্জনক স্থান। “সুন্দরবন এক মন্ত্র-তন্ত্রময় রাজ্য। কাষ্ঠদেবতা, বনদেবতা, বনবিবি এ দেশের রাজ্যেস্বরী; গাজী কালুর কথা, চম্পাবতীর কথা, পাঁচপীরের কথা, এমন কত উপকথায় যে ঐ অঞ্চলের ইতিকথা বিষমভাবে বিজড়িত, তাহা বলিবার নহে।”৪ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, ‘ইছামতী’, ‘সুন্দরবন’ গ্রন্থে সমাচ্ছন্ন হয়ে আছে এই অঞ্চলের প্রকৃতি পুরাণ ও লোকঐতিহ্য। এছাড়া ঐতিহাসিক W.W.Hunter এর District Bagetieer Khulna সহ নিকট অতীতে আ.ফ.ম আব্দুল জলিল, মীর আমীর আলী, মোঃ নুরুল ইসলাম, তোহা খানের লেখায় উজ্জ্বল হয়ে আছে দক্ষিণ বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
 
ঐতিহ্য হচ্ছে পরম্পরাগত কথা, পুরুষাণুক্রমিক ধারা, ঐতিহাসিক কথা, কিংবদন্তি, বিশ্রুতি বা লোকপ্রসিদ্ধি। অর্থাৎ সনাতন মূল্যবোধ বা ঐতিহ্যের অনুসরণ ও মূল্যায়ন যে কোনো জাতির অগ্রগতির জন্য জরুরি। টি.এস. এলিয়ট তার অনন্য উদহরণ। তাঁর `Tradition and the individual Talent প্রবন্ধে বলেন “অতীত নয় নিষ্প্রাণ, নির্জীব ও মূল্যহীন। অতীত বেঁচে থাকে বর্তমানে- আর বর্তমান তার কার্যক্রম নির্ধারিত করে অতীতের পাটাতনে। অতীতের কাছে আমরা যেমন ঋণী তেমনি অতীত ও ঋণী বর্তমানের কাছে। ......... অতীতকে ভালোবাসার অর্থ অতীতের প্রতি অহেতুক অনুরাগ নয় কিংবা নয় কোনো অতীতকে আঁকড়ে ধরে রাখার অপচেষ্টা। অতীত কথা বলে বর্তমানে-বর্তমান সে কথা আবার অতীতের সঞ্চয়ের থলিতে জমা রাখে। সে অর্থে “ঐতিহ্যবোধ বলতে অনাবশ্যকভাবে শুধু অতীতমুখিনতাকে বোঝায় না। দৃষ্টির সম্প্রসারণ, বিশ্লেষণ ক্ষমতার ব্যাপকতা ও অভিজ্ঞতার গভীরতাকেই এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া বোঝায়।”৫

আধুনিক যুগে এসে আমাদের সব লোকঐতিহ্যের ইতিহাস হারাতে বসেছে নানান রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িকতার কারণে। অথচ কোনো নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টিতেও আমরা সফল হতে পারিনি। বোদলেয়ার কি তাই বললেন “It is true that the great tradition is over, and the new tradition is not found.” অতএব ঐতিহ্যের মধ্যেই আমাদের জ্ঞান, অনুভূতি, উপলদ্ধি ও অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত ও উৎসারিত। ঐতিহ্যের মৃণাল ধরেই বিকশিত হয় সমাজ মানসের চৈতন্য। আমাদের পূর্বপুরুষের সমাজে অধিবাস ছিলো, যে ধরনের জীব-জীবিকা ছিলো, বিশ্বাস ও ধর্মবোধ ছিলো, স্বপ্ন ও কল্পনা ছিলো তা মুখর হয়ে আছে তাদের সৃষ্ট কর্ম ও কৃতির মধ্যে। যা একান্ত লৌকিক জীবনের স্মারক। যার সাথে ব্রাক্ষণ্যবাদী বা অভিজাতবাদী সমাজের আকাক্সক্ষা ও আদর্শের অমিল লক্ষ্যণীয়। অর্থাৎ “ব্রাক্ষণ্য আদর্শের বিরুদ্ধে লৌকিক আদর্শের সংঘাত, ব্রাক্ষণ্য জীবনাদর্শের সঙ্গে লৌকিক জীবন-দর্শনের সংঘাত”–৬ এ গড়ে উঠেছে লোকসংস্কৃতি ও লোকঐতিহ্য। দক্ষিণ বাংলার সেই হারামণি গুলোই আমাদের আলোচ্য বিষয়।

