
শিল্পের প্রাণ হলো তার বাস্তবতা। আর এই শিল্পের বাস্তবতা যিনি রং তুলির মাধ্যমে ক্যানভাসে তুলে ধরতেন তিনি জয়নুল আবেদিন। বাঙালি জাতিসত্তার সার্থক ব্যাখ্যাকারী ছিলেন তিনি।
তিনি ছিলেন বাংলার প্রতিনিধি-আত্মা, জয়নুলের কর্ম প্রচেষ্টা দেশজ, গ্রামজ, তাঁর চিত্রকর্মে বারবার ফুটে ওঠে দেশ আর মাটি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দেশাত্মবোধের পটভূমিতে জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে গ্রাম-বাংলার অন্তরঙ্গ পরিচয় ঘটে সেই কৈশোরেই।
তখন থেকেই বাংলাদেশের গ্রাম ও গ্রামীণ মানুষকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। জয়নুল আবেদিন এমন এক পরিবেশের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন যেখানে নগর জীবনের ব্যস্ততা নেই, কোলাহল, বিতর্ক, আস্ফালন নেই, আছে শুধু আলোকিত বৃত্তের বাইরে নিক্ষিপ্ত অসহায় মানুষগুলো। যারা নীরবে বয়ে নিয়ে চলেছে শাশ্বত জীবনের ধারা।
তাদের সুখ-দুঃখের রূপ বর্ণহীন, প্রত্যাশা সীমিত, জীবন নিতান্ত সহজ-সরল। এ জন্যেই হয়তো জয়নুলের চিত্র কর্মে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। যিনি প্রকৃতি ও মানুষের জীবন থেকে সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। প্রতিভার বিচারে তাই তিনি বাস্তববাদী শিল্পী। তাঁর তুলির টানে ছিল মাটির ঘ্রাণ। তাঁর তুলির টানে আমরা জানতে পারি আমাদের দেশ বাংলাদেশকে।
ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী মানুষের সঙ্গেই তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছিল। তাই তাঁর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছবিতে তারাই বিষয় হয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে ছিল তাঁর হৃদয়ের সম্পর্ক, তাই ক্যানভাসে এদের তুলে এনেছেন হৃদয় দিয়ে। একটি বিষয় লক্ষ্য করবার মতো। স্রোতের বিপরীতে নিজেকে বা কখনও সমষ্টিকে টেনে নিয়ে যাবার প্রবণতা তার মাঝে লক্ষ্য করা যায়।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার ভূ-প্রকৃতি, মানুষ, নদ-নদী এবং সংগ্রাম দেখেছেন আশৈশব। তাঁর হৃদয়ে ব্রহ্মপুত্র তীরের পরিবেশ ছিল প্রোথিত।
জয়নুল আবেদিন ‘আমি যখন ছোট ছিলাম’ শীর্ষক এক স্মৃতিকথায় যে বর্ণনা দিয়েছেন সেখানে তাঁর শিল্পীসত্তার বীজ রোপিত হওয়ার বিষয়টি জানা যায়। স্মৃতিকথায় তিনি বলছেনÑ ‘ব্রহ্মপুত্রের ধারে ধারে ছেলেবেলায় খেলে বেড়াতাম।
শীতের নদী কুলকুল করে বয়ে যেত। জেলে মাছ ধরত, মেয়েরা কাপড় কাচতো। কলসী ভরে পানি নিয়ে যেত বাড়ি, যাত্রী এপার-ওপার করতো খেয়া নৌকার মাঝি। আমি তন্ময় হয়ে দেখতাম মানুষের এই আসা যাওয়া। নদীর ওপারে ছিল ঘন বন।
তাকালে দেখা যেত দূরে নীল আকাশের কোল ঘেঁষে ধূসর গারো পাহাড়। সবকিছু মিলে মায়ার মত লাগত আমার কাছে। একদিন সকালে উঠে বুঝলাম কেমন যেন মিষ্টি বাতাস বয়, দূরে বকুল ডালে কোকিল ডাকে। বুঝলাম বসন্ত এসেছে। বসন্তকালে গাছে গাছে কত ফুল ফুটত। সমস্ত প্রকৃতিতে রঙের হাট বসে যেত।জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবিতে মাঝিরা তাদের নৌকা নিয়ে আপনাআপনি ভাটির টানে বা জোয়ারে ভেসে যায় না।
