
ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: শিক্ষা-সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আগামী কয়েক বছরে বড় কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাল্টে যাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিত্র। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া হবে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা।
সম্প্রতি বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জেলার তথ্য-প্রযুক্তি, শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন, সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বলতে গিয়ে এ আশাবাদের কথা জানান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ মোশাররফ।
আলোচনার শুরুতেই জেলা প্রশাসক জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, মেঘনা ও তিতাস নদীর উপরে দ্বিতীয় রেলসেতুর কাজ চলছে। এছাড়া অচিরেই আখাউড়া-আগরতলা রেল যোগাযোগ স্থাপন হবে। এজন্য বাংলাদেশ অংশে জরিপের কাজ শেষ করা হয়েছে।
তিনি জানান, জেলার আশুগঞ্জে আন্তর্জাতিক নৌ-টার্মিনালের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন একটি বিদ্যুৎ প্লান্টের কাজ চলছে।
ওই এলাকার ৩৫০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠবে একটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) বলেও জানান তিনি।
শহরের যানবাহনের চাপ মোকাবেলায় ও যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পও অনুমোদন হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হলেই ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হবে। শহরের মৌড়াইল-কালিবাড়ি মোড় থেকে এ ফ্লাইওভার নির্মিত হবে। এছাড়া সরু রাস্তার সমস্যা দূর করতে শহরের কাউতলি থেকে মেড্ডা পর্যন্ত সড়কটি প্রশস্তকরণের কাজও অচিরেই শুরু হবে।
কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ককে অবস্থা সংকটাপন্ন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সড়কের এক্সেল লোড ১৫ টন। কিন্তু পরিবহন হচ্ছে এর বেশি। এটা নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
জেলার শিল্পায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, শহরতলীর নন্দনপুর বিসিক এলাকায় নতুন করে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হবে। ওই এলাকায় অবাধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করে এ ব্যাপারে সরকারকে অবহিত করা হলে শিল্পাঞ্চল স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
জেলার অন্যান্য অবকাঠামো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শহরের প্রাণকেন্দ্রে আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে বড় একটি স্টেডিয়াম, কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে ওজন পরিমাপক সেতু (Weight Measuring Bridge), নাসিরনগরে মৎস্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও প্রাণীসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ডিজিটালাইজেশনেও এগিয়ে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দাবি জেলা প্রশাসকের। তিনি বলেন, এখানকার ৯ উপজেলার মোট ১০০ ইউনিয়ন পরিষদের সবগুলোতেই রয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। প্রতিটি ইউনিয়নের রয়েছে নিজস্ব ওয়েব পোর্টাল। এসব পোর্টাল নিয়মিত আপডেট করা হয় এবং প্রতি মাসে মাসিক সমন্বয় কমিটির সভায় এর অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হয়। এখন ইউনিয়নের বাসিন্দারা এর সুবিধা ভোগ করতে পারছেন।
তিনি জানান, জেলার ৫ উপজেলার ৭ ইউনিয়নকে সার্ক ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের আওতায় নিয়ে বিশেষ ই-সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ওই ৭ ইউনিয়নে ল্যাপটপ, প্রিন্টার, মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম, আসবার ও সোলার প্যানেল সরবরাহ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জেলা কালেক্টরেটে ও রেকর্ড রুমে ন্যাশনাল ই-সার্ভিস সিস্টেম (NESS) চালু হয়েছে। কাগজবিহীন ই-ফাইলে চলছে দাপ্তরিক কার্যক্রম। জেলা প্রশাসনের রাজস্ব ও অর্থ সম্পর্কিত কাজ ছাড়া বাকি সব দাপ্তরিক কাজই সম্পাদিত হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
এর মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন সভার দাওয়াতপত্র, নোটিশ, কার্য বিবরণী ই-মেইলের মাধ্যমে পান। এতে দ্রুত বার্তা পৌঁছানোর ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, কর্মকর্তাদের পাশাপাশি জেলার বাসিন্দারাও এখন রেকর্ড রুম থেকে পর্চা/খতিয়ান পেতে ইমেইলে আবেদন করতে পারবেন। এর নিষ্পত্তিও হবে অনলাইনে। ফলে দ্রুত সেবা প্রাপ্তির পাশাপাশি হয়রানিও কমে যাবে। এই কার্যক্রম দিন দিন আরও সম্প্রসারণ করা হবে।
জেলার শিক্ষা ব্যবস্থার সাফল্য ও বর্তমান চিত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। প্রাথমিকে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার (ড্রপ আউট) হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জেলায় প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির হার এখন শতকরা ৯৭ ভাগ।
নারী শিক্ষা ও উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, নারী শিক্ষায় এ জেলার অগ্রগতি লক্ষ্যণীয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে এখানে ছেলে-মেয়ের সমতা এসেছে। মাধ্যমিক পর্যায়েও প্রায় সমতা বিদ্যমান।
জেলার মাদ্রাসা শিক্ষাও ব্যবস্থারও পর্যায়ক্রমিক উন্নতি হচ্ছে দাবি করেন তিনি বলেন, এখানকার সব মাদ্রাসায় এখন অ্যাসেম্বলি হয়। জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়।