[তিন]

বর্ণিত এই অঞ্চল ভাটির দেশ বা প্রাচীনকালে বৃদ্ধদ্বীপ বা বুড়ন নামে পরিচিত ছিলো। যা যশোরের দক্ষিণ ভাগ, খুলনা, সাতক্ষীরা ও সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত এবং মিশ্রকারিকা অনুযায়ী বাগেরহাট চন্দ্রদ্বীপ অধিকৃত ছিল। সুতরাং এই অঞ্চলের প্রাচীনত্ব দেববংশ পুঁথি, মহাবংশাবলী, গৌড়ের ইতিহাস, ভবিষ্যব্রহ্মখণ্ড, বাঙ্গলার পুরাবৃত্ত ইত্যাদি গ্রন্থে নানা প্রমাণে বর্ণিত। চন্দ্রদ্বীপ, বুড়ন প্রাচীন কালে জলমগ্ন থাকতো। কথিত আছে ভবিষ্যব্রক্ষখন্ড, ১২। ২- শি মি) মহাদেবের ললাটাগ্নিতে সেই জল শুষ্ক হলে ঐ দ্বীপের উদ্ভব হয়। অতএব “যে দেশ দ্বীপাকারে জল হইতে উত্থিত হয় এবং যে দেশের চর্তুদিকে নদী, খাল পরিবেষ্টিত থাকে, সে দেশে যথেষ্ঠ পরিমাণে মৎস্য পাওয়া যায় ........ সে কারণে ৬০। ৭০ খানি মৎস্যনামীয়, গ্রাম আছে।”৭ নদীবাহিত সমৃদ্ধির কারণে এখানে প্রতাপাদিত্য, সীতারাম, খাঁনজাহান আলী, সত্রাজিৎ, বা মুকুট রায়ের রাজ্য ক্রীড়াক্ষেত্র, গড়, সমাজকেন্দ্র, সাধকের লীলাক্ষেত্র, বিদ্বানের লীলাস্থল গড়ে  ওঠে।  ফলে এই অঞ্চল যেমন ‘মনসার ভাসান’ প্রচলিত তেমনি ‘গাজীর গীত’, ‘গাজীকালু ও চম্পাবতী’র গীত, বনবিবির পালা, দক্ষিণরায়ের পালা, মানিকপীরের পালা ইত্যাদি লৌকিক দেব-দেবী, পীর ও গাজীর ঐতিহ্য সমগ্র দক্ষিণ বাংলার সম্পদ। এইসব কাহিনী, কিংবদন্তি, পালার মধ্যে লুকিয়ে আছে এই অঞ্চলের, মানুষের জীবন-জীবিকা, সংগ্রাম বিশ্বাসের বহু যান্ত্রিক জীবনাচার। সর্পভীতি থেকে বাঁচার জন্য লোকায়ত সমাজে মনসাপূজার সৃষ্টি, মানিকপীরের বন্দনা করা হয় গো সম্পদ রক্ষা করার জন্য, দক্ষিণ রায় পূজিত হয় বাঘের আক্রমণ থেকে রেহাই পাবার জন্য, বনবিবি পূজিত হয় হিংস্র শ্বাপদ-সঙ্কুল পরিস্থিতি যেকে ভক্তরা যেন রক্ষা পায় সে জন্য, গাজীকে স্মরণ করা হয় নৌকা যাত্রাকালে ঝড়-তরঙ্গের বিপদ থেকে রক্ষার জন্য। লৌকিক জীবনাচারে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এসব পীর দেবতার ভক্তি অর্চনা করা হয় যাপিত জীবনের প্রয়োজনে। এরা এই অঞ্চলের মিশ্র সংস্কৃতির প্রতীক। এছাড়াও শীলতা, ওলাবিবি, সত্যপীর এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রচনা করেছে এক সম্প্রীতির বন্ধন। আরো আছে ‘মাকাল ঠাকুর’ যিনি মৎস্যজীবীদের উপাস্য লৌকিক দেবতা। সুন্দরবন অঞ্চলের লৌকিক দুই দেবী ‘নারায়ণী’ ও ‘জহুরা বিবি’ যুদ্ধ ও শান্তির প্রতীক হিশেবে পূজিত হয় । বসন্ত ব্যাধির ত্রাতা হিশেবে প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাত ‘বসন্ত রায়’ পূজিত হন। ইনি আবার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিশেবে খ্যাত। এই অঞ্চলের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, জীবন নির্বাহের সংগ্রাম, সম্প্রদায়ের শাসনকে চূর্ণ করে যুগ যুগ ধরে যে মেলবন্ধনের ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল তার অনেকটাই আজও এখানকার সমাজে বহবান।

