
চট্রগ্রাম থেকে: বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন গ্রামীণব্যাংকের প্রথম ঋণগ্রহীতা সুফিয়া খাতুন। চিকিৎসার টাকা যোগাতে তার পরিবারের সদস্যরা মানুষের কাছে ভিক্ষা করেছেন। সুফিয়া খাতুন যখন খুব অসুস্থ তখন তার চিকিৎসার জন্য গ্রামীণব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাহায্য চেয়েও পায়নি তার পরিবার। তার চিকিৎসার জন্য একটি কানাকড়িও দেননি তিনি। এমনকি সুফিয়ার পরিবারের সদস্যরা ড. ইউনূসের গ্রামের বাড়ি কুয়াইশ বুড়িশ্চরে গিয়েও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। কারণ ড. ইউনূস তখন পৈতৃক ভূমিতে নতুন একটি বাড়ি করার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
হাটহাজারীর জোবরা গ্রামের সুফিয়া খাতুনের মেয়ে নুরুন্নাহার খাতুন বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তাদের এই কষ্টের কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আমার মাকে বাঁচানোর জন্য, চিকিৎসা করার জন্য মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা করে টাকা নিয়েছি। কিন্তু ইউনূস কোনো টাকা দেননি। তিনি নিজের বাড়ির কাজের ব্যস্ততার অজুহাত তুলে তার বাড়িতে যাওয়ার পরেও দেখা করেননি।’
সুফিয়া খাতুন মারা গেছেন ১৯৯৪ সালে। কিন্তু ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দিন গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সুফিয়ার দারিদ্র্যবিমোচনের সাফল্যগাঁথা তুলে ধরা হয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। তখন বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, সুফিয়াকে এ পর্যায়ে নিয়ে আসার পুরো কৃতিত্ব গ্রামীণব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের।
বিষয়টি ছিল এরকম- ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর গ্রামীণব্যাংক ও ড. ইউনূস যৌথভাবে যখন নরওয়ের অসলোর সিটিহলে নোবেল পুরস্কার নেওয়ার জন্য মঞ্চে দাঁড়ান তখন মঞ্চে থাকা বিশাল টিভির পর্দায় গ্রামীণব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সম্পর্কে একটি ভূমিকা প্রতিবেদন প্রচার করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম ঋণগ্রহীতা সুফিয়া খাতুনের নাম উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে ঋণ নিয়ে সুফিয়ার ভাগ্য পরিবর্তনের বিশাল অর্জন ফলাও করে প্রচার করা হয়। প্রতিবেদনে দেখানো হয়, সুফিয়া খাতুন ঋণ নিয়ে দোতলা বাড়ি করেছেন। একই সঙ্গে আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার বিষয়টিও ওই প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়।
কিন্তু বাস্তবে কখনোই সুফিয়ার এমন অবস্থা ছিল না বলে জানিয়েছেন জোবরা গ্রামবাসী।
গত ৯ ডিসেম্বর জোবরা গ্রামে সুফিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সুফিয়া খাতুনের দুই মেয়ে লেছু খাতুন (৬০) ও নুরুন্নাহার খাতুন (৫৪) একই বাড়িতে বসবাস করেন। তাদের সঙ্গে রয়েছে তাদের ছেলে মেয়ে ও নাতি-নাতনিরাও।
সুফিয়া খাতুনের বাড়িতে গিয়ে সরজমিন দেখা গেছে, বাড়িটিতে রয়েছে মোট পাঁচটি কুড়ে ঘর। প্রতিটি ঘরেরই জীর্ণ অবস্থা। আর বাড়ির পুরো উঠোনজুড়ে এলোপাতাড়িভাবে পড়েছিল রান্না করার লাকড়ি।
সুফিয়া খাতুনের বড় মেয়ের ছেলে মোহাম্মদ বাবুল বাংলানিউজকে জানান, যে ঘরটিতে সুফিয়া খাতুন থাকতেন সেটিতে এখন বহুকষ্টে নতুন শনের চালা লাগানো হয়েছে। ১৫ দিন আগেও ওই ঘরের চালার ফুটো দিয়ে আকাশ দেখা যেতো বলে জানান তিনি।
একই সময়ে সুফিয়া খাতুনের দুই মেয়ের একজন লেছু প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন খাবারের সন্ধানে মানুষের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার।
এমনকি অসলোর সিটি হলে যেদিন ওই প্রতিবেদন প্রচার করা হয় সেদিনও ওই বাড়িতে দুপুরের খাবারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না বলে জানান লেছু খাতুন। মানুষের বাড়ি থেকে চাল সংগ্রহ করতে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলে তাতেও বাদ সাধে মুষুলধারে নামা বৃষ্টি।
সুফিয়া খাতুনের এক ভাতিজার নাম জেবল হোসেন। আর জেবল হোসেনের বাড়িকেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সুফিয়া খাতুনের বাড়ি বলে তুলে ধরেন ড. ইউনূস।
জেবল হোসেন বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের এতো নামডাক, আর সেই ব্যাংকের প্রথম ঋণ গ্রহণকারী সুফিয়া খাতুনের পুরো পরিবার প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তার নাতিরা রিকশা চালায়। টাকার অভাবে বিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না এক নাতনির।’
জেবল হোসেন বলেন, ‘নোবেল পুরস্কারের সময় আমি দুবাইতে ছিলাম। সেখানে চাকরি করতাম। দুবাইয়ে বসে সেখানকার পত্রিকায় আমি আমার বাড়ির ছবি দেখি এবং ছবির নিচে আরবি লেখা দেখি। পরে সে দেশের একজনকে লেখাটি পড়তে বলি। তার কাছ থেকে আরবি লেখাটির অর্থ জেনে নিই। তিনি আমাকে লেখাটির অর্থ বোঝানোর পর আমি হতবাক হয়ে যাই। এতো বড় মানুষ কীভাবে এই মিথ্যাচার করেন।’
এদিকে, বুড়িশ্চরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, পৈতৃক ভবনে বাস করে তার আত্মীয়রা। ‘ফররুখ মঞ্জিল’ নামের ৩ তলা ওই ভবনের নিচতলায় বাস করেন ড. ইউনূসের চাচাতো চাচা ওয়াজেদ আলী। দ্বিতীয় তলায় বাস করেন অপর চাচাতো চাচা আবুল হাশেম।
ওয়াজেদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘ড. ইউনুস মাঝেমধ্যে এখানে আসেন। তবে ইউনূস নতুন করে এই বাড়ির পাশেই ‘চমন নিবাস’ নামে একটি তিন তলা ভবন নিমার্ণ করেছেন।’
ড. ইউনূস কবে এ ভবন নির্মাণ করেন জানতে চাইলে তিনি জানান, ’৯৪-৯৫ সালের দিকে।
সরজমিন ওই ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এ ভবনটি ‘ডিএম ভবন’ নামে পরিচিত। তিনতলা ভবনটির মোট ১২টি বাসায় ১২টি পরিবার ভাড়ায় থাকছেন। ভাড়াটিয়াদের কেউই তাদের নাম বলতে ইচ্ছুক নন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১০