ঢাকা: খোকন রাজাকাররা আমাদের চার ভাইসহ প্রতিবেশী নিতাই দাশকে ওই মৌলভী সাহেবকে দিয়ে কলমা পড়িয়ে মুসলমান সঙ্গে আনা টুপি পরিয়ে দেন। এরপর আমাদের চার ভাইয়ের স্ত্রীদের ঘর থেকে টেনে বের করে শাঁখা ভেঙ্গে, মাথার সিঁদুর মুছে তাদেরও মুসলমান বানান। আমাদের সবার মুসলমান নাম রাখা হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা পলাতক জাহিদ হোসেন খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানকালে এসব কথা বলেছেন জীবন কৃষ্ণ দাশ। তিনি খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ২৩তম সাক্ষী।
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেন জীবন কৃষ্ণ দাশ। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন পলাতক খোকন রাজাকারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুশ শুকুর খান। জেরা শেষে আগামী ৩১ মার্চ খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ২৪তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। তিন সদস্যের মধ্যে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন অনুপস্থিত ছিলেন।
বর্তমানে প্রায় ৭৪ বছর বয়স্ক সাক্ষী জীবন কৃষ্ণ দাশ ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার জঙ্গুরদী বাগুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৩০ বছর। তিনি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। সে সময় তিনি পাট ও ভূষির ব্যবসা করতেন।
সাক্ষ্যে জীবন কৃষ্ণ দাশ জানান, ১৯৭১ সালে বৈশাখ মাসে পাকিস্তানি সেনারা ফরিদপুরে পৌঁছালে খোকন রাজাকার, তার বড় ভাই জাফর রাজাকার, বাচ্চু, আয়নাল, আতাহারসহ আরো অনেকে তাদের অভ্যর্থনা জানান। এরপর পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে তারা অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ নেন।
বৈশাখ মাসে খোকন রাজাকার, জাফর রাজাকারসহ অন্যান্য রাজাকাররা তাদের গ্রাম জঙ্গুরদী বাগুটিয়ায় এসে লুটপাট চালান, বাড়িঘর পোড়ান এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মান্তরে বাধ্য করেন। সাক্ষীকেও ধর্মান্তরে বাধ্য করা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি পুরো পরিবারসহ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন তিনি।
জীবন কৃষ্ণ দাশ জানান, ১৯৭১ সালের জ্যেষ্ঠ মাসের প্রথম দিকে খোকন রাজাকার,তার বড় ভাই জাফর রাজাকারসহ অন্যান্য রাজাকাররা তাদের গ্রামে এসে রমেশ রায় ও কানাই লাল মণ্ডলের বাড়ি পুড়িয়ে দেন। পরে তাদের বাড়িতে এসে হত্যা,বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া এবং ধর্মান্তরিত করার হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করেন।
সাক্ষী বলেন, তখন আমার বড় ভাই সন্তোষ দাশ ভয়ে ১০০০ টাকা দেন। তারা আমার স্ত্রীর কাছ থেকে জোরপূর্বক সাড়ে পাঁচ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেন। গ্রামের অন্যান্যদের কাছ থেকেও জোরপূর্বক টাকা আদায় করে ভয়ভীতি দেখিয়ে চলে যান তারা।
এর ২/৩ দিন পরে আবার তাদের বাড়িতে মৌলভীসহ আসেন রাজাকাররা।
তারা আমাদের চার ভাইসহ প্রতিবেশী নিতাই দাশকে ওই মৌলভী সাহেবকে দিয়ে কলমা পড়িয়ে মুসলমান সঙ্গে আনা টুপি পরিয়ে দেন। এরপর আমাদের চার ভাইয়ের স্ত্রীদের ঘর থেকে টেনে বের করে শাঁখা ভেঙ্গে, মাথার সিঁদুর মুছে তাদেরও মুসলমান বানান। আমাদের সবার মুসলমান নাম রাখা হয়।
সাক্ষী বলেন, সেদিন চলে যাওয়ার পরেও রাজাকাররা মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নিতেন। তাদের ভয়ে মাথায় টুপি দিয়ে নামাজ পড়তেন তারা।
জীবন কৃষ্ণ দাশ আরো বলেন, ১৯৭১ সালের জ্যেষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময়ে চাঁদেরহাটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে নগরকান্দা থানার রাজাকার কমান্ডার জাফর রাজাকার নিহত হন। এছাড়া আরো তিনজন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। ভাই জাফরের মৃত্যুর পর রাজাকার কমান্ডার হন খোকন রাজাকার। ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পরে তিন দিন ধরে পুরো এলাকায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ চালান তিনি।
সাক্ষী বলেন, আষাঢ় মাসের শেষ দিকে খোকনসহ রাজাকাররা জঙ্গুরদী বাগুটিয়া গ্রামে এসে কানাই লাল মণ্ডলকে তার বাড়ির পাশের পাটক্ষেত থেকে ধরে এনে নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করেন। তাকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যান।
পরে ডান হাতে গুলিবিদ্ধ কানাই লালকে তার পরিবারের সদস্যরা গ্রামের ডাক্তার বুদাইকে দিয়ে চিকিৎসা করান বলে জানান সাক্ষী।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন কানাই লাল।