সব জাতিই বহন করে তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। একটি অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মভাব, আচার-উৎসব, শিল্প চেতনাকে কেন্দ্র করে যে জীবনছন্দ গড়ে ওঠে তা সেই অঞ্চলের যুগধর্মেরই কর্মময় অভিব্যক্তি। পল্লী নির্ভর মানুষের যে লোকসংস্কৃতি ও লোকঐতিহ্য তাই রূপান্তরিত হয়ে প্রাণ সঞ্চার করে নগর সংস্কৃতিকে। কারণ নগর সংস্কৃতি এসেছে পল্লী সংস্কৃতির অনেক পরে। পল্লীতে বা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পৌরাণিক সংস্কৃতি ও সুফি সংস্কৃতি একদিন যে লোকঐতিহ্যের ভিত্তি গড়ে তুলেছিল তাই বাঙালি জাতির চিত্তের প্রতিবিম্ব ও  আত্ম পরিচয়। দক্ষিণ বাংলায় রয়েছে তার স্বতন্ত্র ঐতিহ্য। ইছামতি, কালিন্দী, কপোতাক্ষ, যমুনা, রূপসা, বেতনা, খোলপেটুয়া, আড় পাঙ্গানিয়া, মালঞ্চ, শিবসা, ভৈরব, পশুর, রায়মঙ্গল ও বঙ্গোপসাগর বিধৌত এই অঞ্চল যেমন দুর্গম তেমন তমালকদম্বপরিশোভিত, কোকিল-কূজন-মুখরিত। এই সব জলাধার ও জঙ্গল, বিল-ঝিল, খাল, হাওড় ও সমতলের সমন্বয়ে যে জীবন ধারার বিকাশ তা যেমন সুখকর তেমনি দূর্গতিপূর্ণ। তাই এখানে শোনা যায় সুখ-দুঃখের গান, রোগ-শোকের পাঁচালী, জীবন সংগ্রামের অষ্টক। মাছের গল্প, ভূতের গল্প, বন-বাদাড়ের গল্প, পাখ-পাখালির গল্প, শিকারের গল্প, নদী-নৌকা-জালের গল্প, ধূ ধূ বিলের আলেয়ার গল্প, তাল-তেতুল-শ্যাওড়া বটগাছে থাকা শঙ্খিনীর গল্প, নদীর দেও- দানবের গল্প এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ধারার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ফলে অলৌকিক বিশ্বাস ও সংস্কার এর অধিবাসীদের রক্তমূলে প্রোথিত। প্রতি বছর ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ক্ষরা ঘুর্ণিঝড় বা অতি বর্ষণে এখানকার মানুষের দুর্গতি লেগেই থাকে। আর নদীতে বিপদ, জঙ্গলে বিপদতো আছেই। এই সব দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবিলা করতেই তারা একদিন গড়ে তুলেছিল বদরপীর, গাজী, বনবিবি, দক্ষিণ রায়, মানিক পীর, মনসা, ওলাবিবি দেব-দেবীর কিংবদন্তি। এই সব উপাখ্যান তাদের জীবন বাস্তবতারই এক অšর্গত সংস্কৃতি। যার বহু মান আখড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোরের দক্ষিণে ও সুন্দরবনে। মোট কথা ধর্মীয় ভাবের মধ্য দিয়ে ও অলৌকিক বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এই সকল মানুষের যাবতীয় আচার-উৎসব, গীত, গল্প ও সামাজিক চেতনার ঐতিহ্য।