এগেইনস্ট দ্যা উইন্ডÑ তাঁর ছবির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাঁর অধিকাংশ চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে মানুষের জীবন সংগ্রাম। মানুষ হারতে জানে না। নানান প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যেতে জানে। বিপরীত স্রোতে চলা শ্রম ও মানুষের পেশির বাঁক, নদীর তরঙ্গÑ বাংলার মানুষ ও প্রকৃতি তাঁর শিল্পকর্মের প্রধান উপজীব্য বিষয়। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, জীবন-যন্ত্রনা, অত্যাচার-অবিচার ইত্যাদির বাস্তব রূপায়ণ ঘটেছে বলিষ্ঠ রেখার টানে।
ছবিগুলোর রেখাময় প্রলেপ এতই জীবন্ত যে নীরবে কথা বলে নিরন্তর। তাঁর তীক্ষ্ম দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেনি সময়ের চালচিত্র, প্রকৃতির হাবভাব ও সমাজের বয়ে চলা।
চল্লিশের দশকে আমরা দেখতে পাই দুঃখি মানুষের আর্তনাদ। চারিদিকে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের হাহাকার এবং দীর্ঘশ্বাস। জয়নুল আবেদিন তাঁর ক্যানভাসে আঁকলেন দুর্ভিক্ষের মর্মস্পর্শী দলিল। নদী-তীরে বসবাসরত সুখী মানুষ দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করে। এ যেন অকল্পনীয় ব্যাপার। অথচ সে সময় রাস্তায় ক্ষুধার্ত মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছিল।
জয়নুল আবেদিন এই মানুষদের ভালোবাসতেন, তাই অত্যন্ত বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে আঁকলেন তাঁর প্রিয় মানুষের মৃত্যু। পৃথিবীর ইতিহাসে দুর্ভিক্ষ নিয়ে এমন মর্মস্পর্শী ছবি বিরল। তাঁর আঁকা দুর্ভিক্ষ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ছবিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
আবার তাঁর আঁকা ছবিতে ফুটে উঠেছে বিদ্রোহ! জয়নুল দ্রোহের চিত্র এঁকেছেন একটি ষাঁড় এর মধ্য দিয়ে। এ ষাঁড়টি কিছুতেই ফিরে যাবে না তার রাখালের কাছে। খুরের সাহায্যে খামচে ধরে আছে মাটি। গলায় দৃঢ় রশি ও বাঁকানো মাথাটি বুঝিয়ে দেয় দ্রোহ। আর দ্রোহের শক্তিতে শুধু রশি নয়, সবকিছু ছিঁড়ে স্বাধীন সত্তার প্রকাশ কে তুলে ধরা হয়েছে রূপক অর্থে।
অর্থাৎ মুক্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা, এতো যৌবনের জয়গান, স্বাধীনতার জয়গান। দেশ, মাটি, দ্রোহ, স্বাধীনতা, মুক্তির চেষ্টাÑ এসব কিছু জয়নুল আবেদিন তুলে ধরতে চেয়েছেন স্রোতের বিপরীতে তুলির টানে। শিল্পী জয়নুল আবেদিন তাই অকপটে বলতে পারেন, ‘‘আমি তো এগুলো ‘ছবি’ হিসেবে আঁকিনি। সারাদিন যা দেখতাম, যার অনুভূতি থেকে সন্ধ্যাবেলাও রেহাই পেতাম না, তখন কাগজ তুলি রং ক্যানভাস নিয়ে পাগলের মত আঁচড় দিয়ে যেতাম।’’
১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের অসংখ্য ছবি স্বল্প সময় ব্যয়ে আর নরম তুলির কম আঁচড়ে বলিষ্ঠ রেখায় যে অমূল্য এবং অতুলণীয় শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছেন তা শুধু উপমহাদেশেরই নয়- বিশ্বের শিল্পকলার ভুবনে অমর সৃষ্টি। সঠিক দূরবীনে তাঁকে দূর থেকে নিরীক্ষণ করলে মনে হবে তিনি পূর্ণ বাংলাদেশ।
তিনি ক্যানভাসে সাজিয়ে গেছেন সুনীল আকাশ, শরতের সাদা মেঘের ভেসে যাওয়া, কচি লেবু পাতার মত মমতাময়ী দেশ, বর্ষার মেঘনীল পায়রার রং আর বসন্তের নীল আকাশের রূপের নূপুর। আজীবন ঐতিহ্য সন্ধানী এই শিল্পী তাঁর সব কাজের মধ্যে নিজেকে খাঁটি বাঙালি রূপে পরিচয় দিয়ে আনন্দ পেতেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন শিল্প ও সাংস্কৃতিক চর্চা সমাজকে কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলার পথিকৃত, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর বিস্ময়কর শিল্পকর্মের জন্য বাংলার মানুষ শিল্পাচার্য হিসেবে তাঁকে সবাই হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে দিয়েছে। শৈশব ও কৈশোর