তবে নারী শিক্ষা প্রসারে বাল্য বিয়ে অন্তরায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাল্য বিয়ে রোধে কাজ করা হচ্ছে। স্কুল পরিদর্শনের সময় বাল্য বিয়ে এবং মাদকের কুফলের কথা বলা হচ্ছে। পরিচালনা কমিটিকেও এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। কোথাও বাল্য বিয়ের খবর পাওয়া গেলে ইউএনওসহ প্রশাসনের লোকজন গিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
তিনি জানান, ব্যক্তিগত উদ্যোগে জেলার বাছাইকৃত পিছিয়ে পড়া ৪০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় এনে এগুলোর উন্নয়নে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। এসব প্রতিষ্ঠানে বিশেষ সুবিধা হিসেবে শ্রেণিকক্ষের উন্নয়ন, খেলার মাঠ সম্প্রসারণ, আসবাবপত্র বৃদ্ধি, প্রাক-প্রাথমিকের জন্য অতিরিক্ত কক্ষ নির্মাণ প্রভৃতি সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
কৃষিতে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী হওয়ায় জেলার কৃষিখাতকে তিনি অধিক গুরুত্ব দেন জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, জেলা তথ্য বাতায়নে কৃষি বিষয়ক তথ্য সেবা সচল রয়েছে।
এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির চাষাবাদ পদ্ধতি, সার ব্যবহার, ধান কাটা, মাড়াই, সংরক্ষণ, ভেজাল সার চেনার উপায়, ফসল উৎপাদনে কৃষকের করণীয় ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
প্রায়ই মাঠে কৃষকদের সঙ্গেও তার কথা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যতদূর সম্ভব কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। তাদের বলেছি কৃষিতে উন্নতির জন্য গতানুগতিক চাষাবাদ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে শস্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। ফল-মূল, শাক-সবজির চাষ বাড়াতে হবে।
জেলা কৃষকদের জন্য সার-বীজ নিয়মিত সরবরাহ হচ্ছে কিনা তারও নিয়মিত খোঁজ রাখেন বলে দাবি করেন তিনি।
জেলার এতোসব সাফল্য ও সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরেন জেলা প্রশাসক। মাদক ও গ্রাম্য দাঙ্গাকেই জেলার উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায় মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, এ দুটি সমস্যা নিরসনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এখানকার প্রধান এ দুটি প্রবণতাকে একেবারে জিরো টলারেন্সে আনতে তৎপর জেলা প্রশাসন।
এখানকার কয়েকটি উপজেলার গ্রামগুলোতে পান থেকে চুন খসলেই ঘটে লঙ্কাকাণ্ড। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হত্যা, মামলা-পাল্টা মামলা কিছু এলাকার নিত্যদিনের ঘটনা। এসব ঘটনা কমিয়ে আনতে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দোষীদের সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি জানান, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এখানকার গ্রামে বড় দাঙ্গার ঘটনা হরহামেশা ঘটে। এটা কমিয়ে আনতে এমন তৎক্ষণাৎ বিচারের কৌশল নিয়েছেন তিনি।
এ জেলায় যোগদানের প্রথমদিকে সরাইলে একসঙ্গে ৩০ জনকে, আশুগঞ্জে একসঙ্গে ৩১ জনকে, বিজয়নগরে ৯ জনকে, সদর উপজেলার শিলাউর গ্রামে ৩৩ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়ায় দাঙ্গাবাজরা কিছু দমে গেছে।
এছাড়া দাঙ্গা কমাতে এলাকায় শান্তি সমাবেশের আয়োজনও তার ব্যক্তিগত বুদ্ধিভিত্তিক উদ্যোগ। এতে সাধারণ মানুষ ব্যাপক সাড়া মিলেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), রাজনীতিক ও গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য সভায় দাঙ্গাবাজদের ছাড় না দেওয়ার ঘোষণায় পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকেও বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, আগে প্রতি ঈদের দিনেই জেলার কোনো না কোনো গ্রামে সংঘর্ষ হতো। কিন্তু এবার ঈদুল আযহার দিনে জেলার কোথাও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। এটা গত কয়েক বছরের মধ্যে রেকর্ড বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা।
মাদক সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, মাদক এখানকার একটা বড় সমস্যা। মাদক নির্মূলে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া পুলিশ, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সও নিয়মিত কাজ করছে।
মাদকের ব্যবহার নির্মূলে এখানকার ভারত সীমান্তঘেঁষা ৩ উপজেলার ১০ ইউনিয়নে ইউএনও-ওসির উপস্থিতিতে নিয়মিত আইন-শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক হচ্ছে।
মাদকের ছোবল থেকে তরুণদের বাঁচাতে হলে সমাজের সবাইকেই এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
জেলা শহরের রাস্তা-ঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার নিম্নমানের দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন, আর কোনো জেলা শহরের রাস্তা-ঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার হাল এমন নয়। এসবের আশু উন্নয়নে যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধর্মীয় উন্মাদনা আগের চেয়ে কমেছে দাবি করে জেলা প্রশাসক বলেন, বরং এই জেলা এখন অনন্য।
খেলাধুলার দিক থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অনেক এগিয়ে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানির আর্থিক সহযোগিতায় কিছুদিন আগে এখানে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়েছে। গ্রামীণ ফোনের সহায়তায় নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন চলছে জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট।
দেশীয় খেলা কাবাডি, সাঁতারও নিয়মিত হয়। আসছে শীতে বিভিন্ন খেলা অনুষ্ঠিত হবে বলে জেলার শীর্ষ এ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৬, ২০১৪