[চার]

মানুষের ইচ্ছা প্রকাশের আদি যে প্রবৃত্তি তা প্রকাশিত হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। সাহিত্য-শিল্প-সংগীত-নাটক-স্থাপত্য-ভাষ্কর্য-খেলাধুলা- পুঁথি-পাঁচালী ইত্যাদি মাধ্যমে লোকজীবনের গর্ভ থেকে তার প্রকাশ ও প্রসার ঘটে। অঞ্চল বিশেষের প্রকৃতি ও মানুষের বাস্তবতায় তার যে রূপ ধারণ করে সেটাই সেই অঞ্চলের লোকঐতিহ্য। ধর্ম প্রধান রূপক আখ্যান, প্রেম আখ্যান, প্রণয় ও বিবাহ রীতি, পূজা, অর্চনা, স্থানীয় সংগীত যেমন পল্লীগীতি, জারী সারী, ভাটিয়ালী, পালকির গান, পুঁথিপাঠ, পটগান, যাত্রাপালা, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র, ভাবগান, ধাঁ ধাঁ, বীরত্ব গাথা সহযোগে গড়ে ওঠে সেই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি। সেই  সংস্কৃতি “হাজার বৎসর ধরিয়া চলিয়া আসিয়াছে, ক্রমশ নানা দিক বিকশিত হইয়াছে। সেই পল্লী প্রধান বাঙালী সংস্কৃতি আমাদের অত্যন্ত পরিচিত। এখনো তাহা লুপ্ত হয় নাই। কিন্তু অত্যন্ত পরিচিত বলিয়াই আমরা তাহার সহজ ও অনাড়ম্বর উপকরণ ও উপাদনাকে আমাদের সংস্কৃতি প্রধান অবলম্বন বলিয়া ভাবিতে কুন্ঠিত হই।”৮ অথচ এই সংস্কৃতিই আমাদের ঐতিহ্য। এই অঞ্চলের গৃহ নির্মাণ পদ্ধতি থেকে শুরু করে কাঠের কাজ, পোড়ামাটির কাজ, নকশিকাঁথা, পট, দেবমূর্তি গড়ন, পিঠা-পায়েস, শাঁখারির কাজ, তাঁতশিল্প, খাওয়া-দাওয়ার রীতি, কুটুম্বিতা, বিভিন্ন প্রকাশ উৎসব- যেমন দোল, রাস, পহেলা বৈশাখ, নবান্ন, মেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, জামাই ষষ্ঠী, অন্নপ্রাশন, নৌকা বাইচ, ঘোড়দৌড়, পূজা, মহরম, ঈদ ইত্যাদির একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে এ অঞ্চলে। যার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় তাদের চেতনার রঙ। গাদোন, বুড়ি চু, লাঠি খেলা, দাঁড়িয়া বান্ধা এখানকার প্রধান লৌকিক খেলা। ভাবগান, জারীগান, কীর্তন, পটগান, সারী গান এখানকার প্রধান লোকগান। পুঁথি পাঠের আসর জমে মূলত কাসাসুল আম্বিয়া, শহীদ কারবালা, গাজী কালু চম্পাবতী, সোনাভান, জয়গুন বিবি, খয়রুল হাসর, ইউসুফ জুলেখা, লায়লী মজনু কেন্দ্র করে।‘ভাসান’ এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় পালা। অষ্টক গানও এই অঞ্চলে খুব প্রচলিত। লক্ষ মানুষের সমাগমে সুন্দরবনের দুবলার চরে কার্তিকের রাসপূর্ণিমায় সবচেয়ে বড় মেলা বসে। এই রাসমেলায় আসা নিয়েই বিভূতিভুষণের ‘সুন্দরবন’ ভ্রমণ কাহিনীর সৃষ্টি। এই বুড়নেই বিখ্যাত পবন হরিদাসের জন্ম।