সাক্ষী জীবন কৃষ্ণ আরও জানান, ১৯৭১ সালের শ্রাবণ মাসের প্রথম দিকে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তারা তিন ভাই পরিবারের অন্যান্যদের নিয়ে ভারতে চলে যান। দেশে থেকে যান তার বড় ভাই সন্তোষ দাশ ও তার স্ত্রী।দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সবাই আবার বাড়ি ফিরে আসেন।
গত বছরের ২১ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন আরও ২২ জন সাক্ষী। তারা হচ্ছেন আবুল কাশেম, কানাই লাল মণ্ডল, ইকরাম মোল্লা, মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল হাই মোল্লা, মো. ইউনুস মোল্লা, মো. ইদ্রিস সরদার, আব্দুল আজিজ মাতুব্বর, মো. হাফিজুর রহমান চানু, আলাউদ্দিন শেখ, রবীন্দ্রনাথ দত্ত, জগন্নাথ দত্ত, হান্নান মুন্সি, রমেশ চন্দ্র রায়, মো. আবুল কাশেম মাতুব্বর, মো. আব্দুস সালাম মাতুব্বর, কলম শেখ, মো. ইয়াকুব আলী, মো. চুন্নু শেখ, ভূক্তভোগী একজন নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), আব্দুল গফুর মোল্লা, মঞ্জুয়ারা বেগম এবং মো. বতু মিয়া।
এর আগে ১৯ নভেম্বর খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল।
গত বছরের ৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে ১৬ জন নারী ও শিশুসহ ৫০ জনকে হত্যা, তিনজনকে পুড়িয়ে হত্যা, ২ জনকে ধর্ষণ, ৯ জনকে ধর্মান্তরিত করা, ২টি মন্দিরসহ ১০টি গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, সাতজন গ্রামবাসীকে সপরিবারে দেশান্তরে বাধ্য করা ও ২৫ জনকে নির্যাতনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
৫ ও ১৭ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকউটর মোখলেছুর রহমান বাদল। অন্যদিকে ১৭ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন খোকন রাজাকারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান।
গত বছরের ৩০ জুলাই খোকন রাজাকারকে হাজির হতে দু’টি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। পলাতক খোকনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠ ও ডেইলি স্টারে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
কিন্তু তিনি হাজির না হওয়ায় ১৪ আগস্ট খোকন রাজাকারের অনুপস্থিতিতেই তার বিচার শুরুর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে খোকন রাজাকারের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পান আব্দুস শুকুর খান।
খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ৫০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
গত বছরের ১৮ জুলাই প্রসিকউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নিয়ে বিএনপির এ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ২৩ জুন প্রসিকউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার বরাবর এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলেন।
২৯ মে খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে ১৩টি অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে তদন্ত শেষ করে তদন্ত সংস্থা চিফ প্রসিকউটর বরাবর তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
তদন্ত কর্মকর্তা সত্য রঞ্জন রায় এ মামলার তদন্ত করেন। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল শুরু হয়ে গত বছরের ২৮ মে শেষ হয় তদন্ত। তদন্তকালে এ মামলায় ৭৮ জনের বেশি লোকের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তর সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকার হিসেবে জাহিদ হোসেন খোকন লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, আটক, নির্যাতন, ধর্মান্তরকরণ, ধর্ষণ, হত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার নগরকান্দায় এসব অপরাধ সংঘটিত করেন। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন।
অভিযোগ অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে জাহিদ হোসেন খোকন জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। খোকন রাজাকার ফরিদপুরে আরেক মানবতাবিরোধী অপরাধী ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন।
স্বাধীনতার পরে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সর্বশেষ নগরকান্দা বিএনপির সহ সভাপতির পদে থেকে নগরকান্দা পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। তবে মেয়র হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে তিনি পলাতক।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৪