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদে লালিত্যে গড়ে ওঠা অপরূপ সবুজ শ্যামলিমায় নরসুন্দা নদীর তীরে রমণীয় কিশোরগঞ্জে তাঁর জন্ম। বাবা শেখ তমিজউদ্দিন পুলিশ বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর পদে চাকরি করতেন। তাঁর জন্মের সময় তিনি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানায় কর্মরত ছিলেন। তিনি কিশোরগঞ্জ শহরে পরিবার নিয়ে থাকতেন। ময়মনসিংহ শহরের কাঁচিঝুলি গ্রামে জয়নুল আবেদিনের পৈত্রিক নিবাস ছিল। পিতা পুলিশ বিভাগে চাকরি করলেও জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সৎ।
অবৈধ পথে কোন টাকা তিনি আয় করতেন না। নম্র, ভদ্র ও মার্জিত ছিল তাঁর ব্যবহার, জীবন যাপন ছিল সাধারণ মানুষের মত। তাঁর আট সন্তানের মধ্যে জয়নুল ছিলেন দ্বিতীয়।
শৈশব থেকে জয়নুল আবেদিনের আচার-আচরণ ছিল একটু ভিন্ন রকম। সবসময় চুপচাপ থাকতে পছন্দ করতেন। নির্জন পরিবেশ ছিল তাঁর খুব পছন্দ। দুষ্টুমি, হৈ চৈ কিংবা যেখানে অনেক মানুষের সমাগম সেখানে তিনি কখনোই যেতেন না। বাড়িতে লেখাপড়ার জন্য একটি কামরা ছিল তাঁর। সেই কামরায় বসেই তিনি ছবি আঁকতেন। কিছু কিছু ছবিতে রঙ দিতেন, যতœ সহকারে শুকাতেন। এভাবে অনেকগুলো ছবি আঁকা হলে সাজিয়ে রাখতেন বিছানার তলায়। এই চুপচাপ স্বভাব, নীরব নিঃশব্দ বিচরণÑ এসব কারণে শৈশবেই পরিবারে তিনি ছিলেন ভিন্নমাত্রার শিশু।
তাঁর ভিতরে কোন দস্যিপণা, চঞ্চলতা ছিল না, উৎপাতও করতো না কাউকে। এমন শান্ত সৌম্য ঠা-া মেজাজের ছেলে আর একটাও হয় না। তার এমন ঠা-া স্বভাবের জন্য পাড়া-প্রতিবেশী আদর করে তাকে ঠা-ার বাবা বলে ডাকতেন। আগে ঘরে নতুন ফসল উঠলে বাড়ির বউ ঝিদের মধ্যে নকশী করা নতুন পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যেত।
ঠা-ার বাপকে আদর করতো সবাই। ডেকে এনে নকশী করা পিঠা খাওয়াতো। খাওয়ার চেয়েও তাঁর কাছে পিঠার নকশা প্রিয় ছিল বেশি। সেই পিঠা যতটা না খেতেন, নকশার জন্য কলাপাতায় মুড়ে নিয়ে আসতেন বাড়িতে তার চেয়ে বেশি। জয়নুলের মায়ের নাম জয়নাবুন্নেসা। হয়তো মায়ের নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রাখা হয়েছিল জয়নুল। জয়নুলের ডাক নামছিল টুনু। বাবা মা আদর করে ডাকতেন টুনু মিয়া। পাশাপাশি ঠান্ডার বাবা তো ছিলোই।
১৯২২ সালে জয়নুলের পিতা শেরপুর থানার দারোগা। তিনি তার সাথে অবস্থানকালে শেরপুরের রামরঙ্গিনী স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং চতুর্থ শেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯২৬ সালে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত এই স্কুলে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩০ সালে ময়মনসিংহের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ভর্তি হন।
জয়নুল ক্লাসের খাতায় ছবি আঁকতেন। একবার ইংরেজি কবিতা বিষয়বস্তু পরীক্ষার খাতায় তাঁকে লিখতে বলা হয়। কিন্তু তিনি তা না লিখে উত্তরের বিষয়বস্তু খাতায় ছবির মাধ্যমে তুলে ধরেন। তা জেনে প্রধান শিক্ষক তাঁকে শাস্তি দেয়ার জন্য ডাকলেন। তার উত্তরপত্র এনে প্রশ্নপত্রের সাথে মিলিয়ে দেখা হল।
দেখলেন বিষয়বস্তুর সঙ্গে অঙ্কিত চিত্রের হুবহু মিল রয়েছে। প্রধান শিক্ষক চিন্তাহরণ মজুমদার তা দেখে খুব খুশী হলেন। তিনি জয়নুলের পিতাকে ডেকে বললেন, ‘আপনি জয়নুলকে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি করে দেন, দেখবেন ও একজন গ