দক্ষিণ বাংলা যত দুর্গম ও অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চল হোক না কেন মূলত মধ্যযুগ থেকে অঞ্চলটি উঠে আসে ইতিহাসের প্রচ্ছদে, আলোর পাদপ্রদীপে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি যাদের পদচারণায় মুখর ও আলোকিত হতে শুরু করে তারা হলেন ইতিহাস খ্যাত খান জাহান আলী, প্রতাপাদিত্য, বসন্ত রায়, সংগ্রামাদিত্য, ইসলাম খাঁ, মানসিংহ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ্, সতীশচন্দ্র মিত্র, কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, প্রাণনাথ রায় চৌধুরী, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, শেখ লুৎফর রহমান, সিকানদার আবু জাফর, কাজী ইমাদদুল হক, এ.এফ.এম. আব্দুল জলিল, ঝরাফুলের কবি এবাদুল্লা, বিশ্বখ্যাত বাঘ শিকারী পচাব্দী গাজী তার অন্যতম। এদের উত্তরাধিকার লাভ করে দক্ষিণ বাংলা প্রবাহমান।
 
সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন স্থাপত্য কলা। দক্ষিণ বাংলায় রয়েছে তার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এই ধারার নিদর্শন অব্যাহত। তবে এসব নিদর্শনের অধিকাংশই ধর্মভাবে অভিব্যক্ত। যা এই অঞ্চলের মানুষের চিন্তা-চেতনা ও ভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। সাজ-সজ্জায় সুশোভিত বাস্তুশিল্পের অন্যতম নিদর্শন সাতক্ষীরার দশ আনা ও ছয় আনার জমিদার বাড়ি, নলতার ভঞ্জরায় চৌধুরীদের বাড়ি, কাটুনিয়ার রাজবাড়ি, খাঁজাহান আলীর আবাস গৃহ, ঈশ্বরী পুরের রাজবাড়ি, খুলনার শিববাড়ি, ডিহির রবীন্দ্রনাথের শ্বশুর বাড়ি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। “মানব সভ্যতার প্রথম সোপান বাস্তু রচনা, গৃহ নির্মাণ কৌশল অধিগত করিয়াই মানব সমাজ নানাবিধ ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতি লাভের অধিকারী হইয়াছে।”৯ দক্ষিণ বাংলায় এইসব গৃহ নির্মাণ কৌশলকে অবলম্বন করে এই ঐতিহ্য অনুযায়ী গৃহ-শিল্প গড়ে ওঠে। যার প্রচুর নিদর্শন রয়েছে এই অঞ্চলে। বিশেষত সাতক্ষীরার লাবসা, নলতা, শ্যামনগর, তালার কাজী বাড়ি, আশাশুনির সরদার বাড়ি, দেবহাটার সরদার বাড়ি, জলসার সবুর সাহেবের বাড়ি, জেলা স্কুল, বাগেরহাটের পি.সি কলেজ, আলি ফাত-ই আবাদের বেগমের গৃহ নির্মাণে এই চিহ্ন বহমান।

এ অঞ্চলের স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শনগুলো যেকোন অঞ্চলের স্থাপত্যের তুলনায় স্মরণীয়। যা এই অঞ্চলের লোক সমাজের ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ভাব ব্যঞ্জনায় ভাস্বর। এসব স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য নির্দশনগুলো হলো বাগেরহাটের শিববাড়ির বুদ্ধমূর্তি, যশোরেশ্বরী দেবীর পীঠমূর্তি, বলভান্ডার গনেশমূর্তি, কাটুনিয়ার মন্দির, বকচরের মাকরবাহনা গঙ্গামূর্তি, ষাট গম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর সমাধি, মসজিদকুড়ের মসজিদ, ঈশ্বরীপুরের হামামখানা, টেঙ্গা মসজিদ, ঈশ্বরীপুরে চন্ডভৈরবের মন্দির, সাঁইহাটির মন্দির, বুধহাটার মন্দির, নলতার কালী মন্দির, মৌতলার মসজিদ, তালার মঙ্গনমুন্সীর মসজিদ, পরাবাজপুর মসিজদ, বাগেরহাটের হুসেনশাহ মসজিদ, তেতুলিয়ার কাজী বাড়ির মসজিদ, বাগেরহাটের দিদার খাঁ মসজিদ প্রাচীনতম নির্দশন।

মঠ বা দেউলের অন্যতম নিদর্শন অযোধ্যার মঠ যা খুলনা হতে বাগেরহাট যাত্রা পথে কোদলা গ্রামে অবস্থিত। রাস উৎসবের দোলমঞ্চের নিদর্শন পাওয়া যায় খুলনার কাটিপাড়া ও সাতক্ষীরার নলতায়। পীরের আস্তানা বা দরগা দেখতে পাওয়া যায় সাতক্ষীরার লাবসার মাইচম্পার দরগা, দুদলির ছোট মিয়ার দরগা এবং নলতার পীর আহ্ছানউল্লার দরগা শরীফ। এটি আধুনিক কালের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন। এছাড়া অসংখ্য ঈদগাহ প্রমাণ করে দক্ষিণ বাংলা ধর্মের বিকাশ ও প্রসারের এক তীর্থ ভূমি।

লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণ বাংলার গরীব সম্প্রদায় এই কিছু কাল আগেও লবন-মাটি চেঁচে ঘরেঘরে লবণ-শিল্প গড়ে তুলতো। লবণ কিনে খেতে হয় এমন ঐতিহ্য তাদের ছিলো না। শতকরা নিরানব্ব¡ই ভাগ বাস গৃহ মাটি দ্বারা নির্মিত। কেউ কেউ ঘরের বেড়া দিতে গরানের কড়া, বাঁশের ছেঁচা, পাটকাঠি অথবা তক্তা ব্যবহার করতো। এই ঐতিহ্য এখান থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সর্বত্র প্রচলিত ছিলো। এখানে প্রচুর বাঁশ, বেত ও গোলাপাতা জন্মানোর কারণে বাঁশ বেতের নানা প্রকার শিল্প গড়ে ওঠে। গোলপাতার ছাউনি, বেড়া সর্বত্র দৃশ্যমান। এই ঐতিহ্য দক্ষিণ বাংলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। দুধ, মাছ, ধান, ঘি এই অঞ্চলের প্রধান খাদ্যোপকরণ। এ ছাড়া যেন দক্ষিণ বাংলার মানুষের রাত পোহায় না। এই ঐতিহ্য কালের আবর্তে ক্রমে সমাজ থেকে অপসৃত হতে চলেছে।

ধুতি ও শাড়ি ছিল প্রধান পরিধেয় বস্ত্র। ছোট বড়, নারী পুরুষ সকলেই গামছা ব্যবহার করতো। কেবল উৎসবে কাঁধে দোপাট্টা, তসর ও টেলির প্রচলন ছিলো। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এই ঐতিহ্য ছিলো একাকার। চিড়া, খৈ, মুড়ি ও পিঠা ছিল নিত্য দিনের নাস্তা। কাসার থালা, ঘটি, বাটি, গাড়– এবং মুসলমানের তামার বদনা ছিল ব্যবহারের মূল উপকরণ। পিতল ও মাটির হাড়ি, মাটির প্রদীপ, নারকেলের হুকা ও পিতলের গড়গড়া ছিলো পান ও রন্ধনের উপকরণ। শীলত পাটি, হোগলার পাটি, সাপনার বিছানা ও খেজুর পাতার পাটি ছিল শয়নের শয্যা। একই অবস্থাপন্ন বাড়ি হলেই সিং দরজার প্রচলন ছিলো এবং কাঠের নকশি করা সিন্দুকের। নকশিকাঁথা ছাড়া ঘুমুতো না কেউ। বালিশে ব্যবহার করা হতো নকশি কাঁথার ওয়াড়। শিক্ষা শুরু হতো তালপত্রে বাঁশের কলম ও কয়লার কালি দিয়ে। নামতা, শতকিয়ার সাথে শেখানো হতো কড়াকিয়া, গন্ডাকিয়া, কাঠাকালি, বিখাকালি, মনকষা। শিক্ষক বা পাণ্ডিত বসতেন ছোট চৌকিতে বেত হাতে আর ছাত্ররা খেজুর পাতার ছোট ছোট চাটাইতে। রাত জেগে সুর করে  পুঁথি পড়া হতো, পাঠ হতো বিষাদ সিন্ধু। বালু কীর্তন, ভাসান শুনতে যেত দলে দলে। এসব ঐতিহ্যের ছিটে ফোঁটাও এখন অবশিষ্ট নেই এখানে। এখন সবই স্মৃতি আর শ্রুতি। সেই অসম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের দিনগুলো আজ শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যেন দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না বলে হাহাকার করে সর্বত্র।

[পাঁচ]

প্রকৃতির সাথে নিত্য সংগ্রাম করে দক্ষিণ বঙ্গের মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। সংগ্রাম করতে হয় ডাঙ্গায় বাঘ, সাপ, জলে কুমীর ও কামটের সাথে। যুদ্ধ করতে হয় বন ও নদীতে লুকিয়ে থাকা ডাকাত ও দস্যুজীবীদের সাথে। এখানে জেলে, বাউয়াল, গৃহস্থ কেউ নিরাপদ নয়। শত সংকটের এই চিত্র আমরা উইলিয়াম কেরী ও কিছুটা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী, ও ‘কপালকুণ্ডলায়’ দেখি। তারপরও “দিগন্ত বিস্তৃত ধ্যানী বঙ্গ, হাজার নদীর কুলুতান, বন্যা জলোচ্ছ্বাসের তান্ডবের মধ্যে কোলকাতা ও নদীয়া-শান্তিপুরের সান্নিধ্য এখানকার মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।”১০ কেরী, বঙ্কিম, বিভূতি, মানকুমারী, মোঃ ওয়াজেদ আলী, নীলিমা ইব্রাহীম, আনিস সিদ্দিকী, ডাঃ আবুল কশেম,আবুবকর সিদ্দিকী, এবাদুল্লা, আল কামাল অবদুল ওয়াহাব, খায়রুল বাসারের লেখায় ও আব্দুল জলিল, নূরুল ইসলাম, জ্যোতি চট্টোপাধ্যায়, ড. মিজানুর রহমান, মো. গাউয়ুস মিয়ার ইতিহাস সমৃদ্ধ রচনায় তার প্রকাশ ঘটেছে নানা মাত্রায়। অর্থাৎ এক সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য ঐতিহ্য রয়েছে এখানে। আরো প্রমাণ কবি আবুল হোসেন, ভূপেশ আইচ, সিকান্দার আবু জাফর প্রমুখেরা।

এই অঞ্চল যে সব যুগে সমৃদ্ধ ছিলো প্রতœতাত্বিক বা পুরাকীর্তিগুলো তার স্বাক্ষর বহন করে। যা এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে নির্দেশ করে। ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্ম-কর্মের রয়েছে এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। এ্যাডভেঞ্চারের জন্য এই অঞ্চল খ্যাত। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ভৌগলিক’ কবিতায়, বঙ্কিম ও বিভূতির লেখায়, শিবশঙ্কর মিত্রের ‘সুন্দরবন সমগ্র’ গ্রন্থ এই এ্যাডভেঞ্চারিজমের প্রমাণ মেলে। খাজুরা ও লাবসার জাহাজঘাটা, মৌতলার জাহাজ ঘাটা নৌ-দূর্গ, মংলা নৌবন্দর, চালনা নৌবন্দর এই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব বহন করে। যুদ্ধের জন্য ধূমঘট, মহৎপুর গড়, দমদমা-বসন্তপুরের গোলা বারুদের ঘাটি বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। প্রতিরক্ষার জন্য কলারোয়ার  কোঠাবাড়ি প্রসিদ্ধ।

পুরাকীর্তির অন্যতম নির্দশনগুলো হলো সাতক্ষীরা সদরের সুলতানপুর শাহী মসজিদ, সাতক্ষীরার পঞ্চ মন্দির, ঝাউডাঙ্গা জগন্নাথ দেবের মন্দির, বৈকারী শাহী মসজিদ কলারোয়ার শ্যামসুন্দর মন্দির, বুধহাটার দ্বাদশ শিবকালী মন্দির, আশাশুনির বুড়ো পীরের দরগা, দেবহাটার মানিক পীরের দরগা, শ্রী শ্রী গোকুলানন্দ পাটবাড়ি, কালীগঞ্জের ড্যামরাইল নবরত্ন মন্দির, জিও রাধা গোবিন্দের মন্দির, শ্যামনগরের যিশুর গীর্জা, বারদুয়ারী, গোবিন্দদেবের মন্দির ও দিঘি, বাগেরহাটের আমতলীর পীর মৌলানা আব্দুল লতিফের মাজার, পাইকগাছার আলম শা ফকিরের আস্তানা, কপিলমুনির কপিলেশ্বরী কালীমূর্তি, বাগেরহাটের পানি ঘাটে দেবালয়ে দশভূজা মহিষ-মুদিনী মূর্তি যে প্রাচীন পুরাকীর্তির নিদর্শন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এভাবে দেখা যায় দক্ষিণ বাংলায় পুরাকীর্তি বা প্রত্ন নিদর্শনের যে ইতিহাস পাওয়া যায় তা এই অঞ্চলের মানুষের চিন্তা-চেতনা-ভাবনার প্রতীক।

ভাষায়, গানে, বচনে-প্রবচনে, ধাঁ ধাঁ, নীতিকথা, ছড়া কাহিনী কিংবদন্তিতে যে একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য রয়েছে তা শুধু দক্ষিণ বাংলা নয় গোটা বাংলার এক অমূল্য সম্পদ। উত্তর বঙ্গের মতো পট্ট ধান্য মৎস্যে এবং বনজ সম্পদে এই বাংলা এক বিচিত্র বসুন্ধরা। সুপ্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটি লোক ঐতিহ্য, ধর্ম- দর্শন, শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্য-পুরাকীর্তি, পালা-পাঁচালী, যাত্রা নাটক সমাজ সংযোগে স্রোতবাহিত।

আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রী সত্ত্বেও দক্ষিণ বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে মূলত ভাষাগত, গ্রমীণ কৃষিনির্ভর ও মৎস্যনির্ভর অর্থনীতি, খাদ্যাভ্যাস, খেলাধুলা, বাস্ত-রচনা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার- উৎসব , প্রকৃতি, ধর্ম, সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পবোধ থেকে। এখানে জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায়ের ভিন্নতা এই ঐতিহ্য নির্মাণে কখনোই বিশেষ বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। “বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ও ভাষা গোষ্ঠীর লোকেদের মিশ্রণের ফলে যেসব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো সমন্বয়ধর্মিতা।”১১ যা থেকে নির্মিত আমাদের অহংকারী ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্যের ধারা বয়ে চলেছে ইছামতি, কালিন্দী, যমুনা হয়ে কালান্তরে।

তথ্যসূত্র:
১. বাংলার লৌকিক দেবতা, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, দে’জ পাবলিকেশন, কলিকাতা, ১৯৬৬, প্রাককথন, পৃ[৪]
২. চব্বিশ পরগণার লৌকিক দেব দেবী : পালাগান ও  লোকসংস্কৃতি জিজ্ঞাসা - ড. দেবব্রত নস্কর দে’জ পাবলিকেশন, কলিকাতা, ১৯৯৯, ভূমিকা, পৃ.ক
৩. যশোহর খুলনার ইতিহাস- শ্রী সতীশচন্দ্র মিত্র (১ম খণ্ড) ১৯১৪ পৃ. ৪৭
৪. ঐ পৃ ৭২-৭৩
৫. চেতনার অনুষঙ্গ - সিদ্দিকুর রহমান, বাংলা একাডেমী প্রকাশনা,১৯৮২, পৃ. ২৯৩
৬. মানবধর্ম ও বাংলা কাব্যে মধ্যযুগ- অরবিন্দ পোদ্দার, কলকাতা ১৯৮১, পৃ. ৭১
৭. যশোহর খুলনার ইতিহাস- শ্রী সতীশচন্দ্র মিত্র (১ম খণ্ড) ১৯১৪, পৃ. ১৫১-১৫২
৮. সংস্কৃতির রূপান্তর- গোপাল হালদার, মুক্তধারা প্রকাশ ২০০৮, পৃ. ১৭৮
৯. অক্ষয়কুমার মৈত্র ‘সাহিত্য’ ভাদ্র ১৩২৯, ৩৩৯-৪০পৃ.
১০. খুলনা জেলা - মো. নূরুল ইসলাম, ১৯৮২, পৃ ৩৩৮
১১. হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি- গোলাম মুরশিদ, ২০০৬ পৃ ৫০২

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা, ১৫ মে ২০১৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান